----------------------
ফেসবুকে মাঝে মাঝে হড় বাপলা (সাঁওতাল বিয়ে) এর অনেক ছবি দেখি, কেউ আবার ভিডিও দিয়ে শেয়ার করে লিখে দেয় যে এটা হলো হড়দের বিয়ে। ছবি, ভিডিওগুলোতে ক্যাপশনসহকারে অনেকসময় বর্ণনাও থাকে যা মাঝে মাঝেই আমার নজর কাড়ে। শুধু বিয়ে বিষয়টায় যদি দেখি তাহলে দেখা যায় হড় সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। হড়দের ঐতিহ্যগত বিয়ের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে কিছু পরিবর্তন একেবারেই শেকড় থেকে ছিন্ন হয়ে গেছে। সম্প্রতি একজনের সাথে বাপলা (বিবাহ) প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে আমাকে উসকে দিলো হড়দের বিবাহ নিয়ে লিখতে। প্রথমত এ লেখায় মূলত হড় সমাজে কি কি ধরনের বিবাহের প্রচলন আছে বা ছিল সেটা বলার চেষ্টা করবো এবং দ্বিতীয়ত হড়দের বিবাহ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
হড় সমাজে অনেক ধরনের বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন ‘আছে বা ছিল’। আছে বা ছিল এজন্যই বলছি কেননা এখন অনেকগুলো আছে আবার অনেকগুলো নাই আবার কতকগুলো জগাখিচুড়ি (মিশ্র) হয়ে গেছে। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের লেখা হড় বাপলা সেরেঞ পুথি গ্রন্থের ১নং পৃষ্ঠায় হড়দের ৮ প্রকার বিবাহ পদ্ধতির কথা আছে: (১)সাডৗই বাপলা বা দুয়ৗর সিন্দুর বাপলা (২)টুঙকি দিপিল বাপলা (৩) ঞির বলঃ বাপলা (৪) অর আদের বাপলা (৫) ঘর জাঁওয়ায় বাপলা (৬)ঘৗরদি জাঁওয়ায় বাপলা (৭) ইপুতুৎ বাপলা (৮)চৗউডৗল বাপলা। হড়কোরেন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কাথা গ্রন্থের ১১৩ পৃষ্ঠায় ডোল বাপলাসহ ছুটকিজঙ বাপলার কথা জানতে পারলাম যা ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের গ্রন্থে ছিলনা। এছাড়াও http://www.santhaledisom.com এ হড়দের আরো বেশ কিছু প্রকারের বিয়ের কথা পাওয়া গেল, যথা: সাঙ্গা বাপলা, কাদাম বাপলা, কিরিঞ বাপলা, উপাগির বাপলা, টুঙকি দিপিল বাপলা, ইতুৎ বাপলা, ঞির বলোঃ বাপলা, দিকু বাপলা, সাঙ্গে বৗরিয়ৗত, হাড়াম বৗরিয়ৗত, ঘৗরদি জাঁওয়ায়। এতো গেল বই পুস্তকের কথা। এর বাইরে যাদের সাথে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আলাপ হয়েছিল তার মধ্যে ফিলিপ হেমব্রম, রমেশ হাঁসদা, চিনি হাঁসদা, বাসন্তী মুর্মু উনারা আরো কিছু বিয়ের কথা বলেছেন তারমধ্যে হলো: হরোঃ বাপলা, দৗউড়ৗ বাপলা, পৗটিয়ৗ বাপলা, থৗরি বাপলা, কুম্বৗ উয়ুং ইত্যাদি। এখানে অনেকগুলো বিবাহ পদ্ধতির কথা জানতে পারলাম তবে সন্দেহ আছে এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর নাম হয়তো এলাকাভেদে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বা নতুন নামকরণ প্রচলন হয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে অর আদের বাপলা ও চৗউডৗল বাপলা পদ্ধতি হড় সমাজে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারন অর আদের বাপলা পদ্ধতিতে একজন হড় নারীর বর পছন্দ করার অধিকার খর্ব হয়েছে। একসময় ছিল হড় অবিবাহিত ছেলে কোন অবিবাহিত মেয়েকে পছন্দ করলেই তাকে জোর করে সিঁদূর দিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতো। এক্ষেত্রে হড় মেয়েটি ও তার পরিবারের আর বিয়েতে রাজি না হওয়ার কোন উপায় থাকতোনা। হড় সমাজে অর প্রথা নামে এটি বেশ পরিচিত ছিল। বিষয়টি বর্বর ও নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বলে বর্তমান হড় সমাজ থেকে এ প্রথা উঠে গেছে। চৗউডৗল বাপলা পদ্ধতির আবিষ্কারই হয়েছিল হড় নারী-পুরুষের নিষিদ্ধ সম্পর্ককে সিদ্ধ করার জন্য, তাই এ পদ্ধতিটিই এখন নিষিদ্ধ করার জোর দাবি উঠছে। কেননা হড় সমাজে প্রচলিত আছে একই পদবীর অধিকারী নারী-পুরুষেরা একে অপরের ভাই বোন, তাই তাদের মধ্যে বিবাহ হতে পারবেনা। যারা এই রীতিনীতিকে অবজ্ঞা করেছে সমাজ তাদের বিবাহকে সমাজ সিদ্ধ করার জন্যই মূলত চৗউডৗল বাপলার প্রচলন করেছিল। তবে এর মধ্য দিয়ে নারী অথবা পুরুষ যেকোন একজনকে পদবী পরিবর্তন করতেই হতো। যেহেতু পদবী পরিবর্তন করেই বিবাহ হয় তাই একই পদবীর অধিকারী ছেলে মেয়েদের এ ধরনের কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এরূপ বিয়ের প্রচলন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করাই শ্রেয় বলে সিংহ ভাগ হড় মনে করেন।
স্থানভেদে, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক, ধর্মীয় পরিস্তিতিভেদে হড় বিয়েতে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এমন কিছু পরিবর্তন যা একেবারেই হড় সংস্কৃতির শেকড়কে বিচ্ছিন্ন করে হয়েছে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনাচরন পরিবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু শেকড়কে বা মৌলিকতাকে বিচ্ছিন্ন করে যে পরিবর্তন তা কি হড় সমাজের স্বাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবে? হড় সমাজে অর প্রথা বিষয়টি আগেই আলোচনা করেছি। এখানে যে পরিবর্তনটা ঘটে গেছে তা কিন্তু সমাজকে আরো মানবিক এবং নারীর অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই পরিবর্তনকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু হড়দের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে যখন নাকি ধর্মীয় অনুশাসন মানতে গিয়ে গীর্জায় ফাদার এর হাত ধরে বা হিন্দু শাস্ত্রমতে ব্রাম্মণ পুরোহিতের মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বিয়ে হচ্ছে তখন কি হড় সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা থাকছে? সম্ভবত এই ধরনের বিবাহকেই http://www.santhaledisom.com এ দিকু বাপলা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও হড় খ্রিস্টান ক্যাথলিকরা খ্রিস্টীয় ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি হড় বিবাহ সংস্কৃতির মৌলিক কিছু কিছু নিয়ম পালন করে যা আদতে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি করে। আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে তখনই যখন নাকি ধর্মীয় অনুশাসনের কারনে হড় জাতি হয়েও একজন নারী বা পুরুষ আরেকজন হড় নারী বা পুরুষকে বিয়ে করতে পারেনা। অথচ অন্য কোন জাতির নারী বা পুরুষকে বিয়ে করতে পারে। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা যাক: ধরা যাক একজন হড় নারী যে হয়তো ধর্মান্তরিত হয়নি, সে কিন্তু ধর্মান্তরিত কোন ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলেই বিয়ে করতে পারছেনা। এজন্য তাকে ধর্ম ত্যাগ করে ছেলের ধর্ম গ্রহণ করে তারপরেই বিয়ে করতে হচ্ছে। আবার একই ধর্মের হওয়ার পরেও ডিনোমিনেশন (শ্রেনী) বিভিন্ন হওয়ার কারনে বেশীরভাগ সময় বিয়েও করতে পারছেনা। হড়দের মধ্যে একই পদবীতে বিয়ে হয়না যেটা আগেই একবার বলেছি। কোন ছেলে-মেয়ে তারপরেও ভুল করে বসলে সমাজ এটিকে সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছিল। এজন্য ছেলে বা মেয়ে যেকোন একজনের পদবী পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। তবে সর্বোপরি এটিকে এখন নিরুৎসাহিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আবার কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জোর করে নারীরা স্বামীর পদবী নিজের পদবীর পেছনে ব্যবহার করছেন। যেখানে একই পদবীর ছেলে-মেয়েদের বিবাহই নিষিদ্ধ বলে গণ্য হচ্ছে সেখানে কেন আবার হিন্দু রীতির নকল করে হড় নারীকে তার স্বামীর পদবী নিতে হবে? প্রথাগতভাবেই যেখানে একই পদবীর ছেলে-মেয়েরা ভাই-বোন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যার আসলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে তাহলে কেন এরূপ অপচেষ্টা?
হড়দের জীবনাচরণ প্রকৃতিনির্ভর। তাইতো হড়দের বিয়েও প্রকৃতিকে স্বাক্ষী রেখেই সম্পন্ন করতে হয় বলে রাতের বেলা হড়দের বিয়ে কখনই হয়না। বংশপরম্পরায় হড়রা বিশ্বাস করে রাতের বেলা প্রকৃতিও বিশ্রাম নেয়, ঘুমিয়ে থাকে। তাই দিনের আলোতে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে প্রকৃতিকে স্বাক্ষী রেখে বিবাহ নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। হড় গানেও যার প্রমাণ মেলে-
বেডায় রাকাপকান জিরিহিরি
পূবাৎ সাদমরে যুগের তিরি,
সারজম সাকামরে কিয়া
সিন্দুর লাঠা আদিঞায় আঁদুর মাদুর।
(হড় বাপলা সেরেঞ পুথি গ্রন্থ থেকে গানটি নেওয়া)
পরিশেষে বলবো অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের সুরে তাল মিলিয়ে হড় জাতিকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে একটি গাছ তখনই হাজার মাইল বেগে ছুটে চলা বাতাসেও শক্তভাবে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকতে পারে যখন তার শেকড় মাটির অনেক গভীরে থাকে।
(হড় হপনদের আরো কোন প্রকার বাপলা বাদ পড়ে গেলে কমেন্টে জানাবেন। লেখার কোন অংশের সাথে কারও দ্বিমত এবং কোথাও কোন অসঙ্গতি থাকলে তা যাচাই সাপেক্ষে সংশোধনযোগ্য)
১৯ আগস্ট ২০১৬, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৭ রাত ১১:১৬