মার্ক জুবাবের এর ব্লগে শুরু হলো, আমার নতুন জীবন...
একজন সাধারন ব্লগারের (অ)সাধারন আত্মকাহিনীর তৃতীয় পর্ব
এই মাত্র যে শব্দটা আমি কি বোর্ডে চাপ দিয়ে টাইপ করলাম, তা বাংলা ব্লগে লিখা আমার প্রথম শব্দ। এর আগে আমি বাংলা কেন, কোন ব্লগেই কখনও একটা শব্দও লিখি নাই। হয়তো কখনও লিখাও হতো না। যদি না গত সপ্তাহে একটা চাকুরি পাওয়ার আশায় জনাব মার্ক জুবাবের সাহেবের সাথে আমার মুলাকাত হতো।
আমার নাম বুনায়েল শাফাত। আমার পরিবারে এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে ডাকে বুনো বলে। বয়স ২৭ এর কাছাকাছি, এখনও বিয়ে করি নাই। সিরিয়াস কোন সম্পর্কে নাই। এতদিন ইন্টারনেটে আমার দৌড় ছিল ইহাহু জিমেইলে ই-মেল বিনিময় আর ফেসবুক পর্যন্ত। গত সপ্তাহের আগে এই ব্লগের মালিক জনাব মার্ক জুবাবের সাহেবের সাথে পরিচয়ের আগে পর্যন্ত আমি ব্লগ কালচারের সাথে কখনই সেভাবে অভ্যস্ত ছিলাম না। সামহোয়্যারইন ব্লগে কখনো কখনো গিয়েছি, কিন্ত কখনো একাত্ম বোধ করিনি। সেখানে কিছু কিছু ব্লগপোষ্ট বেশ আকর্ষনীয় এবং নিঃসন্দেহে প্রাণবন্ত। খুব সাবলীল সেখানের আলোচনা, এবং আন্তরিকতা গুলো ভেতর থেকে উঠে আসা...
কিন্ত নিজকে আমার সব সময় মনে হয়েছে, সদর দরজার বাইরে বিছিয়ে রাখা পাপোষ, তার উপরে দাড়িয়ে থাকা এক আগন্তুক হিসাবে। আমাকে কেউ চিনে না, আমিও কাউকে না। যেন দরজায় দাড়িয়ে দেখছি ভেতরের রাশ উৎসব!! ব্লগের ভেতরে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা- সেই নারী ব্লগাররা, কতো রকম আমোদে তাদের পুরুষ ব্লগার বন্ধুদের সাথে হেসে উঠেছে...
আমার দিকে তারা ফিরেও তাকায় নাই।
ব্লগের জীবনের সাথে আমার কোন বাঁধন গড়ে উঠে নাই। আমার বন্ধু এবং তাদের বন্ধুদের কেউ কেউ ব্লগিংএর সাথে নিয়মিত ভাবে যুক্ত। কিন্ত আমাদের বন্ধুদের আড্ডায় ব্লগ কখনই আলোচনার বিষয় বস্তু হিসাবে আসে নাই। ব্যক্তিগত ভাবে বন্ধুদের কেউ কেউ তাদের ব্লগের কোন পোষ্ট নিয়ে আমার সাথে কথা বলেছে, আমার মতামত জানতে চেয়েছে... আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে নিজস্ব কোন কম্পিউটার না থাকলে ব্লগিং চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার ইন্টারনেট ব্যবহার সব সময়ই বন্ধুদের কম্প্যুটার থেকে, অথবা কোন সাইবার কাফে থেকে।
আমার জীবনটা যে আমার বন্ধুদের মতো নয়, এটা আমি সব সময় খেয়াল রাখি। কখনও ভুলে যাই না। কখনও নিজেকে তাদের জুতায় পা ঢুকিয়ে দেখি না। আমি জানি বেঁচে থাকা মানে এই নয়—ঢাকা শহরে তোমার থাকার একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকবে, বেঁচে থাকা মানে এই নয় তোমার সবচেয়ে চরম আর্থিক সংকটে নিজের বাবাকে ফোন করে বলতে পারবে—আব্বা আমার কিছু টাকা লাগবে। চরম মন খারাপের দিনে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তার আঁচলের ঘ্রান নিতে পারবে।
আমি সব সময় মনে রাখি—বেঁচে থাকা মানে এই নয়, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে—এই বঙ্গদেশে, কোথাও আমার একজন নিজস্ব নারী থাকবে...
আমার চরম দুরবস্থার হাত থেকে আমি আসলে এভাবেই বেঁচে গেছি—যখন মনের গভীরে বিশ্বাস করতে শিখেছি—নিয়মিত একটা ষ্টেডি ইনকাম, একটা ক্যরিয়ার, গোছানো একটা সাজানো জীবন—এটা সবসময়ই অন্য মানুষদের হয়। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ...... তারা প্রায়ই ডাক পায় দেশ-বিদেশ থেকে—সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব। তাদের সাফল্যের মুকুটে সদা যোগ হয় নানান রঙের পালক... বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের দুর্দান্ত দুঃসাহসী ভুমিকা—কি ভাবে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রন হাতের মুঠোয় এনে দেয়। একেকটা সাকসেস স্টোরী কি ভাবে ড্রাফট হতে থাকে। এ সব বর্ণনা শুনে আমার একটুও বাড়তি রং চড়ানো মনে হয় না। খুবই বিশ্বাসযোগ্য সে সব বিবরনীতে এমন কি আমার ঈর্ষাও হয় না।
কেনই বা হবে? এমনটাই তো হবার কথা ছিল... আমার জন্য যেমন কথা ছিল শুধুই অনিশ্চয়তা, আর উৎকন্ঠা, শেষ বেলায় এসে সব কিছু ক্রমাগত নাকচ হয়ে যাওয়া। একেকটা দুঃস্বপ্নের মাঝরাতে ঘেমে নেয়ে উঠে, বিছানায় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা—ঘুমাতেও যেন ভয়, বাকী রয়ে যাওয়া দুঃস্বপ্নের ফিরে আসার আশঙ্কায়।
মাঝারী মানের এক দক্ষতা নিয়ে দিশাহারার এক জীবন আমার। যেন জীবনের শুরুতেই হারিয়ে ফেলেছে সেই ইউজারস ম্যানুয়েল—হাউ টু লিভ আ লাইফ?? তারপর বাকী জীবনটা শুধুই হাতড়ে বেড়ানো... এখানে ওখানে ঠোক্কড় খাওয়া... হাউ টু লিভ আ লাইফ, ড্যুড? হাউ টু লিভ আ লাইফ......?
তাই বলে কি আমার বন্ধুরা আমার আন্তরিক বন্ধু নয়? আমি তাদের জীবনের অংশ নই? তারা আমার আনন্দ দুঃখের সঙ্গী নয়? খুব ভূল এ ভাবনা। বন্ধুদের সাথে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্দ্য, নিটোল এবং অমলিন। আমার সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব তেমনই—আর পাঁচটা বন্ধুত্বের জীবন যেমন হয়... একের দুঃখ হাসি কান্না, ভাগ হয়ে যায় সবার মাঝে।
বরং আমার মনে হয় আমার সফল, নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রায় তারকা এই সব বন্ধুদের সাথে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে অসফল অনুল্লেখ্য এই আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, জুটি হিসাবে দারুন, যাকে বলে মেড ফর ইচ আদার। আমি হলাম তাদের জীবনের কনট্রাষ্ট... নীল রঙ্গের ওপর যেমন লালের পোঁচ ফুটে উঠে, কালোর ওপর সাদা যেমন তার শুভ্রতার পুর্ণতা পায়।
আমার প্রতিটা ব্যর্থতা তেমন তাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ হিসাবে জীবনে তারা কত সফল......
_লোকালটকের সাথে পরিচয়...___________________
প্রথম আলো পত্রিকার আই টি বিভাগ সহ বেশ কয়েকটা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক পল্লব মোহাইমেন ওরফে লোকালটক, আমার বন্ধু পাভেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুকারস সেভেনএর এক সন্ধ্যার আড্ডায় পল্লবের(লোকালটক) সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল পাভেল।
—উনি একজন বিখ্যাত ব্লগার..., পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় পাভেল আমাকে চাপা স্বরে বলেছিলো।
ব্লগের বিষয়ে আমার নাবালকত্ব, আমাকে বিষয়টির মাজেজা এবং গুরুত্বের দিক বুঝাতে পারে নাই। বিশেষ করে উনার নাম কেন- এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, তারপর চাপা স্বরে উচ্চারন করতে হবে, তা আমার মাথায় ঢুকছিল না।
সি এ ভবনের নীচ পর্যন্ত পল্লব মোহাইমেন সিড়ি ভেঙ্গে নেমে এলেন, আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। অন্যমনস্ক ভাবে পাশের সিগারেটের দোকান থেকে গোল্ডলিফ কিনলেন—আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরলেন। আমি যে সিগারেট খাই না, এটা উনার প্রায়ই মনে থাকে না...
—আমি আসলে আপনাকেই খুঁজছিলাম। আমার আবার স্মরণ শক্তি বেশ ভাল, বুজছেন। আপনি তো লিখালিখি করতে চান, তাই না? অনেক আগে পাভেল ভাই আপনার কথা বলেছিল। আমার মনে আছে।
—লিখালিখি! কি ধরনের? প্রথম আলোয় নাকি? আমি একটু আমতা আমতা করি।
—না, এটা প্রিন্ট মিডিয়ায় নয়, ওয়েবে, তবে পয়সা যা দিবে, প্রিন্ট মিডিয়ার অনেকেই তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না। আপনার লিখালিখি কখনও দেখার সু্যোগ হয় নাই, গদ্যে খুব ভাল করতে হবে..., বাংলা ব্লগ সাইটগুলো কখনও দেখেছেন... ধারনা আছে কি ধরনের লেখালেখি হয় সেখানে?
—প্রথম আলোরটা দেখি মাঝে মাঝে, আমার বেশ কিছু বন্ধু ব্লগিং করে এখানে... তবে খুব বেশি জমজমাট আমার কাছে মনে হয় নাই...
—না, আমি প্রথম আলোর কথা আপনাকে বলি নাই, সামহোয়ারইন ব্লগ নামে আর একটা ব্লগ সাইট আছে, আমি লিঙ্কটা আপনাকে মেইল করে দিব, একটু ঘাটাঘাটি করে দেখেন, আপনার একটা কাজের ব্যবস্থা হতে পারে।
—ওঃ সামহোয়্যরইন? আমি দেখেছি তো...
তৃতীয় পর্ব শেষ করিতে পারিয়া ভাল বোধ করিতেছি।
এই আত্মজৈবনিক আপাতত চলিতেই থাকিবে, অনির্দিষ্ট কাল ধরিয়া। তবে পাঠকদের প্রতি আমার আর্জি--মনে রাখা দরকার, হয়তো মার্ক জুবাবের সাহেব একজন খাঁটি ভদ্রলোক, তবুও শেষ বিচারে আমি যা করিতেছি তাহা খাঁটি চাকুরি ভিন্ন অন্য কিছু নহে। আপনাদের সাড়া না পাইলে আমার এই চাকুরি কতদিন চলিবে, তাহা আপনাদিগকে ভাবিতে অনুরোধ জানাই।
ধারাবাহিক এই কাহিনী পাঠ করিয়া বিপুল ভাবে আমোদিত হউন...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫৩