সমতলের একজন আদিবাসীর জন্য গত বছরে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১০০ টাকা। একজন মানুষের জন্য বরাদ্দ এই টাকা কি যথেষ্ট? এটা দিয়ে কি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ¬আদিবাসীদের সত্যিকার উন্নয়ন হবে? সহজেই অনুমেয় যে এইরকম বরাদ্দ দিয়ে আদিবাসীদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবেনা। খুবই দুঃখের বিষয় যে গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটেই একই রকম চিত্র দেখা যায়। ২জুন বৃহস্পতিবার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষিত হবে। নিশ্চয় গত অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেট আরো বৃদ্ধি পাবে। আদিবাসীদের জন্য বাজেটে যেন বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় তার জন্য গত কয়েকবছর ধরে আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। জানিনা অর্থমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের এই দাবিগুলো শুনেছে কিনা? যদি শুনে থাকে তাহলে কিছুটা হলেওতো বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়া কথা। এখন দেখা যাক সত্যিকার অর্থেই আদিবাসীদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় কিনা?
বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মোট জনসংখ্যার মধ্যে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক। সে অনুযায়ী বলা যায়, আদিবাসী জনসংখ্যা এদেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ২%। সে হিসেবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৩ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে তাদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশী বরাদ্দ হওয়ার কথা ছিল। এটি জনসংখ্যা অনুযায়ী অংকের হিসাব। যেহেতু আদিবাসীরা নানাকারণে শোষণ, বৈষম্য ও মানবসৃষ্ট দরিদ্র ও বঞ্চনার শিকার, তাই বরাদ্দ শতকরা হিসাবের বাইরে আরো বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ে ( যেখানে আদিবাসীদের জন্য একটি অংশ বরাদ্দ থাকে) ৭৭৯ কোটি টাকা আর সমতলে মাত্র ২০ কোটি টাকা। এ বাজেটে সমতলের একজন আদিবাসীর ভাগে পড়ে মাত্র ১০০ টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ আপাত চোখে বেশী মনে হলেও আদতে সেরকমটি নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেখানকার অধিবাসীদের জন্য যে বাজেট হয় তা কিন্তু সবটাই আদিবাসীদের জন্য নয়। সেখানকার সব অধিবাসীরাইতো আর আদিবাসী নয়।
তবে কম হোক বেশী হোক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকার কারণে সেখানকার অধিবাসীদের উন্নয়নে বাজেটে যে বরাদ্দ হয় সেটাতে আদিবাসীদের এক ধরনের কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য থাকার সুযোগ আছে। কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের জন্য কোন মন্ত্রণালয় না থাকার কারনে এখানে সেই সুযোগটিও নেই। তাই এখনো সমতলের আদিবাসীদেরকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিশেষ কার্যাদি বিভাগ এর দিকে চেয়ে থাকতে হয় যেটি আগে স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন নামে পরিচিত ছিল। দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসলেও সমতলের আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ পরিচালনা করার মতো পৃথক কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স নামে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের আমলে যে মন্ত্রণালয়টি গঠিত হয়েছিল তা পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সরকার মন্ত্রণালয় উঠিয়ে দিয়ে স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন তৈরি করেন। বর্তমানে সেই ডিভিশন উঠিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ ডিভিশন রাখতে হলে একজন সচিবকে নিয়োগ দিতে হয়। এভাবে এ কর্মসূচিটি বর্তমানে স্পেশাল সেল-এ পরিণত হয়েছে যার দায়িত্বে আছেন একজন গবেষণা কর্মকর্তা। এভাবেই এটি এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে কিছু টাকার থোক বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
এই বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এটা বারবার বলা হচ্ছে তার উপরে আবার যোগ দিয়েছে এর সুষ্ঠু বন্টনের প্রশ্ন। অনেক জায়গা থেকেই খোঁজ পেয়েছি যে, যখন যে ক্ষমতায় থাকে তারাই মূলত নিজেদের মতো করে উপজেলা প্রশাসন এর মাধ্যমে এই বরাদ্দের টাকা বিতরণ করে থাকে। এরকমও অভিযোগ আছে যেখানে হয়তো খুব অল্পসংখ্যক আদিবাসী আছে সেখানেই বড় অংকের বরাদ্দ গেছে। আবার শুধুমাত্র নামমাত্রে একজন আদিবাসী চেয়ারম্যান বানিয়ে তাকে ব্যবহার করে বরাদ্দের অর্থ হজম করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী শিক্ষার্থী বা গরীব আদিবাসী মানুষটি এই বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত রয়েই গেছে।
আদিবাসীদের জন্য পৃথক বরাদ্দ ছাড়াও বাজেটের অন্য খাতগুলো থেকে আদিবাসীরা কতখানি সুবিধা নিতে পারে সেটা একটি বড় বিষয়। আদিবাসীদের বিষয়টি মূল বাজেট বাস্তবায়নে তেমন কোন গুরুত্বই পায় না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আদিবাসীদের জন্য কিছু বরাদ্দের কথা জানা যায়। তবে, বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর অংশের মধ্যে অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল উভয় অঞ্চলের আদিবাসীদের সিংহভাগ এখনও জীবিকা নির্বাহের জন্য জুম ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সমতলের আদিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও অধিক এখন ভূমিহীন। তার ওপর ভিটেমাটি ও ভূমি নিয়ে বিরোধ সর্বত্র। এরকম অবস্থায় আদিবাসীদের দুঃখ আরো বেড়ে যায় যখন দেখা যায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নামে প্রতিবন্ধী, দলিত, হরিজন, চা-শ্রমিক, বেদে, হিজরা, ভিক্ষুক, এতিম, বয়স্ক, বিধবা, দুস্থ মহিলা, শিশু, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বেকার যুবকদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ হয় কিন্তু আদিবাসীদের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়না। তাই আশা করবো আদিবাসীদের জীবন মানের উন্নয়নের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য ন্যায় সঙ্গত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই ভূমিকা রাখবেন এবং বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসীদের জন্য আলাদা একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করবেন।
: ১ জুন ২০১৬ তারিখে আইপিনিউজবিডিডটকম এ প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ রাত ১:০০