somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"কোরবানির গল্প।"

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দুই ঈদের মধ্যে শিশু বয়সে কোরবানির ঈদটাই আমাদের কাছে বেশি প্রিয় ছিল। রোজার ঈদের কোন বিশেষত্ব ছিল না, নতুন জামাকাপড় পড়ে আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, বড়দের সালাম করে সেলামি পাওয়া এবং রাতে টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক, ইত্যাদি এবং আনন্দমেলা দেখা।
কিন্তু কোরবানির ঈদের মজায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হতো বাসায় গবাদি পশুর আগমনে। শহুরে সমাজে কেউ গবাদি পশু পালেন না। গরু ছাগল দেখতে হলে আমাদের গ্রামে যেতে হতো। তাই ঈদের আগের দুদিন পুরোদস্তুর রাখাল হয়ে যাওয়ার সুযোগ আসায় আমরা আনন্দে হারিয়ে যেতাম! কার গরু কারটার চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী, তাই নিয়ে চলতো বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগীতা।
"আমাদের গরুর শিং দেখেছিস? একদম 'তরোয়ালের' মত। তোদের গরুকে একটা গুতা দিলেই মাথায় ফুটা হয়ে যাবে।"
"আরে, তোদের গরুতো সাদা। আর সাদা মানে গাধা! আমাদের গরু কালো, কালো মানে ভাল।"
"হাহাহা। তোদের গরু রোগা! মাংস নাই! খালি হাড্ডি!"
"আর তোদের গরু বাট্টু! আমাদের গরু তোদেরটার উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাবে!"

আমাদের গরু কেনা হতো ঈদের একদিন কি দুদিন আগে। ঘাস, ভুষি, পানি খাইয়ে গরুর সেবা যত্নের কোন কমতি রাখতাম না। এই সেবা করতে করতেই গরুটিকে ভালবেসে ফেলতাম।
ঈদের দিন সকালে দেখতাম প্রতিটা গরুর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অবলা প্রাণীগুলো কিভাবে বুঝতো যে সেটাই তাদের জীবনের শেষ দিন? হুজুর বলতেন, ওরা নাকি আগের রাতে স্বপ্নে টের পায়। কে জানে! গরুকে প্রশ্ন করলেতো আর জবাব পাওয়া যাবেনা।
গরুর কান্না দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত। আব্বুকে গিয়ে অনুরোধ করতাম, এই গরু বাদ দিয়ে অন্য গরু কিনতে, ওটাকে কোরবানী করতে। আমরা এটাকে পালবো।
আব্বু আমাদের বোঝাতেন, কোরবানির ঈদে সবচেয়ে প্রিয় প্রাণীটিকেই কোরবানী করতে হয়।
সেই অর্থে আমাদের কোরবানী সফল বলতেই হয়। একদিনেই আমাদের অতি প্রিয় হয়ে উঠা পশুটিকে কোরবানির সময়ে আমাদের বুক কেঁপে উঠতো। আব্বুকেতো আমরা কখনই কোরবানির সময়ে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে দেখিনি। গলা কাঁটা পশুর ছটফটানির দৃশ্য তিনি নিতে পারতেন না। তিনি বাসায় বসে থাকতেন। জবাই শেষে মাংস কাটাকাটির সময়ে তিনি নিচে আসতেন।
আমরা দুই ভাই বাপের স্বভাব পাইনি। কোরবানির সময়ে আমরা নিজেরাতো উপস্থিত থাকতামই, এমনকি মাঝে মাঝে হুজুরের সাথে হাত মিলিয়ে আমরাই পশু জবাই করেছি। এটাই কোরবানির প্রকৃত নিয়ম। নিজের প্রিয় পশুটিকে নিজ হাতেই জবাই করে আল্লাহকে বলা, "আমার কাছে তোমার অপেক্ষা প্রিয় এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।"

এবারে কোরবানী নিয়ে আমাদের একটা পারিবারিক গল্প বলা যাক।
আমার বড় আব্বা, মানে আমার বাবার দাদা ছিলেন জমিদার মানুষ। রায়তরা তাঁর গোয়ালের গরু নিয়ে তাঁরই জমি চাষ করে ফসল ফলাতেন। তাঁর বাড়ির গোয়ালে জন্ম নেয়া একটা ষাঁড়ের স্বভাব ছিল খুবই আলসে। চাষীরা সেটাকে দিয়ে হালচাষ করাতে পারতো না, সে সুযোগ পেলেই মাঠে বসে জাবর কাটতো।
বড় আব্বা একসময়ে রাগ করে ষাঁড়টাকে বেঁচে দিয়েছিলেন। নতুন মালিক ষাঁড়টিকে নিয়ে চলে গেল।
পরেরদিন ফজর নামাজ পড়তে বড় আব্বা উঠে দেখেন বাড়ির উঠানে ষাঁড়টি দাঁড়িয়ে আছে। সে নতুন মালিকের গোয়াল থেকে দড়ি ছিঁড়ে দূরের পথ চিনে চলে এসেছে। তাঁকে দেখে সে 'হাম্বা' বলে একটা ডাক দিল। তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরছে। তিনি এসে ষাঁড়টিকে আদর করে দিলেন। সে গলা উঁচু করে আদর নিল।
সকাল হতেই নতুন মালিক এসে হাজির। বড় আব্বা তাকে কেনা টাকার চেয়েও খানিকটা বেশি দিয়ে ফিরিয়ে দিলেন। ষাঁড়টির ভালবাসার মূল্য তিনি রাখলেন। এরপর থেকে তিনি নিজ হাতে তাকে ঘাস খাওয়াতেন। ঘাস খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তার মাথায়, গলায় হাত বুলিয়ে দিতেন। ষাঁড়টিকে তখন দেখে মনে হতো এতে সে খুব আনন্দ পাচ্ছে।
এরপর বছর ঘুরে ঘুরে কোরবানির ঈদ এলো। আল্লাহ যেখানে নির্দেষ দিয়েছেন সবচেয়ে পছন্দের পশুটিকে কোরবান করতে, সেখানে বড় আব্বা তাঁর আদরের ষাঁড়টিকেই বেছে নিলেন। 'আল্লাহু আকবার' (আল্লাহ সর্বশক্তিমান) বলে ছুড়ি চালালেন ষাঁড়টির গলায়। ষাঁড়টি ছটফট করতে করতে মারা গেল।
সেই একটি মাত্র কোরবানির ঈদেই বড় আব্বা কোন মাংস খাননি। বরং বলা ভাল, খেতে পারেননি।

সবাইকে কোরবানীর ঈদের শুভেচ্ছা। অফিসের কাজের চরম ব্যস্ততায় কাউকে সময়মতো ঈদের শুভেচ্ছা দিতে পারিনি বলে দুঃখিত।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×