লন্ডন ভিত্তিক মুসলিম এইড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক পপ সঙ্গীত শিল্পী জনাব ইউসুফ ইসলাম বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আজকে বড় সমস্যা ইসলামের বাস্তব শিক্ষার অভাব এবং জীবনাচরণে ইসলামী আদর্শের অনুপস্থিতি। আমাদের ধর্মে যে আমাদের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে সে সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ।”
সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রামকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। গত ২৯শে ডিসেম্বর তিনি ৪ দিনের এক সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ আসেন। ২রা জানুয়ারী তিনি স্বদেশ যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।
জনাব ইউসুফের সাথে আলোচনার সূচনাতেই প্রশ্ন করলাম আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন কেন? তিনি হেসে জবাব দিলেন, দেখুন সঙ্গীত আমাকে ঐশ্বর্য দিয়েছিল অপার। জীবন ভাগের সব আয়োজন ছিল আমার নাগালে। কিন্তু ভোগ বিলাস আমার মনকে শান্ত করতে পারেনি। আমি কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। এই অশান্তি আমাকে ধর্মের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। আমি আমার তদানীন্তন স্বধর্ম খৃষ্টবাদ সম্পর্কে পড়তে শুরু করি। এরপর ইহুদী, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উপর আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু আমি বিফল হই। আমার আকঙ্খিত শান্তি আমি পেলাম না। এ সময় আমার ভাই জেরুজালেম থেকে আবেগ জড়িত কণ্ঠে অনেক কথাই বললো। আমি যে অনুসন্ধানের জন্য তখন ব্যাকুল হয়ে আছি, আমার ভাই সেই খবর জানতো। আমার জন্ম দিনে সে জেরুজালেম থেকে নিয়ে কুরআন আসা একখ- পবিত্র কুরআন শরীফ উপহার দিলো। আমি পবিত্র কুরআন পড়তে শুরু করি। কুরআন সেই মহাগ্রন্থ যা আমার জীবন ও চেতনার জগতকে পালটে দিয়েছে। আমার মনের সকল প্রশ্নের জবাব এই গ্রন্থে পেলাম। আমি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আমি মুসলমান হলাম।
প্রশ্নঃ করলাম, এখন আপনি আপনার বিগত জীবনকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
জনাব ইউসুফ জবাব দিলেন, দেখুন আজ আমি পরিতৃপ্ত, সুখী। আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমার লক্ষ্য, সে লক্ষ্যেই আমার জীবনকে পরিচালিত করার চেষ্টা করছি। আর আমার পূর্বের জীবন ছিল মোহাচ্ছন্ন, ভোগ বিলাসের, জীবনের কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল না।
প্রশ্নঃ আপনার পুরানো বন্ধুরা আপনার সম্পর্কে কি বলে?
উত্তরঃ ওদের সাথে যোগাযো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। দেখা সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় হয়। তবে আমাদের জীবেনর মৌল দর্শন পালটে গেছে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে অনন্ত জীবন আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ, আর তাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীকে ভোগের জন্য প্রাণপাত করা।
প্রশ্নঃ আপনি ইসলামী সঙ্গীতের বিষয়ে কিছু ভাবছেন?
উত্তরঃ ইসলামের সঙ্গীতের প্রবেশাধিকার কতটুকু তা আমি জানি না। ইসলাম সঙ্গীতকে কতটুকু গ্রহণযোগ্য করেছে সেসম্পর্কে জানতে হবে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে ভাববো।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশে আপনার এই সফরের উদ্দেশ্য কি?
উত্তরঃ আমরা বাংলাদেশী মুসলিম ভাই বিশেষ করে এখানে অবস্থানকারী বিহারী মোহাজের মুসলিম ভাইদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে এসেছি। এছাড়া আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য তাদের হাতে তুলে দিতে আমি এখানে এসেছি। এখানে আসার আগে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহণকারী আফগান মুসলমানদের অবস্থা দেখতে আমি সে দেশে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ভারতের বাঙ্গালোরে এক মুসলিম যুব সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দেই। সেখান থেকেই ঢাকায় আমি। আমি চট্টগ্রামও যাব।
প্রশ্নঃ আপনাদের সংস্থার উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম কি? এর তহবিল কিভাবে সংগৃহীত হয়।
উত্তরঃ আমাদের সংগঠন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবামূলক। ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে দুঃস্থ মানবতাকে সেবা আমাদের উদ্দেশ্য। যুক্তরাজ্যের মুসলিম অমুসলিম ব্যক্তিদের দান আমরা গ্রহণ করি। এছাড়া ২১টি ট্রাষ্ট আমাদের সহায়তা করছে।
প্রশ্নঃ শুধু মুসলমানদেরকেই কি আপনারা সাহায্য করে থাকেন?
উত্তরঃ না । ইসলামী আদর্শে পরিচালিত আমাদের সংস্থা ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল দুঃস্থ মানুষকেই সহায়তা দিচ্ছে। তবে আজকে বিশ্বে মুসলমানরাই তো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। সর্বত্রই তো তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
প্রশ্নঃ মুসলমানদের এই দুর্ভোগের কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ আমাদের সমস্যা তো একটি। ইসলাম সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব। ইসলামকে আমরা মুখে মুখে গ্রহণ করলেও আমাদের জীবনে এর আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে পারিনি। ইসলামকে অনুসরণ করলে আমাদের সমস্যা থাকতো না। আমি পশ্চিমের ঐতিহ্য নিয়ে যেভাবে ইসলামের সৌন্দর্য, গুরুত্ব এবং সম্পদকে উপলব্ধি করছি, আমার সন্দেহ হয় অনেকেই হয়ত সেভাবে করছেন না।
প্রশ্নঃ অনেকেই তো বলেন, ইসলাম ১৪শ বছরের পুরাতন আদর্শ, এ যুগের জন্য অচল। এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন?
উত্তরঃ আমি বিনয়ের সাথেই বলছি, যারা এসব বলেন, তারা নিজেদের মনে স্থান করে নেয়া ইসলাম সম্পর্কে পূর্ব ধারণার বশবর্তী হয়েই ইসলামকে বিচার করে। যদি সত্যিকারভাবে তারা এ ব্যাপরে জানতে চাইতো তবে তাদের উক্তি হতো ইতিবাচক। এমন দায়িত্বহীন হতো না।
প্রশ্নঃ যুক্তরাজ্যে ইসলামের দাওয়াতী কাজ কেমন চলছে?
উত্তরঃ সেখানকার পরিবেশ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ইসলামের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। কিন্তু এরপরও কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন লোক ইসলাম গ্রহণ করছে। আর এসব মুসলিম যেহেতু সেই দেশেরই নাগরিক, তাই সেখানকার সামাজিক জীবনে এর একটা প্রতিক্রিয়া পড়ছে। যুক্তরাজ্যে মুসলিম শিশুদের ইসলামী শিক্ষা দানের জন্য স্কুল খুলেছি।
প্রশ্নঃ আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
উত্তরঃ ১৯৩৮ সালের রমজান মাসে আমি লন্ডনে জন্মেছি। আমার পিতা ছিলেন গ্রীক সাইপ্রিয়ট, মা সুইডিশ। আমার মা এখনো জীবিত। ১৯৭৭ সালে আমার ইসলাম গ্রহণের পর আমার স্বজনদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমার স্ত্রী ফাউজিয়া আফগান ও তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলিম। আমাদের তিন কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। আমি ব্যবসায় কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করেছি। এতেই আমর চলে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশী মুসলিম ভাইদের জন্য আপনার কি কোন বাণী রয়েছে?
উত্তরঃ তাদের প্রতি আমার আবেদন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে ইসলামী উম্মার প্রতি তাদের দায়িত্ব অপরিসীম। ইসলামকে নিজেদের জীবনে সর্বোত্তমভাবে পালনের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নেয়া। [দৈনিক সংগ্রাম, বুদ্ধবার ২২শে পৌষ ১৩৯৩ বাংলা]
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১২ রাত ১:০২