সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে আমার সাথে সহআলোচক হিসেবে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতা সুবাস মুরমু। আমি আর সুবাস আগেই আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম যে সাঁওতাল সৃষ্টিতত্তটি সে গল্পের আকারে প্রথমে সবাইকে জানিয়ে দিবে। এরপরে অংশগ্রহণকারীদের সাথে আমি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আবারো বিষয়টিকে প্রকৃতি বিজ্ঞান এর সাথে একসূত্রে নিয়ে আসবো। সুবাস যখন খুব সুন্দরভাবে সাঁওতাল সৃষ্টিতত্তটি সবার মাঝে উপস্থাপন শুরু করলো তখন খেয়াল করলাম অংশগ্রহণকারীরা খুব মনোযোগের সাথে সেটি শুনছে এবং মনে হচ্ছিল তাদের মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে। সত্যিই দেখা গেল সুবাসের আলোচনার পরেই একের পর এক প্রশ্ন তারা করতে শুর করলো। সুবাস কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে বলল দাদা এবার আপনি শুরু করেন। আমার আলোচনার শুরতে আমি অংশগ্রহণকারীদের বললাম আপনাদের মাঝে কতজন সাঁওতাল সৃষ্টিতত্তটি আগে শুনেছেন বা পড়েছেন। শতাধিক তরুন-যুবদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত হাত উঠলো। যারা হাত উঠায়নি তাদের জিজ্ঞেস করলাম কেন তারা সৃষ্টিতত্তটি জানেনা। তাদের দুই তিনজনের কথা থেকে যেটি জানতে পারলাম তাহলো তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা কোন আত্মীয় স্বজনের কাছে তারা সৃষ্টিতত্তটি কখনো শোনেনি। আবার এই ধরনের কোন বই তাদের কাছে নেই যেটা পড়ে তারা জানতে পারবে। তাই তাদের বললাম আপনারা আজ যারা সুবাসের মুখে সৃষ্টিতত্তটি প্রথম শুনলেন তারা যেন সম্মেলন শেষে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে কোন বয়স্ক মানুষকে এ স্বমন্ধে জিজ্ঞেস করবেন এবং আমার সাথে যোগাযোগ করে এ সংক্রান্ত বই সংগ্রহ করে নিবেন। এরপরে তাদের প্রশ্ন করলাম আচ্ছা তাহলে সৃষ্টিতত্ত অনুসারে এই পৃথিবীতে মানুষ আগে আসলো নাকি অন্যান্য প্রাণ। তারা বলল জলজ প্রাণী প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে তারপরে মানুষ। তাদের এ উত্তরের প্রেক্ষিতে আমি তাদেরকে প্রাণের বিবর্তনের তত্ত কিছুটা বললাম। এরপরে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা মানুষের সৃষ্টির জন্য কি প্রয়োজন। তারা বলল একজন নর ও নারী প্রয়োজন। তাহলে প্রথম সাঁওতাল নর-নারী কে? তারা বলল সৃষ্টিতত্ত অনুসারে আমাদের প্রথম নর-নারী হচ্ছেন পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুডহি যাদের আমরা আদি পিতা-মাতা হিসেবে মানি। তখন আমি বললাম তাহলে আমাদের মধ্যেই অনেক সাঁওতাল এ কথাটিকে অস্বীকার করছে। পিলচু হাড়াম বুডহিকে অস্বীকার করছে। এটা কি ঠিক? তাদের উত্তর ছিল ঠিক নয়। আমি তাদেরকে আরো বললাম এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম বা প্রকৃতি বিজ্ঞান। মানুষের নতুন প্রাণের জন্য একজন নর ও একজন নারী আবশ্যক। আমাদের সৃষ্টিতত্তের বর্ণিত কাহিনী প্রকৃতি বিজ্ঞানকে সমর্থন করে। আর যারা এটাকে শুধু গল্প বা কল্পতত্ত বলছেন তারা হয়তো প্রকৃতি বিজ্ঞানতত্ত জানেন না বা বোঝেননা। তাদেরকে আরো বললাম এই পিলচু হাড়াম-বুডহিরাই আমাদের সমাজ, সমাজের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি তৈরি করে গেছেন। সুতরাং তাদেরকে অস্বীকার করা মানে হচ্ছে সাঁওতালিত্তকে অস্বীকার করা। আমার আলোচনার শেষের দিকে তাদেরকে বললাম সাঁওতাল সমাজের সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য তাই নিজের শেকড়কে ভুললে হবেনা। বরং এগুলো স্মরণে রেখে এবং পিলচু হাড়াম বুডহির তৈরি করে যাওয়া রীতিনীতি, আচার-অনুষ্টানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের ভবিষ্যত নির্মাণ করতে হবে। নইলে সময়ের ¯্রােতে আমরা হারিয়ে যাবো। পৃথিবীতে বহু সভ্যতা, বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে চর্চার অভাবে ও শ্রদ্ধার অভাবে। আমাদের মধ্যেও যারা নিছক অনীহার কারণে, রাজনৈতিক কারণে, ধর্মীয় কারণে, পরিবেশের কারণে পিলচু হাড়াম বুডহিকে অস্বীকার করছে তারা ইতিমধ্যে অনেক কিছু হারিয়েছে। একসময় দেখা যাবে তাদের মধ্যে সাঁওতাল পরিচয় দেবার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। এভাবেই হয়তো পৃথিবীর অনেক জাতি হারিয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের অনেক রীতিনীতির সংস্কার প্রয়োজন আছে। পরিশেষে তাদেরকে বললাম আমরা সাঁওতালরা বর্তমানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। এ থেকে যদি আমরা উত্তোরণ ঘটাতে চাই তাহলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া কোন উপায় নেই। তবে শুধু শিক্ষা অর্জন করে নিজের বাড়ি-গাড়ি করলে, আরাম আয়াসে শুধু দিনযাপন করলে সমাজের উন্নয়ন হবেনা। সমাজের তথা জাতির উন্নয়নের জন্য নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে লালন-পালন চর্চা ও শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। একটি গাছ যেমন তার শেকড় ছাড়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা ঠিক একটি জাতিও তার সংস্কৃতি, ইহিতাস, ঐতিহ্য ভুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেনা।
আমার আলোচনার পরেই দুপুরের ভাত খাওয়া হলো। এরপরে আমার ফেরার পালা। অফিসেও কিছু কাজ ছিল। কিন্তু কেন জানি পুরো সম্মেলনটিতে থাকতে ইচ্ছে করছিল। তাই অফিসে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম আর সম্মেলন আয়োজকদেরও জানালাম যে আমি সম্মেলনের অন্যান্য অধিবেশনগুলোতে দর্শক হিসেবে থাকতে পারবো কিনা? আয়োজকরা সাদরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো। পরে বিকালে তিনটি দল আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামে মাঠ পরিদর্শনে গেল। আমিও গেলাম একটি দলের সাথে। তাদের পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল সাঁওতালদের সামাজিক বিচার কাঠামোর বর্তমান অবস্থা। মুকুন্দপুর থেকে প্রায় সাত বা আট কিলোমিটার পশ্চিমে বিক্রমপুর গ্রামে তাদের সাথে গেলাম। সেখানে গিয়ে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমে গোটা গ্রাম ঘুরে দেখল। এরপরে গ্রামের মৗঞ্জহি পরিষদের সদস্যসহ গ্রামের মানুষজনের সাথে সামনাসামনি এক আলোচনায় বসলো। এসময় জানা গেল ঐ গ্রামে প্রায় ৭০টি পরিবার বসবাস করে। সেখানে তিনটি পৃথক মৗঞ্জহি আছে। এর কারণ যখন তরুন-যুবরা জানতে চাইল তখন গ্রামবাসীরা বলল যে ধর্মের ভিত্তিতে সে গ্রামে তিনটি পৃথক মৗঞ্জহি হয়েছে। একটি মৗঞ্জহি হচ্ছে সৗরি সারনা অর্থাৎ যারা এখনো পিলচু হাড়াম বুডহির শিখিয়ে যাওয়া রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাসকে লালন পালন ও চর্চা করছে। আরেকটি মৗঞ্জহি হলো যারা ক্যাথলিক চার্চ এর আওতাধীন তারা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে লুথারেন চার্চ এর অধীন। এসময় তরুন-যুবদের অনুসন্ধিৎসা মন একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসলো। যেখানে তারা বলল একই গ্রামে তিনটি পৃথক মৗঞ্জহি কি সাঁওতালদের গ্রাম্য ঐক্যকে এবং তাদের শক্তিতে নষ্ট করছেনা? উত্তরে গ্রামের লোকজন জানালো যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শক্তি, সাহস কমে যাচ্ছে কারণ স্পষ্টতই এখানে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ, বিশ্বাস নিয়ে আমরা যার যার মৗঞ্জহি পরিচালনা করছি। তবে আমরা একে অপরের সকল অনুষ্ঠানে, বিপদে আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করি। এরপরে তরুনদের পক্ষ থেকে আরেকটি প্রশ্নে তারা জানতে চাই যে বর্তমানে যে তিনটি মৗঞ্জহি আছে তারা কি কখনো স্থানীয় সরকারের সাথে কোনভাবে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলে না তারা কখনো এটা চেষ্টা করেনি। এরপরে তারা জিজ্ঞেস করে মৗঞ্জহি পরিচালনার জন্য তাদের কি কোন লিখিত আইন আছে? এর উত্তরেও তারা না বলে। আরেকটি প্রশ্নে তারা জানতে চায় ভবিষ্যতে মৗঞ্জহি পরিষদের সরকারী স্বীকৃতির জন্য তাদের কোন কর্মসূচি থাকবে কিনা? এর উত্তরে তারা বলে আমরাতো এরকম কখনো ভাবিনি। আমাদের সাঁওতাল নেতারা, বড় বড় চাকুরীজীবীরাও আমাদের এরকম কোন বুদ্ধি দেইনি। এসময় তারা স্বীকার করে যে মৗঞ্জহি পরিষদগুলোর সরকারী স্বীকৃতি প্রয়োজন। তরুন-যুবদের পক্ষ থেকে আরেকটি প্রশ্ন করা হয়। তারা জানতে চায় যে কখনো যদি সরকার প্রতি সাঁওতাল গ্রামে একটি করে মৗঞ্জহিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয় তাহলে বিক্রমপুর গ্রামের তিনটি মৗঞ্জহি কিভাবে তাদের মধ্যে সমন্বয় করবে বা তারা তখন একত্রে একটি মৗঞ্জহি করবে কিনা? এর উত্তরে সৗরি সারনা অনুসারীরা বলে আমরাই যেহেতু মূল সাঁওতাল সেক্ষেত্রে আমাদের মৗঞ্জহিকে সরকারকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর অন্য দুই মৗঞ্জহির সদস্যরা আলোচনার শুরুর দিকে থাকলেও সেসময় উপস্থিত না থাকায় তাদের উত্তর জানা যায়নি। এরমধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। তাই অংশগ্রহণকারীরা গ্রামের লোকজনের সহযোগিতা ও তথ্যের জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয়।
সেখান থেকে ফিরে এসে অংশগ্রহণকারীরা তাদের অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরে। অন্য দুটি দল যাদের একটির বিষয় ছিল সাঁওতাল সংস্কৃতি ও অন্যটির ছিল সাঁওতালদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা তারাও তাদের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সকলের সামনে উপস্থাপন করে। এরপরে রাতের খাবার সেরে তারা সকলে মিলে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করে। এখানে খেয়াল করলাম অংশগ্রহণকারীরা যেসব নাচ, গান উপস্থাপন করলো সেগুলো সবগুলোই ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান ছিল।
সম্মেলনের শেষ দিনে শিক্ষা ও চাকুরী বিষয়টিকে প্রাধান্য করে তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সাঁওতাল নারী শিক্ষা, আইসিটি ও কারিগরী শিক্ষা এবং ভাষা ও বিশ্বায়ন। এরপরে সমাপনী অধিবেশনের পূর্বে তরুন-যুবদের সকলের সম্মতিতে আয়োজক সংগঠন বাংলাদেশ সাঁওতাল যুব সংঘের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নব নির্বাচিত নেতৃবৃন্দরা তাদের অভিব্যক্তিতে শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি সাঁওতাল সমাজ, সংস্কৃতির উন্নয়নের অঙ্গীকার করেন। সম্মেলনে দিনাজপুর অঞ্চলের তরুন-যুবদের অংশগ্রহণ বেশী থাকলেও উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলা থেকেও কিছু সংখ্যক তরুন-যুবদের উপস্থিতি ছিল। তাদের অনেকের সাথে ব্যক্তিগত আলাপকালে জানতে পারলাম তাদের অনেকেই নিজ সমাজ সংষ্কৃতি নিয়ে খুববেশী গভীরভাবে সেভাবে আগে ভাবেনি। তবে তারা সম্মেলনে এসে অনুধাবন করেছে যে নিজ সমাজের উন্নয়নের জন্য তাদেরকেই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে যেমন ভালো রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে হবে তেমনি নিজ সংষ্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও চর্চা করতে হবে। নইলে আগামীতে সাঁওতাল জাতি বলে কিছু থাকবেনা।
সবশেষে সমাপনী অধিবেশনে আগত অতিথিরাও তাদের বক্তব্যে তরুন-যুবদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি সাংগঠনিক যুক্ততার মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাঁওতাল সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে আহ্বান জানান। সম্মেলনের আলোচনার বিষয়বস্তু ও কর্মসূচি দেখে সার্বিকভাবে আমার মনে হয়েছে আয়োজকরা গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন যে বর্তমান সাঁওতাল সমাজে অদৃশ্য এক ফাটল তৈরি হয়েছে। এই ফাটল এখনি মেরামত না করলে জাতির একটি বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। হুল অর্থাৎ বিদ্রোহের মাসে বাংলাদেশ সাঁওতাল যুব সংঘের এ সম্মেলন সাঁওতাল সমাজ, সংষ্কৃতি রক্ষা ও সাঁওতালদের সার্বিক উন্নয়নে যেন নতুন এক হুলের সূচনা করলো। এ হুলের বিজয় হোক ও সম্মেলন আয়োজকদের যাত্রা মঙ্গলময় হোক।
মানিক সরেন
২৩ জুন ২০১৮, দিনাজপুর।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৪