আগের অংশ
এবং আশ্চর্য্য চিনিয়ে দেবার পর দেখা গেল, কাকলীর সাথে আমার প্রায়ই দেখা হচ্ছে, কখনো চৌরঙ্গীর মোড়ে ভরদুপুরে, কখনও ১১ নম্বরে ইরানি হীরা অথবা জাফরানী থেকে নামতে...... একদিন তো বক্সীবাজারে বদরুন্নেসার সামনের রাস্তায়। আমি আড্ডা মারছি আমার মেডিক্যালের বন্ধুদের সাথে, ক্লাস শেষ করে ফিরছিল কাকলী। আমাকে তার চেনার কথা নয়, ফলে সে জানতেও পারে না আমার কথা...... অথচ আমরা প্রায়ই ঘটনাচক্রে মুখোমুখি হয়ে যাই।
সে বছর ঢাকায় বসেছিল সার্ক সম্মেলন এর বিশাল আসর। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসাবে বাড়তি লোকবলের চাহিদা মেটাতে আহবান করা হয়েছিল ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রায় শতাধিক ছাত্র ছাত্রী স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছিল, সেবারের সার্ক সম্মেলনের ইভেন্টে।
ভুটানের সাংস্কৃতিক দলটির লিয়াঁজো হিসাবে কাজ করছিল প্রায় ৭ জন ছেলে মেয়ের একটা টিম, আমাদের সাব্বির ছিল সেই টিমের একজন। অলসতার জন্য সাব্বির এর খ্যাতি ছিল অসামান্য। প্রায় একমাস ধরে চলা এই মেগা ইভেন্ট আমাদের মহা অলস সাব্বির কে করে তুলেছিল মহাব্যাস্ত আর কর্মতৎপর। অনুষ্ঠানের সাতদিন তো আমরা প্রায় তার চেহারাই দেখি নাই। শেষ দিন ছিল ওসমানীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাব্বিরের পাঠানো পাশ নিয়ে গিয়েছিলাম আমি আর পারভেজ। বিশাল মিলনায়তনের এক কোনে বসে এত এত সংস্কৃতি দেখে আমার প্রায় কান ঝালাপালা হওয়ার দশা—সিগারেটের নেশা চেপে রেখে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আমি ঝিমাচ্ছিলাম। সাদা শার্টের ওপর টাই বাঁধা স্বেচ্ছাসেবকের ড্রেসে সাব্বির আমাদের পাশে কিচ্ছুক্ষন বসেছিল। আর তখন কাকলীর নতুন কিছু কান্ড-কারখানার কীর্তি সাব্বির আমাদের শোনায়।
এই সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবকদের যাবতীয় প্রস্তুতি ট্রেণিং আর ব্রিফিং এর জন্য ভেন্যু ছিল উত্তরার হাজী ক্যাম্প, সেখানেই সমস্ত টিমের লোকজন জড়ো হতো। আলাদা আলাদা ভাবে টিমগুলো তৈরী হওয়ার আগে প্রাথমিক ব্রিফিংগুলো এক সাথেই দেওয়া হতো। প্রথম দিকের সেই দিনগুলোতে একদিন লাঞ্চের ব্রেকে সাব্বির আবিস্কার করে কাকলীকে। সার্ক সেক্রেটারীয়েটের কম্যুনিকেশন উইংএ কাজ করছিল কাকলী। ক্যফের লম্বা টানা বেঞ্চে খাবার নিয়ে সে বসেছিলো সাব্বির এর কাছাকাছি। লাঞ্চ খেতে খেতে দুই একবার চোখাচোখি হয়েছে, সৌজন্য দেখিয়ে টিস্যুর বক্সটাও এগিয়ে দিয়েছে, কিন্ত সাব্বিরকে সে চেনে এমনটা তার হাব ভাবে সে বোঝায় নাই। কথা বলা তো দুরের বস্তু। খুবই শীতল আচরন, যাকে বলে কোল্ড শোল্ডার। নিজের টিমের পোলাপাইনের সাথে তার গপসপ আর হাসাহাসি দেখে যদিও মনে হয় নাই—ছেলেদের বিষয়ে কাকলী নিরুৎসাহী।
সকালে আসার ব্যাপারটা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ উদ্যোগে, কিন্ত কাজ শেষে প্রতিদিন মাইক্রোবাস সবাইকে নিজ নিজ বাসায় পৌছে দিত। প্রায় দুইদিন একই বাসে কাকলীর সাথে দেখাও হয়েছে সাব্বিরের। সবাইকে নামাতে নামাতে গাড়ী যখন পল্লবী, ওরা দুজন ছাড়া তৃতীয় কেউ নাই গাড়ীতে... চুপচাপ সিটে মাথা হেলিয়ে সারা রাস্তা ওয়াকম্যানে গান শুনে গেছে কাকলী, সাব্বিরের দিকে নাকি চোখ তুলেও চায় নাই।
—হুমম, তো এখন তুই কি চাস? ফেরার পথে আমরা তখন গাড়ীতে, পারভেজ মুখ খোলে...
—শুনলিই তো সব, তোরাই বল আমার কি চাওয়া উচিত? আমি তো এটা ঠিক করতে পারি না..., দুনিয়ার মানুষ কে কার সাথে কি মাত্রায় আন্তরিকতা দেখাবে, কাকে কতটুকু কাছের মানুষ ভাববে! এটা প্রত্যেকের নিজ নিজ ব্যপার......
—মোটেই এটা নিজ নিজ ব্যাপার নয় সাব্বির, কাকলী কি বলতে চায়, সে তোকে চেনে না? পল্লবীতে কখনও তোকে দেখে নাই......?
—দেখতেই পারে, নাও দেখতে পারে... সবাইকে ভদ্রতা শেখানো নিশ্চয় আমাদের কাজ নয়,
আমার রাগ হচ্ছিল সাব্বিরের ওপর, ঘটনা চলছে কয়েক সপ্তাহ ধরে... দিনের পর দিন তোমাকে ইনসাল্ট করে যাচ্ছে একটা মেয়ে, যে কিনা থাকে তোমারই মহল্লায়... অথচ তুমি বাঞ্চোৎ আমাদের কিছু কও না......!
পল্লবীর পানির টাংকির মাঠে আমরা সবাই, এক সন্ধ্যায় আমাদের ক্রাক জয়ন্ত, বন্ধুদের ভরা আড্ডায় কাকলীর ফোন নাম্বার পাওয়ার ঘোষনা দেয়। আর সে যেন কাকলীর অভিভাবক, এমন ভাবে আমার কাঁধে চাপড় মেরে জোর গলায় ঘোষনা দেয়...
—দোস্ত, যা কাকলীরে তোরে দিয়া দিলাম, আজ থাইক্যা কারও কুনো দাবী দাওয়া নাই...
টেলিফোন অফিসের লাইনম্যানদের পয়সা দিয়ে মহল্লার যে কারো ফোন নম্বর জোগার করা সে সময় খুব কার্যকর পদ্ধতি ছিল।
সেদিন বাসায় ফেরার পথে সাব্বির আমাকে আড়ালে বললো, —মহল্লার মাইয়া বুঝছস, যা করবি বুদ্ধি খাটায়া করিস, হুট হাট কিছু করিস না। আর- কখনো আসল নাম ক’বি না, এ সব কেসে আসল নাম কইতে হয় না...
—কিন্ত যদি জিগায়, নাম্বার কই পাইছি......
—ধ্যাৎ শালা, তুই বলে এত এত গল্প লিখিস? আর একটা গল্প বানাতে পারবি না? এই তোর এলেম? একটা মাইয়্যারে পটাইতে পারবি না?
তো কাকের মতো ওলি অর্থাৎ জ্ঞানী, কাকলীকে পটানোর একটা উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম। সেও প্রায় ৩/৪ মাস আগের কথা...... কিন্ত আজ এই সাত সকালে পাশের বাসার ছাঁদএ ওড়না ওড়ানো কাকলীকে দেখে আমার শুধু মনে হলো আমার কপালে আল্লায় বিস্তর দুঃখ লেখছে। —যাকে তাকে লাইড়ো না মামু... বিপদে পইড়ব্যে... প্রিন্স তার চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষায় প্রায়ই আমাদের উপদেশ দিত। এখন আমার খুব মনে হচ্ছে কাকলীকে আমার লাইড়তে যাওয়াই ঠিক হয় নাই। যা আমাকে মানায় না, এমন সব কাজগুলো আমি কেনই বা করতে যাই?
আর ঘন্টা কয়েক বাদে এই বাসার ছাদে উঠবে এক জোড়া চাঁদ, আর সাত সুরের অপার্থিবতায় শ্রোতাদের মাতিয়ে, এই বাসা তার দরজা জানালা সহ বজরা হয়ে ভেসে যাবে সুরধ্বনী নদীতে। সুরের দরিয়া বেয়ে পৌঁছে যাবে স্বর্গের অমরাবতীতে। ছোট ফুফু আজ গান গাইবে, গানের ভরা আসরে। আজ এই ফাগুনের চাঁদ ঝলশানো রাতে, ছাঁদ জোড়া ভরা মেহফিলে তীব্র মাদকতায় মেশা চান্দ্রময়তার ঘোরে সৃষ্টি হবে কত শত অলৌকিক মুহুর্ত... নাটকীয় দৃশ্যপট।
এ সবের মাঝে আবার তুমি কেন কাকলী?
আর কোন নাটকীয়তার খামতি রয়ে গেছে...?
আশেপাশের প্রতিবেশীদের অনেকেই সামিল হবে এই গানের আসরে। হয়তো তুমিও, কাকলী...। শুধু আমার সেজ আপার বিষয়ে তোমার যদি কিঞ্চিত ধারনা থাকতো... সেজ আপা শুধু দয়া করে যদি এই নাটকে মাতব্বরি নেওয়ার একটা চান্স নিতে চায়...... আমার দুর্ভোগের আছে বিবিধ কারন!
আমাকে ছ্যাঁচা দেওয়ার এমন একটা মোক্ষম সু্যোগ...... নিকট ভবিষ্যতে সেজ আপা কখনো ছেড়ে দিয়েছে? উঁহু আমার মনে পড়ে না।
আসরে আমার ভুমিকা বরাবরের মতো পেছনের সারিতে, প্রায় নেপথ্যে... যেখানে যাকে মানায়! গায়কীর সাথে তালে তাল দিয়ে যাওয়া। আমার প্রোটোটাইপের সাথে দারুন মানানসই। অলওয়েজ ইন এ সেকেন্ডারী রোল! তবলায় আমার ওস্তাদ কাজলদা যেমন আমাকে প্রায়ই বলে, ...বুনো তুমি তো সেই আমার আড়ালেই রয়ে গেলে, ফুটে উঠবে কবে?
----------অসমাপ্ত--------------
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০০৯ রাত ৩:২৮