---------------
গত ৯ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে রাত প্রায় ১১টার দিকে দাদু’র বাড়িতে পৌঁছালাম। সাথে ছিল দুলাভাই। পরেরদিন গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এর দখল হওয়া হড় ও গরীব কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পদযাত্রা ও সমাবেশ কর্মসূচি ছিল। সেই কারনেই যাওয়া। আগেরদিন উপজেলার গাড়ঘুটু গ্রামে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাওয়ায় দাদু’র সাথে আর সেদিন দেখা হয়নি। দাদু ঘুমিয়ে গিয়েছিল। একেবারে পরের দিন সকালে দেখা হলো। দাদু’র সাথে যখনই দেখা হয় তখনই কিছু না কিছু গল্প দাদু’র মুখ থেকে শুনতে পাই। এইবারও ব্যতিক্রম হলোনা। সকালে উঠে ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে দাদু, আমি আর দুলাভাই গরম গরম ভাত খেতে বসলাম। ভাত খেতে খেতেই কিভাবে জানি হাড়িয়া প্রসঙ্গ নিয়ে কথা উঠলো। এখানে বলে রাখি দাদু কিন্তু হাড়িয়া খাননা এবং যারা হাড়িয়া খায় তাদেরকে খুব একটা পছন্দও করেনা।
- দাদু বলে উঠল হাড়িয়া খেয়ে কি হবে? হাড়িয়া খেলেই মানুষ মাতলামি করে। গন্ডগোল করে। সব কিছু ভুলে যায়।
তখন আমি বলে বসলাম, আচ্ছা দাদু তুমি কখনও হাড়িয়া খাওনি?
- খেয়েছি রে খেয়েছি। একসময় খুব খেয়েছি। একটা ঘটনার পর থেকে আর খাইনা। এখনো অনেক জায়গায় বেড়াতে গেলে অনেকে খাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে কিন্তু আমি খাইনা।
তো ঘটনাটা কি দাদু? কি হয়েছিল যে হাড়িয়া খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিলে?
- দাদু বলা শুরু করলো, অনেকদিন আগে যখন আমি হাড়িয়া খেতাম, একবার বাড়ি থেকে আত্মীয়ের বিয়ে খাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। তোর দাদী বাড়িতেই থেকে গেল। আমার সাথে গেলনা। তো আমি ওই আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশ মজা করলাম। হাড়িয়া খেলাম। নাচ-গান করলাম, তুমদাঃ (মাদল)-টামাক (নাগড়া) বাজালাম, ওখানেই তিনদিন চলে গেল।
এরপর আরেক আত্মীয় বলল তার অমুক অমুকের অমুক আত্মীয়ের বিয়ে আছে। সে একটু জোর করাতে তারসাথে সেখানেও চলে গেলাম। আবার শুরু হলো হাড়িয়া খাওয়া। সেখানেও দুদিন থাকলাম। হাড়িয়া এতই খাইতাম যে মাঝে মাঝে ভাত খাওয়ার কথাও মনে থাকতোনা।
তারপর আবার এক জায়গায় মেলা ছিল। সেই মেলা দেখতে গিয়ে যেখানে মেলা হচ্ছিল তার পাশের গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে ঢুকলাম। মেলা উপলক্ষে ওখানেও সবাই ঘরে ঘরে হাড়িয়া রেখেছিল। তো কি আর করা। আবার শুরু হলো মেলা উপলক্ষে হাড়িয়া খাওয়া। এরপর ভাবলাম বেশ কয়েকদিনতো হয়ে গেল এবার বাড়ি ফেরা যাক।
বাড়ির পথ ধরতেই মাঝপথে পরিচিত একজনের সাথে দেখা। সে বলল তাদের গ্রামে ফুটবল খেলা হচ্ছে। তো ফুটবলের একটু নেশা ছিল, যুবক থাকতে বেশ ভালো ফুটবলও খেলতাম । তাই লোভ সামলাতে পারলামনা। ফুটবল খেলা দেখতে চলে গেলাম। হড় গ্রামের পাশেই মাঠ। দুই দিনের খেলা ছিল। তাই ভাবলাম খেলা দেখেই সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবো। এখান থেকেতো বাড়ি বেশী দূরে নয়। তা ওই গ্রামেও আত্মীয় থাকার সুবাদে ওখানেই রাত্রে থাকলাম। পরেরদিন বিকালে ফাইনাল খেলা শেষ। ওই গ্রামের ছেলেরাই ফাইনাল জিতেছে। তাই আত্মীয়রা আমাকে আর ছাড়লোনা।
যার বাড়িতে ছিলাম তার দেওয়ানি বলল- আমাদের ছেলেরা জিতেছে। আজতো খুশির দিন। একটু ভালো মন্দ খাওয়া হবে। আজ বরং না গিয়ে কাল সকালেই বাড়ি চলে যেও।
- কি আর করা। আবারো থেকে গেলাম। ভাল খাবার বলতে আবারো ওই হাড়িয়া। হাড়িয়া খেতে খেতে প্রায় ভোর। তখন মাতালের ঘোরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরেরদিন বেলা যখন হলো তখন প্রায় দুপুর। বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে গেল। তাই তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
ঠিক বের হবো তখন বাড়ির দেওয়ানি একটু করে ভাত খেয়ে যেতে বলল। ঘুম থেকে উঠার পরেই ক্ষুধা লেগেছিল তাই আমিও আর না করলামনা। গরম ভাত খেয়ে নিলাম।
খাওয়া শেষে দেওয়ানি আবার বলল, গতকালের হৗন্ডি (হাড়িয়া) একটু আছে তো, পরে আবার কবে আসবা, একটু খেয়ে যাও। আমিও আর না করতে পারলামনা। একটু খাব ভেবেছিলাম কিন্তু খাইতে খাইতে বেশ ভালোই খেয়ে নিলাম।
তারপর কোনমতে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। বাড়ির যতো কাছে আসছি ততই মাথাটা ঘুর ঘুর করছে। ওইভাবেই কোনমতে টলতে টলতে গ্রামে যখন আসলাম তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল।
ওইসময় গ্রামে একটাই নলকূপ ছিল। সবাই ওই এক নলকূপেরই জল খেতাম। আমি তখন ওই নলকূপের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে পা পিছলে ওখানেই পড়ে গেলাম। পড়ে যাওয়ার পর মাথাটা যেন ঘুরপাক খেতে লাগলো। এদিক কখন কখন হাড়িয়া বাবাজি আমাকে খুব করে চেপে ধরেছে টেরই পেয়েছিলামনা। যখন উঠে দাড়াতে গেলাম তখন বুঝলাম আমি উঠতে পারছিনা। ভাবলাম কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে গায়ে শক্তি আসবে তখন উঠে যাবো।
হাজার রকম চিন্তাও মাথায় ঢুকছে। বাড়ি গিয়ে তোর দাদী’কে কি বলবো? কোথায় ছিলাম এতোদিন, কি করলাম? এসব অনেক কিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। চোখ দুটাও কেন জানি একটু একটু করে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। এসময় হঠাৎ দূরে একটা ছায়া নজরে আসলো। একটু কাছে আসতেই তোর দাদী’র গলার স্বর বুঝতে পারলাম। আমি ভয়ে ওইভাবেই শুয়ে থাকলাম। তোর দাদী কাছে আসতেই আমাকে দেখে বলা শুরু করলো-
আরে এইটা কে? কে এখানে এভাবে শুয়ে আছে?
- তারপর কিছুক্ষণ কোন কথা শুনতে পেলামনা, আবারো কিছুক্ষণ পরে তোর দাদী বলে উঠলো
অকারেন নুই অৗন্ডিয়া সেতা নডে হেচকাতেচ্ এ গিতিচ আকানা? [কোথাকার কুকুর (ছেলে কুকুর) এখানে এসে শুয়ে আছে?]
ঠুঙরৗতে কুটৗম কাতেচ্ ইঞ্চ লাগা কায় লেগে! (দেখি দেখি ঠুঙরা দিয়ে পিটিয়ে একে এখান থেকে তাড়িয়ে দিই)
- তোর দাদী’র মুখে এসব শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আসলেইতো আমি একটা কুকুর বটে। কুকুর না হলে কি বাড়ির কথা ভুলে যেতাম। বাড়ির লোকজন কি খাচ্ছে না খাচ্ছে কিভাবে দিন কাটাচ্ছে এগুলোওতো আমি গত এক সপ্তাহ ভুলে ছিলাম। এসব ভাবতে ভাবতেই কোনমতে আমি তোর দাদী’কে বললাম, এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার খুব ক্লান্ত আর খারাপ লাগছে। আমাকে একটু স্নান করিয়ে দাও। মনে হয় আমার করুন কন্ঠস্বর শুনে তোর দাদী আর রাগ না দেখিয়ে আমাকে টেনে নলকূপের কাছে নিয়ে গেল। এরপর জল ঠেসে কয়েক বালতি জল ঢেলে আমাকে স্নান করিয়ে দিল। ঠান্ডা জল গায়ে লেগে বেশ আরাম লাগলো আর মাতাল মাতাল ভাবটাও অনেকখানি চলে গেল। এরপর গামছা দিয়ে গোটা গা মুছে তোর দাদীর হাত ধরে বাড়ি গেলাম।
- বাড়ী পৌছেঁই আমি তোর দাদী’কে বললাম বিছানাটা একটু করে দাও। আমি ঘুমাবো। আমার কথা শুনে তোর দাদী তাড়াতাড়ি আমাকে বিছানা করে শুইয়ে দিল।
- কখন ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই। পরেরদিন যখন ঘুম ভাঙলো তখন তোর দাদী আমাকে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বলল। আমি হাত মুখ ধোয়া মাত্রই গরম গরম ভাত-তরকারি বেড়ে দিল। আমি চুপ করে খাওয়া শেষ করে ফেললাম। তোর দাদীও আমার সাথে সাথে ভাত খেয়ে নিল। কিন্তু দুজনেই চুপ করে ছিলাম। খাওয়ার সময় তোর দাদীর সাথে কোন কথায় ওইদিন হয়নি।
- খাওয়া শেষে আমি তোর দাদীকে বললাম এইযে কয়েকদিন হাড়িয়া খেলাম, এটাই শেষ। তোমাকে কথা দিচ্ছি আজকে থেকে জীবনে আর কোনদিন হাড়িয়া ছুবোনা, খাবোনা।
- একথা বলেই দাদু আমাকে বলল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি আর হাড়িয়া খাইনি।
দাদুর গল্প শুনতে শুনতেই আমি আর দুলাভাই ভাত খাওয়াও শেষ করে ফেললাম।
ওদিকে ৯টায় বাগদা কাটামোড় থেকে পদযাত্রা শুরু হবে মনে করতেই শালা-দুলাভাই আর দেরি করলামনা।
দাদু’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে চড়ে রওনা হয়ে গেলাম কাটামোড়ের উদ্দেশ্যে।
বি.দ্র. উপরোক্ত আলাপসহ এখন পর্যন্ত করা দাদু’র সাথে সব আলাপ হড় দিয়েই হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:২১