somewhere in... blog

সিরিয়ার আসল দৃশ্যপট

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিরিয়ার আসাদ পরিবারের পতন নিয়ে পজিটিভ নেগেটিভ যেকোন মন্তব্য করার আগে ওদের দেশে কি ঘটছে সেটা আগে বুঝতে হবে। আসেন, সংক্ষেপে কিছু বলি:

১. আসাদ পরিবার যে স্বৈরশাসক ছিল, এইটা নিয়ে দুনিয়ার কারোরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। বাশারের বাপ ক্ষমতা দখল করে গদিতে বসেছিল, এবং নিজে শিয়া হয়েও সুন্নি মেজরিটির সিরিয়ার উপর ক্ষমতা ধরে রাখতে দমন পীড়নের শাসন চালিয়েছিল। আরব যেকোন দেশের মতোই এখানেও একনায়কতন্ত্র ছিল। সিরিয়ার লোকজন পরম সুখে দিনকাল অতিবাহিত না করলেও জীবন চালিয়ে নিচ্ছিল। পিতার মৃত্যুর পরে বাসার ক্ষমতায় আসে।

২. আরব বসন্তের ফলে একের পর এক যখন আরব শাসকদের পতন ঘটছিল, তখন অন্যান্য আরব দেশের মতোই বাশারও নিজের গদির নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়। এরমাঝে ইকোনমি ধ্বসে যাওয়ায় লোকজনের মাঝেও ক্ষোভের দানা বাধতে শুরু করে। সেও দমন পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য আরব দেশ যেমন নিজেদের লোকেদের শান্ত করতে নাগরিক অধিকার বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়, বাশার সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করে নাই। এ থেকে বুঝা যায়, ও কখনই নিজের দেশের লোককে নিজের আপন হিসেবে দেখেই নাই।
এমন সময়ে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরের দেয়াল লিখন "এরপরে তোমার পালা, ডাক্তার!" ঘটনা নিয়ে সে সীমাতিক্রম করে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বাশার মেডিকেল স্কুলে পড়াশোনা করায় ওকে ওর দেশে "ডাক্তার" বলেও অনেকে ডাকে। তা এই দেয়াল লিখন যে ওর বিরুদ্ধেই ক্ষোভ প্ৰকাশ ছিল, সেটা বুঝতে নোবেল জয় করা লাগেনা। সে নিজের ফৌজ পাঠিয়ে ঐ স্কুলের কিছু বাচ্চাকে তুলে নিয়ে আসে, যার মধ্যে ঐ কিশোরটিও ছিল, এবং ওদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। অমানবিক মারধর থেকে শুরু করে নখ তুলে ফেলা, সবই চলে সেই কোমলমতি শিশুদের উপর। কিশোরদের বাবা মায়েরা ওদের মুক্তির জন্য গেলে ওদেরকে বলা হয় "ওদের কথা ভুলে গিয়ে বাড়িতে গিয়ে আরও নতুন বাচ্চা পয়দা করো। আর যদি তোমরা তা না পারো, তাহলে তোমাদের মেয়েদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দাও।"
জনমনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যদিও শান্তিপূর্ণভাবেই সব হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে কিশোরগুলোকে মুক্তিও দেয়া হয়। কিন্তু ওদের দুর্দশা আর ওদের প্রতি করা জুলুমের পরিমান দেখে সাধারণ মানুষ আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনা। রাস্তায় নেমে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। সরকারি দল ওদের উপর জালিমের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানবতাবিরোধী কেমিক্যাল অস্ত্রও ব্যবহার করে শিশু সহ জনতার লাশের স্তুপ জমা করে বাশার সরকার।
শুরু হয় এমন এক সংগ্রাম, যা পৃথিবীর ইতিহাসেই হয়তো সবচেয়ে জটিল গৃহযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

৩. বাশার আল আসাদ "শিয়া" হওয়ায় সৌদি বা সুন্নিপ্রধান আরব দেশগুলো ওকে তেমন পছন্দ করতো না। অন্যদিকে ঠিক একই কারনে ইরানের জানের জান, প্রাণের প্রাণ ছিল সে। সৌদির বন্ধু আমেরিকা, ইরানের বন্ধু রাশিয়া। এদিকে কেমিক্যাল ওয়েপন ব্যবহার করে জনহত্যায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ করে বাশার, গোটা বিশ্ব ছিঃছিঃ করলেও রাশিয়া এবং চায়না ভেটো দিয়ে দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে ফেলে। আমেরিকা এর প্রতিবাদে এবং আইসিস ঠেঙাতে ওবামার সময়ে এই যুদ্ধে জড়ায়। ট্রাম্প এসে সৈন্য প্রত্যাহার করলেও বাশার আবারও কেমিক্যাল হামলা চালায়, এবং আমেরিকা আবার এই যুদ্ধে জড়ায়।

কাজেই দেখা যাচ্ছে সিরিয়াকে ঘিরে এক জটিল দাবা খেলা শুরু হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিগুলো নিজ নিজ স্বার্থে আসাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাঝে দিয়ে আল কায়েদা ও আইসিস (তখনও আইসিস হয়নি) সুযোগ বুঝে বাম হাত ঢুকায় দেয়। আবার বহু বছর ধরে স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্নে বিভোর কুর্দি জনগোষ্ঠী মনে করে এই সুযোগ, বাশারের পতন হলেই ওরা নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে যাবে। কুর্দিদের এই স্বপ্নে অতিষ্ট টার্কিও তখন এই যুদ্ধে জড়ায়, কারন "স্বাধীন কুর্দিস্তানের" একটা বিরাট ভূখন্ড টার্কিরও অংশ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মূলত চতুর্মুখি।

১. বাশারের সেনাবাহিনী, যার পক্ষে আছে রাশিয়া, চায়না ও ইরান।
২. সিরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, যেখানে সাধারণ জনতার পাশাপাশি আছে সৌদি আরব, আমেরিকা ও এর মিত্ররা ইনক্লুডিং ইজরায়েল।
৩. স্বাধীন কুর্দিস্তানের গোষ্ঠী, কুর্দিরা ছাড়া আপাতত আমার জানামতে বড় কেউ নেই। তবে বিপক্ষে আছে টার্কি। নিজের দেশের স্বার্থ এতে জড়িত।
৪. আল কায়েদা, আইসিস - বেহুদা মারামারি করে সাধারণ মানুষ মারছে। ওদের আদর্শ জঙ্গিবাদ। সাথে যুক্ত করতে পারেন আমেরিকা ও ইজরায়েলের পতন।

এই চার বাহিনীর হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ জনগণ। একেক বাহিনী একেকটা রকেট হামলা চালায়, মরে এই নিরীহ জনতা। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম নগরীর অন্যতম দামেস্ক এবং অসম্ভব সুন্দর একটি দেশ সিরিয়া এখন পৃথিবীর বুকে এক খন্ড নরকে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছেন, লাখে লাখে জনতা উদ্বাস্তু হয়ে ভিনদেশে ভিখিরির জীবন কাটাচ্ছে। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে ডুবে মরছে, সৈকতে ভেসে আসছে নিরীহ শিশুর লাশ, মরার আগে শিশু বলছে "আমি আল্লাহকে সব বলে দেব!" আমেরিকায় গ্রোসারি দোকানের সামনে সিরিয়ান তরুণী ভাঙ্গা ইংলিশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাইছে "সালামালায়কুম ব্রাদার, মাই হাজবেন্ড, শহীদ। প্লিজ হেল্প!"

আল্লাহর কসম, এসব ঘটনায় আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি যা লিখলাম, ঘটনা এরচেয়ে হাজারগুন বেশি ভয়াবহ, যা লিখতেও মন ভেঙ্গে যায়, চোখের বাঁধে ফাটল ধরে। ওদের মতন আমরাও চাই এই মৃত্যুর বিভীষিকা বন্ধ হোক। যে পক্ষই জিতুক, যুদ্ধ থামুক। টাকা পয়সা, দামি বাড়ি গাড়ির প্ৰয়োজন নেই, শুধু এই নিশ্চয়তা পেলেই হবে যখন পরিবারের সব সদস্য যখন একসাথে বসে গল্প করছে, ঠিক তখন মাথার উপর কোন রকেট আছড়ে পড়বে না। সামান্য দেয়াল লিখনের জন্য সরকার কোন শিশুকে তুলে নিয়ে যাবেনা।

বাংলাদেশের মফস্বলে থেকে কুয়োর ব্যাঙের জ্ঞান নিয়ে আপনি ক্রিটিসাইজ করতেই পারেন "আমেরিকান জোটের জয় হয়েছে - এতে খুশি হওয়ার কিছু নাই" - কিন্তু একটু পড়াশোনা করলে জানবেন আমেরিকার পাশাপাশি সৌদি ও অন্যান্য সুন্নি আরবরাও সাধারণ সিরিয়ানদেরই পক্ষে লড়েছে। হ্যা, ইজরায়েলেরও স্বার্থ আছে, কিন্তু আগেতো মানুষের প্রাণ রক্ষা, তারপরে ইজরায়েল-ইহুদি-জায়নবাদ ইত্যাদি নিয়ে ক্যাচাল! দুনিয়া সাদা/কালো নিয়মে চলে না, এখানে সবকিছুই ধূসর। আমাদের জীবনে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে যে আমাদের দুইয়ের মধ্যে একটা বদমাইশকে বেছে নিতে হয়।
সাধারণ সিরিয়ানরা দেখছে যে আপাতত চার অপশক্তির একটির পতন ঘটেছে। রইলো বাকি তিন। এরমাঝে সবচেয়ে বড়টাই বিদায় নিয়েছে। সেজন্যই আলহামদুলিল্লাহ!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:০৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এখানে আর নিরাপত্তা কই!=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:১৩


কোন সে উন্নয়নের পথে হাঁটছি বলো
এই গিঞ্জি শহর কি বাসের অযোগ্য নয়?
শূন্যে ভাসমান রাস্তা-নিচে রাজপথ
তবু কি থেমে আছে যানজট কিংবা দুর্ঘটনা?

দৌঁড়ের জীবন-
টেক্কা দিতে গিয়ে ওরা কেড়ে নেয় রোজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই শহর আমার নয়

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:০২




এই শহর আমার নয়
ধুলিমলিন, পোড়া ধোঁয়ায় ঘেরা
ধূসর এক স্বপ্নহীন চেহারা।
এই শহর, আমার নয়।

ঘোলাটে চোখে জমে হাহাকার,
চেনা মুখেও অচেনার ছাপ।
পথে পথে স্বপ্নরা পোড়ে,
আলোর ছায়ায় খেলে আঁধার।

এই শহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

টিউবওয়েলটির গল্প

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০৪



এটা একটি টিউবওয়েল।

২০০৯ সালে, যখন আমি নানী বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতাম, তখন প্রতিদিন এই টিউবওয়েল দিয়েই গোসল করতাম। স্কুল শেষে ক্লান্ত, ঘামাক্ত শরীর নিয়ে যখন ঠান্ডা পানির ঝাপটায় নিজেকে স্নান... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজায় গণহত্যা : মুসলিম বিশ্বের নীরব থাকার নেপথ্যে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৫৮


গাজার প্রতিটি বিস্ফোরণে কেবল ধ্বংস হয় না —প্রতিধ্বনিত হয় একটি প্রশ্ন: মুসলিম বিশ্ব কোথায় ? মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির আয়নায় এই প্রশ্নটি এক খণ্ড অন্ধকার, যা শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যর্থতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লেখকের প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টি

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:০০

একজন লেখক যখন কোন কিছু লিখেন, তিনি কিছু বলতে চান বলেই লিখেন। বলাটা সব সময় সহজ হয় না, আবার একই কথা জনে জনে বলাও যায় না। তাই লেখক কাগজ কলমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×