রানার খুব বাজে একটা রোগ আছে। তার ঘুম ভীষণ পাতলা। সহজে ঘুম আসতে চায়না। মেঝেতে পিন পতনের শব্দতেও তার ঘুম ভাঙ্গে। এবং একবার ভাঙ্গলেই সর্বনাশ। কিছুতেই ফেরত আসে না।
বাকি রাত তাকে বিছানায় গড়াগড়ি করে কাটাতে হয়। রাতের শহরের বিচিত্র শব্দ তার কানে আসে। রিকশার টুং টুং বেলের শব্দ, দূরের বড় রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা গাড়ির শব্দ, কুকুর-বেড়ালের কান্না, প্রহরীর হুশিয়ারী - কিছুই বাদ যায়না।
সকালের দিকে যাও একটুবা ঝিমুনি আসে, তাও অফিস যাবার তাড়ার জন্য বিছানা ছাড়তে হয়।
আজকেও সে বুঝতে পারছে তাকে একটি বিনিদ্র রাত কাটাতে হবে।
গভীর ঘুম থেকে সে যখন চোখ মেলল, তখন সে দেখে সারা ঘর অন্ধকারের দখলে। কয়টা বাজে দেখতে সে বালিশের নিচে চার্জ হতে থাকা মোবাইল ফোন তুলে নিল। টিকটিক শব্দে ঘুম আসেনা বলে সে তার শোবার ঘরে কোন দেয়াল ঘড়ি রাখেনা। মোবাইল ফোনই তাকে সময় বলে দেয়।
রাত তিনটা। তার খুব মেজাজ খারাপ হলো। রাত একটার দিকে সে ঘুমাতে এসেছে। মাত্র দুঘন্টা ঘুমাতে পেরেছে। এখন সারারাত জাগলে কাল অফিসে গিয়ে তার ঝিমাতে ঝিমাতে কাজ করতে হবে। মাত্র দুঘন্টা ঘুমিয়ে কেউ বাঁচে? নেপোলিয়ন নাকি তিনঘন্টা ঘুমাতেন। তাও নাকি ঘোড়ার পিঠে! রানার ধারনা এসব চাপাবাজি। বড় বড় মানুষদের নিয়ে মানব সমাজে এরকম গুজবের প্রচলন আছে। একটা সম্রাট কোন দুঃখে ঘোড়ার পিঠে ঘুমাবেন?
রানা ভাবার চেষ্টা করছে তার ঘুম কেন ভাঙ্গলো। সে কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছিল? না। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে তার বুক ধরফর করতে থাকে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই সে বাম দিকে ফিরে তিনবার থুথু দিয়ে ডান পাশ ফিরে বলে, "আউজুবিল্লাহি মিনাশশায়ত্বানির রাজীম!"
দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে এটাই করার নিয়ম। ইসলামে আছে।
একবার এক বিভৎস স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গেছিল। সে যথারীতি বাম পাশ ফিরে তিনবার থুথু দিয়ে দিয়ে ডান পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, তার বাম পাশে তার খালাতো ভাই শহীদ শুয়ে আছে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। বেচারা, ঘুমের মধ্যে টের পায়নি কোন তরলে তার মুখ ভিজেছে!
রান্না ঘরে বাতি জ্বলে উঠলো। রানা ধরমর করে বিছানায় উঠে বসলো। সে ছাড়া তার বাসায় কেউ থাকে না। বাড়ির মালিক দুইটা কামড়া বানিয়ে দিয়েছেন। একটাকে সে শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করে, আরেকটা খাবার ঘর। খাবার ঘরের সাথেই লাগোয়া রান্না ঘর। সেটাকে "ঘর" বলাটাও ঠিক না। একটা চুলা রাখার স্থান হয় কেবল। সাথে একটা বেসিন। চুলার নিচে ক্যাবিনেটের মত জায়গায় সে রান্নার হাড়ি পাতিল রাখে। সে ব্যাচেলর মানুষ, তার অত হাড়ি পাতিলও নেই। একটা হাড়িতে ভাত রাধে, আরেকটাতে ডাল, তরকারী, ডিম ভাজি সব। মাল্টি পারপাস হাড়ি বলা চলে। সেই রান্না ঘরেই বাতি জ্বলে উঠলো।
চোর এসেছে? রানা বুঝতে পারেনা তার কি রান্না ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয়া উচিৎ? তার বাড়িতে চুরির তেমন কিছু নেইও। মাঝে দিয়ে বাঁধা পেয়ে চোর তার পেটে ছুড়ি চালিয়ে দিতে পারে।
খাবার ঘরে কারও পায়চারীর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিশ্চিত ঘরে চোর ঢুকেছে। সে মশারি সরিয়ে বিছানার (বিছানা বলাটা ঠিক না। মেঝের উপর জাজিম আর তোশক ফেলে তার উপর চাদর বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে) পাশে রাখা ছাতা হাতে তুলে নিল। হাল আমলের ফ্যাশনের ‘লেডিস’ ছাতা নয়। গ্র্যান্ডফাদারের যুগের শক্ত টেকসই ছাতা। শক্ত ডান্ডা, সামনের দিকটা চোখা। অস্ত্র হিসেবে মন্দ না।
সে মেঝেতে পা দিতেই ওঘরের পায়চারী বন্ধ হয়ে গেল। এবং রান্না ঘরের বাতিও কেউ নিভিয়ে দিল। ফিউজ হয়নি, স্যুইচ টেপার শব্দ তার কানে এসেছে।
তাহলে কি চোর চলে গেছে? তার কি একবার ওঘরে গিয়ে খোজ নেয়া উচিৎ? চোরের হাতে যদি অস্ত্র থাকে? এরচেয়ে এখানে থাকলে চোর তাকে আক্রমণ নাও করতে পারে।
সে আবার মশারির ভিতরে চলে এলো। তবে খুব সতর্ক রইলো। হাতে শক্ত করে ছাতা ধরা। ভেজানো দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি। একটু নড়তে দেখলেই আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুত থাকবে সে।
ওঘরে আর কোন শব্দ হচ্ছে না। চোর কি চলে গেছে? নাকি ওটা ছিল স্রেফ তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা? মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় একটা অডিটরি হেলুসিনেশন হয়ে গেছে? স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের এমনটা হয়। তারা নানান শব্দ শুনতে পায়, অনেক কিছুই দেখতে পায় যার কোন অস্তিত্ব বাস্তবে নেই।
সে আবার বালিশে মাথা ঠেকালো। আরেকবার ঘুমাবার চেষ্টা করা যাক। কাল সকালে ভীষণ জরুরি কাজ আছে। আগামীকাল ক্লোজিং। একটা বিল তার উপরেই আটকে আছে। যদি সেটা সম্পূর্ন না করতে পারে, তাহলে তার খবর আছে।
আবারও রান্নাঘরে বাতি জ্বলে উঠলো। সেই সাথে খাবারঘরে পায়চারা। মানুষের পায়ের শব্দ। অন্য কোন বাড়ি থেকে নয়, তার নিজের ঘর থেকেই আসছে।
এবারে ভয় থেকে বেশি আসলো বিরক্তি। হাতে ছাতা তুলে নিয়ে মশারির বাইরে মেঝেতে পা ফেলল। এখন পায়ের শব্দ থেমে গেলেও বাতি নিভলো না। খুব সাবধানে সে ভেজানো দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ওঘরের বাতি এখনও জ্বলছে। ছাতায় ধরা হাতের বাঁধন শক্ত করলো। ভেজানো দরজা আরেকটু সরিয়ে সে খাবার ঘরে উকি দিল। কাউকে দেখতে পেল না। তার খাবার ঘরে তেমন কোন আসবাব নেই। একটি টেবিল, এবং দুইটি চেয়ার। সে টেবিলের নিচে উকি দিয়ে দেখে নিল। কেউ নেই।
সদর দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে বন্ধ। ছিটকারীর হাতল ডানদিকে ফেরানো। সেই লাগিয়েছিল। সে ছিটকারীর হাতল ডানদিকে ফিরিয়ে রাখে।
তাহলে কি চোর বা অনুপ্রবেশকারী রান্না ঘরে লুকিয়ে আছে?
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না রান্নাঘরে কেউ আছে কিনা। তাকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে হবে। তার বুক ধরফর করা শুরু করলো। দরজার কাছাকাছি যেতেই কেউ যদি তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে?
সে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। ওখানেও কেউ নেই। একদম নিরব। বেসিনে কল থেকে পানিও পড়ছে না। রান্নাঘরের ছোট ঘুলঘুলি সাইজের জানালাটাও ভিতর থেকে বন্ধ। বাতি না জ্বালানো থাকলে সে নিশ্চিত হত যে এসব কিছুই ছিল তার মনের ভুল।
যাই হোক, কেউ যখন বাড়িতে নেই, তাহলে এত টেনশনেরও কিছু নেই। বাতি জ্বালা রহস্য আগামীকাল ভাবা যাবে। আপাতত বিছানায় ফেরত যাওয়া যাক।
সে বাতি নিভিয়ে পেছন ফিরতেই দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেল। হাতরে হাতরে সে আর দরজা খুলে পেল না। আশ্চর্য! এখানেইতো ছিল দরজা! সেতো দরজা ঘেষেই দাঁড়িয়ে ছিল! এখন কোথায় গায়েব হয়ে গেল?
অন্ধকারে সে অন্ধের মত হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। কোথাও সে দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। ঘরের দেয়ালগুলোও যেন অনেক দূরে দূরে সরে গেছে। এখন সে যেন তার বাড়ির রান্নাঘরে নেই। তার রান্না ঘরতো এত বড় ছিল না!
আতঙ্কিত রানা স্যুইচের খোঁজে দেয়াল হাতড়াতে লাগলো। এখন তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আলোর। তার কাছে মনে হচ্ছে আলো জ্বলে উঠলেই তার বিপদ কেটে যাবে।
অবশেষে তার হাত পড়লো দেয়ালের স্যুইছে। স্যুইচ টিপে দিল। আলো জ্বলল না। সে পাগলের মত স্যুইচ টিপতে লাগলো। কিছুতেই আলো জ্বলছে না।
হঠাৎ তার মনে হলো তার সামনে একটি ছায়ামূর্তি দাড়িয়ে আছে। টিংটিংয়ে শরীরের একটি ছায়ামূর্তি। মানুষের মতন শারীরিক গঠন, কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে সে মানুষ না।
মহাআতংকিত রানা কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সে নিশ্চিত এটি তার রান্নাঘর নয়। তার রান্নাঘরে এত জায়গা নেই। এতক্ষণে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেত। এ কি করে সম্ভব? তার ঘর থেকে সে ভিন্ন আরেক ঘরে আসলো কি করে?
সে ঘুরে দেখার চেষ্টা করলো দেয়াল কতদূর। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পেছনে ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ছায়ামূর্তির ওপর পড়া আলোর উৎস সে খুঁজে পেল না।
ছায়ামূর্তি তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে ঘুরে দৌড় শুরু করলো। তার কাছে মনে হলো তার অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে সে ট্রেডমিলের উপর দৌড়াচ্ছে।
বিপদে পড়লে আয়াতুল কুরছি পড়তে হয়। আয়াতুল কুরছি তার মুখস্ত। এখন যেন জিহ্বা ভারী হয়ে গেছে। কিছুতেই পড়তে পারছে না।
দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। আর তখনই বাতি জ্বলে উঠলো। সে হাপাতে হাপাতে দেখলো সে তার খাবার ঘরে শুয়ে আছে। রান্না ঘরের বাতি নেভানো। খাবার ঘরের বাতি জ্বলছে।
সে দেখতে পেল তার ছাতা রান্না ঘরের দরজায় পড়ে আছে। সে থাবা মেরে ছাতা তুলে নিল। তার বুক এখনো হাপাচ্ছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সে নিজের বিছানায় এসে বসলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে? সেটা কি ঠিক হবে? এমনওতো হতে পারে পুরোটাই স্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। দুঃস্বপ্নকে এত পাত্তা দেয়ার কিছু নেই।
সে বাম পাশে তিনবার থুথু দিয়ে ডানপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। পুরো বাড়ির বাতি জ্বলছে। জ্বলুক। আজকে রাতে অন্ধকারের প্রয়োজন নেই।
শুয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ জড়িয়ে আসল। এটা নিশ্চই একটি দুঃস্বপ্ন ছিল। দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তখনই সে ধরমরিয়ে উঠে বসলো। কারণ তার সামনেই আবারও সেই ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কি বিভৎস কুৎসিত দেখতে! সে ঠিকই বুঝেছিল, এটা মানুষ না। টিকটিকির মুখের মতন মুখ। কপালের দিকে মানুষের মতন পাতলা ফিনফিনে চুল। হাতগুলো অস্বাভাবিক লম্বা, এবং চিকন। পাগুলোও কেমন জানি। শরীরে কাপড় নেই। তাতে কিছুই যায় আসেনা। আমরা মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীকে পোশাকে দেখে অভ্যস্ত নই।
ভয়ে সে পিছনে সরে গেল খানিকটা। এবং তখনই দেয়াল থেকে চারপাচটা হাত এসে তাকে জাপটে ধরলো। সে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু মুখে চেপে ধরা হাত কোন স্বর বেরোতে দিল না।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছে। বিষ্ফোরিত চোখে রানা ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে।
সে প্রাণপনে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছে, সে যা দেখছে সব একটি দুঃস্বপ্ন। নিশ্চই দুঃস্বপ্ন। একটু পরেই তার ঘুম ভাঙ্গবে। ধরফরে বুক নিয়ে সে জেগে উঠবে। বাম পাশে ফিরে থুথু ছিটিয়ে বলবে, "আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম!" তারপর ডান পাশ ফিরে শুয়ে পড়বে।
ছায়ামূর্তি যেন তার মনের কথা বুঝে ফেলল। একটা বাঁকা হাসি দিল মনে হয়। সে এগিয়ে আসছে। ভাসতে ভাসতে তার দিকে এগিয়ে আসছে।