জানো, রোজ খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় !
সকাল বেলা জানালা দিয়ে ঝিরঝির করে হিম বাতাস আসে । আর আসে ঝিকমিক করা মিষ্টি রোদ, ঠিক আমার মায়ের মত । আমার মা ও খুব মিষ্টি । চারতলা ফ্ল্যাটে আমাদের জানালার পাশে দুটো সুপারি গাছ । একটার মাথা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরা যায় । আরেকটা গাছ একটু বড় । জোড়ে বাতাস বইলে ছোট গাছটা এমনভাবে দোলে যেন এখনি ভেঙ্গে পড়বে । গাছের লম্বা চিকন পাতা এসে জানালার উপর আছড়ে পড়ে । আমি হাত বাড়িয়ে সবুজ পাতাকে ছুঁয়ে দিই ।
একটা বুলবুলি পাখি সকালে এসে গাছের ডগায় বসে । ধুসর কালচে রঙের শরীর, পেছনে লাল পুচ্ছ । পাখিটা খুব সুন্দর দেখতে । আমার সাথে ওর খুব ভাব । বুলবুলি পাখিটা মাঝে মাঝে কোথায় যেন চলে যায় । তারপর হঠাৎ একদিন আবার ফিরে আসে । আমাদের জানালার কার্নিশে চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে । তিনটা চড়ুই সব সময় উড়ে বেড়ায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে । আমার সাথে ভাব করার সময় তাদের নেই । রোদ বাড়ার সাথে সাথে কয়েকটা পাতিকাক এসে গাছে বসে । আগে ওদের দেখলে বিরক্তি লাগতো । এখন ওদের সাথে অনেক দুষ্টুমি করি । ওরা কা-কা করে ডেকে উঠলে আমিও তাদের মত করে কা-কা করি । ভেংচানো দেখে ওরা প্রথমে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । পরে সমস্বরে কা-কা করতে করতে দুরে কোথাও উড়ে যায় ।
জানো, আমাদের বাসার সবাই এখন জ্বরে আক্রান্ত । না না, এটা শরীরের কোন অসুখ না । এটা হলো ফুটবল জ্বর । বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা সবাই উত্তেজিত । আমার মা ব্রাজিলের কড়া সাপোর্টার, সাথে ছোট ভাইও । বাবা আর আমার ছোট বোন আর্জেন্টিনার । আমার ভাই-বোন মিলে পুরো বাসার দেয়ালে প্রিয় খেলোয়ারদের স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছে । তারা ছাদে পতাকা উড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা রাজি হয় নি । বাবা-মা'র মাঝে খেলা নিয়ে প্রায়ই তর্ক লেগে যায়, রাগারাগি ঝগড়াও হয় । আমি জানি এটা সত্যিকারের ঝগড়া নয়, মিছেমিছি । গতবারের বিশ্বকাপ থেকে আমি এই দুই দলের কাউকে সাপোর্ট দিই না । আমি স্পেনের খেলা পছন্দ করি । আবার নেইমার-মেসি'র খেলা দেখতেও খুব ভাল লাগে ।
জানো, স্পেন প্রথম খেলায় হেরে যাবার পর আমার খুব কান্না পাচ্ছিল । বাবা আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেছে, "মন খারাপ করিস কেন? আরো তো অনেক ভালো দল আছে, ওদের সাপোর্ট দে!" আমার না, স্পেন যে দলের সাথে হারলো সেই নেদারল্যান্ডকে এখন বেশি ভালো লাগে । ছোট ভাই-বোন এটা নিয়ে খেপাবে, তাই এটা এখনো কাউকে বলিনি । অবশ্য আমি জাপানকেও পছন্দ করি । ওরা আমাদের এশিয়ার দেশতো, তাই !
তবে টিভিতে খেলা দেখার চেয়ে মাঠে খেলা দেখতে আমার বেশি ভালো লাগে । বাসার পাশে আমার জানালা বরাবর একটা খালি বড় প্লট আছে । আশেপাশের ছিন্নমুল গরীব বাচ্চারা এখানে খেলাধুলা করে । যখন যে খেলার হিড়িক পড়ে, বাচ্চাগুলো সেই খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে । এখন যেমন দুইবেলা ফুটবল খেলে, আবার ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলা থাকলে ওরা ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেয় । ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চি মাটিতে পূঁতে কখনো কাঠের টুকরো, আবার কখনো পানির খালি বোতলকে ব্যাট বানিয়ে ওরা ক্রিকেট খেলে । কখনো মার্বেল খেলা নিয়ে নিজেদের মাঝে মারামারি করে । আবার কখনো ঘুড়ি উড়ানোর সময় নিজেদের মাঝে কাটাকাটি খেলে ।
ওরা সংখ্যায় সাত আটজন । বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকে ওরা রোজ সকালে মাঠে এসে হাজির হয় । তাদের বয়স আট থেকে বারো বছর । আমার থেকে বয়সে ছোট, আমার বয়স এখন পনেরো । ওদের মাঝে কয়েকজনের নামও আমি জানি । সালেহ, মুসা, ফুরুক, তাজুল, হাবিব আরো কি যেন । তাদের ফুটবল কাপড়ের পোটলা দিয়ে বানানো । দুপাশে ইটের টুকরো দিয়ে ছোট ছোট গোলপোস্ট বানায় । খেলায় কোন গোলকিপার থাকে না । দুই দলে ভাগ হয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্ধিতা করে ফুটবল খেলে । বৃষ্টি হলে মাঠে পানি জমে যায় । সেই জমাট পানির উপর বল নিয়ে তারা হুটোপুটি করে ।
মাঝে মাঝে রনি নামের একটা ছেলে তাদের সাথে খেলতে আসে । রনি একটু অবস্থাপন্ন, সে খেলায় তার নিজের ফুটবল নিয়ে আসে । খেলার তুমুল উত্তেজনাকর মূহুর্তে সে রাগ করে বসে । কোন ফ্রি কিক তার বদলে অন্য কেউ নিলে খেলা গুটিয়ে বল নিয়ে সে চলে যায় । অন্যরা তখন বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনে । যেদিন রনির মান ভাঙ্গানো যায়না, সেদিন সেই পুটলা বল দিয়েই আবার খেলা শুরু হয় । খেলার মাঝে প্রায়ই তারা মেসি-মেসি, ব্রাজিল-ব্রাজিল বলে চিৎকার করে । মজার ব্যাপার হলো যে ছেলেটা মেসির ভক্ত, সেই কিছুক্ষণ পর ব্রাজিল হয়ে যায় । তাদের বাসায় টিভি নাই তো, মানুষের মুখে শুনে শুনেই তারা এই সব ফুটবল তারকাদের বিশাল ভক্ত হয়ে গেছে ।
বিকেলে রোদ পড়ে এলে পাড়ার স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা এখানে খেলতে আসে । তাদের পায়ে থাকে ক্যাডস-বুট-মোজা, শরীরে নানান দলের রঙ বেরঙের জার্সি । একেকজন সাক্ষাৎ মেসি-নেইমার-রোনালদো যেন ! ছিন্নমুল গরীব ছেলেগুলো দর্শক হয়ে তাদের খেলা দেখে । কখনো বল দেয়ালের বাইরে চলে গেলে তারা পরম উৎসাহে সেই বল কুড়িয়ে আনে । তিনরঙা চকচকে বলটাকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য তাদের আকুতি আমি আমার জানালা থেকে বুঝতে পারি ।
এই ছেলেগুলোর খেলা দেখতে আমার ভালো লাগে না । তাদের খেলায় কোন উত্তেজনা নেই । ম্যাচ না খেলে তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিক প্র্যাকটিস করতেই বেশি পছন্দ করে । উত্তেজনাময় জীবন্ত ফুটবল দেখার জন্য তাই আমি পরবর্তী সকালের অপেক্ষায় থাকি । জল কাদায় মাখামাখি করা ছেলেদের সাথে মিশে গিয়ে আমিও যেন খেলায় নেমে পড়ি । কোন পক্ষে গোল হলে তাদের সাথে সাথে আমিও গোওওল বলে চিৎকার করে উঠি । কেউ ভালো পজিশনে থাকলে তাকে পাস দেয়ার জন্য আমি আর্তনাদ করতে থাকি । ওরা যখন পানি কাদায় বলের দখল নিতে লুটোপুটি খায়, আমার কপাল ভিজে যায় ঘামে ।
জানো, ওদের খেলা দেখে দেখে আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাই । মনে হয় যেন স্কুল মাঠে আমার দলের সাথে প্র্যাকটিস করছি । আমি স্কুল দলে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখি । আমার বাড়িয়ে দেয়া পাসে গোল করে আমার দল জিতে যাওয়ায় আমি পুলকিত বোধ করি । নিচের মাঠে গোওওল চিৎকার শুনে আমি স্বপ্নের রাজ্য থেকে আবার মাটিতে নেমে আসি ।
প্রতিবার স্কুল দলে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখার পর আমার চোখ ভিজে আসে । কারণ আমি জানি, আমি কখনোই ফুটবল খেলতে পারবো না । ছোটবেলা পোলিও আক্রান্ত হয়ে এখন আমি শারিরীক ভাবে অক্ষম । সারাদিন হুইল চেয়ারে বসে জানালার ওপাশে তাকিয়ে আমি জীবন দেখি ।
________________________________________________________________________
কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার মাহমুদ ০০৭ । উনার চাপাচাপিতে গল্পটা লেখা হয়েছে ।