জাহের থান হচ্ছে প্রকৃতিপূজারী সাঁওতালদের প্রধান উপাসনাস্থল। ঠিক মসজিদ, মন্দির, গীর্জা বা প্যাগোডা’র মতো। জাহের থানের প্রধান আরাধ্য হচ্ছেন জাহের এঁরা। তবে তাঁর পাশাপাশি জাহের থানে আরো অধিষ্ঠিত থাকেন মারাঙবুরু ও মড়েকুতুরুইকু। মারাঙবুরু হচ্ছেন ঠাকুর আর ঠাকরান (ঈশ্বরের পুং ও স্ত্রী রূপ) এর প্রেরিত দেবদূত। যিনি সাঁওতাল দেব-দেবীদের মধ্যে প্রধান। আর মড়েকুতুরুইকো হচ্ছেন সাঁওতালদের আদি পিতা-মাতা পিলচু হাড়াম-বুডহির পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ে। যাঁদের মুত্যুর পরে তারাও বঙ্গা অর্থাৎ দেব-দেবী রুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
সাঁওতালদের গ্রাম পত্তনের সাথে জাহের থানের নিগূঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান। তাইতো সাঁওতাল জীবনে জাহের থানের গুরুত্ব অপরিসীম। সাঁওতালরা বরাবরই থুতি প্রিয়। তাইতো ‘পুথি খন থুতি গে সরসা’ অর্থাৎ পুথি বা বই এর ভাষা থেকে মুখের ভাষায় অধিক সুমিষ্ট এই কথাটি আমাদের পূর্বজনেরা ব্যবহার করতেন। এই জন্য সাঁওতাল সমাজের ইতিহাস, সংষ্কৃতির একটা বড় অংশ সাঁওতালরা গানে গানে চর্চা করে এসেছেন। সাঁওতালদের ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন বিষয়ে অথেনটিক তথ্যের জন্য প্রাচীন গানগুলোই এখন প্রধান অবলম্বন। এরকমই এক প্রাচীন সাঁওতালি বাহা গানে জাহের থান সম্পর্কে জানা যায়-
অকয়মায় চিয়ৗলেত হো বীর দিশৗম দ
অকয়মায় দহলেত আতোরে পৗঁয়ড়ি
মারাঙবুরুয় চিয়ৗলেত হো বীর দিশৗম দ
জাহের এঁরায় দহলেত আতোরে পৗঁয়ড়ি।
(জঙ্গলময় এ দেশ হো কে আবিষ্কার করেছিল? গ্রাম তৈরি করে বসতি কে গড়েছিল? মারাঙবুরু জঙ্গলময় এ দেশ আবিষ্কার করেছিল, জাহের এঁরা গ্রাম পত্তন করে বসতি গড়েছিল)
আমার বয়স যখন চার বছর বা তার একটু বেশি তখনকার কিছু ঘটনা আজো মনে আছে। দিনাজপুর জেলার পাবর্তীপুর উপজেলার বড়চন্ডীপুর বারকোনা গ্রামে (সিঞ্জৗটলা বা বীরটলা) আমাদের বাড়ির পূর্ব দক্ষিণ পার্শ্বে ছোট জঙ্গল ছিল। সেখানে আমি ছোটবেলায় আমার মারাম্বা, তালাবা (জেঠা) সহ গ্রামের লোকজনদের দেখেছি জঙ্গলের এক পার্শ্বে পূজা করতে। সেখানে একটা গাছ ছিল নাম মনে পড়ছে না যেটার ডালপালাগুলো কোঁকড়ানো ছিল। আমার বয়সের বন্ধুরা আমরা মাঝে মাঝে ঐ জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে সেখানে খেলাধূলাও করতাম। পরে বড় হয়ে জেনেছি জঙ্গলের ভিতরে যে জায়গায় গ্রামের সকলে পূজা করতো সেটাই হচ্ছে জাহের থান। এখন আর সেখানে আগের মতো কোন জঙ্গল নেই। জাহের থানও আর সেখানে নেই।
মূলত বাহা পূজাতেই জাহের থানে পূজা করা হয়। এছাড়া প্রয়োজনে বছরের যে কোন সময়েও দাঃ হিরিজ্ (মাটিতে জল ঢেলে প্রার্থনা) করে বিশেষ কোন প্রার্থনা করা হয়। যেমন পৃথিবীতে করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ার পর অনেক সাঁওতাল গ্রামের জাহের থানে জল ঢেলে বঁগাবুরুদের (দেবদেবী) কাছে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছিল। আমি গ্রামের অনেক প্রবীণদের কাছে শুনেছি অতীতেও যেমন বসন্ত রোগ যখন মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল তখনও সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে জাহের থানে ও মৗঞ্জহি থানে জল ঢেলে সেই বিপদ থেকে গ্রামের মানুষজন নাকি রক্ষা পেয়েছিল।
যাই হোক বারকোনার জাহের থান প্রসঙ্গে যাই। ২০২০ সালের আগে বারকোনা গ্রামে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোন জাহের থান ছিলনা। শুধু বারকোনা কেন? সারা বাংলাদেশেই কোন প্রতিষ্ঠিত জাহের থান ছিলনা। আসলে প্রতিষ্ঠিত বলতে আমি এখানে মসজিদ, মন্দির ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠিত কোন অবকাঠামোগত উপাসনা স্থানের কথা বলছি। সারাদেশের বিভিন্ন সাঁওতাল গ্রামে সরকারী কোষাগারের টাকায় বেশ কিছু মৗঞ্জহি থান নির্মাণ হয়েছে কিন্তু জাহের থানের মধ্যে বারকোনার জাহের থানই হচ্ছে প্রথম যেটি সরকারী টাকায় তৈরি হয়েছে। কয়েকবছরের চেষ্টায় এই জাহের থান নির্মাণ সফল হয়েছে। আসলে সাঁওতালদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব বাহা পরব ২০১৭ সাল থেকে বারকোনায় একটু বৃহৎ আকারে জাঁকজমকভাবে পালন শুরু হয়। যাতে এই উৎসবটি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় সেজন্য বাহা পরবের ধর্মীয় রীতিনীতির পাশাপাশি আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হয়। এতে দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে সাঁওতালি জনপ্রিয় সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যার ফলে বারকোনার এই বাহা উৎসবের প্রতি মানুষের আলাদা টান তৈরি হয়। এখন প্রতিবছর মানুষজনই খোঁজ নেয় কবে হবে বারকোনার বাহা পরব? এই বাহা উৎসব জাঁকজমকভাবে পালনের জায়গা থেকে বাহা পূজার পূজাস্থলও সুন্দর করে স্থায়ীভাবে বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় বাহা পরব উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাহা পরবের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বারকোনায় একটি জাহের থান নির্মাণের জন্য আবেদন করেন এবং সেটি গৃহীত হলে টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যায়ে জাহের থানের মূল অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন করে। যদিও এই পাঁচ লক্ষ টাকার শতভাগ ঠিকভাবে এই জাহের থান নির্মাণে ব্যায় হয়েছে কিনা সে সন্দেহ আমার ব্যক্তিগতভাবে রয়ে গেছে। এছাড়া সাঁওতালদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা চাননি এই জাহের থান তৈরি হোক। কিন্তু কারো কোন অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। যদিও এখনো জাহের থান এর বেশ কিছু কাজ বাকী রয়ে গেছে। ২০২১ সালের ২ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত বাহা পরবে এই প্রতিষ্ঠিত জাহের থানে প্রথমবারের মতো বাহা পূজা সম্পন্ন করেন নাইকে (পুরোহিত) রাইসন সরেন এবং এটির উদ্বোধন করেন রাজশাহীতে অবস্থিত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার শ্রী সঞ্জীব কুমার ভাটী। করোনা সঙ্কটের কারণে বাহা পরবের আয়োজন কিছুটা সীমিত থাকলেও আশেপাশের সাঁওতাল জনগণের সরব উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। তার উপরে ভারতীয় শিল্পীদের অনুপস্থিতিও আমাদের দেশীয় শিল্পীদের নজরকাড়া নৃত্য-গীতে ঢেকে গেছে। আমি মনে করি এইখানেই বাহা পরবের স্বার্থকতাও তৈরি হয়েছে। বাহা পরবের জৌলুস যেখানে হারাতে বসেছিল তখন বারকোনার এই বাহা পরব আবার সেই জৌলুস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আজ সাঁওতালসহ দেশের অপরাপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসহ বৃহত জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও বাহা পরব সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছে।
বারকোনার জাহের থান নির্মাণকে আমি সরকারী উদ্যোগ বলতে রাজি নয়। কেন বলছি না তার কারণ হলো সরকার নিজ উদ্যোগে সাঁওতালদের ধর্মীয় উন্নয়নের জন্য এখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বারকোনার জাহের থান নির্মাণে বারকোনাবাসীরা উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিল। সরকার সেই আবেদন অনুমোদন দিয়েছিল। তাই এটাকে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যদি সরকার সত্যিই উদ্যোগী হয় তাহলে খুব খুশী হবো। এদেশে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের জন্য ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট রয়েছে। কিন্তু এসব প্রভাবশালী ধর্মের বাইরে প্রকৃতিঘনিষ্ট যেসব ধর্ম রয়েছে সেগুলোর জন্য কোন ট্রাষ্ট নেই। তাই সেগুলোর জন্য কোন ধরনের বাজেট বরাদ্দও নির্দিষ্ট নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে ২ এর ক-তে রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গে বলা আছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।” সংবিধানে এই সুন্দর কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। প্রভাবশালী চার ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মগুলোর জন্য কোন ধরনের কোন কর্মসূচি রাষ্ট্র কখনো গ্রহণ করেছে বলে আমার জানা নেই। সাঁওতালদের মধ্যেই যারা ধর্মান্তরিত হননি তাদের প্রকৃতিঘনিষ্ঠ ধর্মের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ নেই। কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। আবার বিদ্যালয়েও সাঁওতাল শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে পড়তে হয় অন্য ধর্মের বই। এভাবেই প্রভাবশালী ধর্মগুলো আরো বেশী করে রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মগুলোকে কন্ঠরোধ করার জন্য প্রচ্ছন্নভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। দেশের সকল ধর্মের সমান উন্নয়ন তাই শুধু সংবিধানের ছাপার অক্ষরে জ্বলজ্বল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২১ দুপুর ১:২৪