একঃ
ক্যাম্পাসে প্রথম দিন, একদল নতুন বন্ধুর মাঝে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছি । অপরিচয়ের পর্দাগুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে । অনেকেই ছোট ছোট বৃত্ত বানিয়ে আড্ডা শুরু করে দিয়েছে । অন্যরাও নিজের পরিচয় দিয়ে সেইসব আড্ডার মাঝে সেঁটে যাচ্ছে । আমার মত অল্প কিছু মুখচোরা নিজেদের আড়ালে রেখে নতুন পরিচয়ের মুগ্ধতা অনুভব করছে । কেউ কেউ স্বতঃস্ফুর্ত, যেন রোজকার আড্ডার চিরচেনা প্রাঙ্গনে দিচ্ছে রুটিন হাজিরা । কেউ কেউ গম্ভীর, কাঁধ-মাথা ঝাঁকিয়ে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি । কয়েকজন আবার হ্যাংলো, মেয়েদের সামনে তাদের স্মার্টনেস জাহির করার সেকি হাস্যকর প্রাণান্ত চেষ্টা! ছোট ছোট মানববৃত্ত আর অবিন্যস্ত জটলা থেকে ক্রমে জমাট শোরগোল ছড়িয়ে পড়ছে । হঠাৎ ভীর ঠেলে একজন উঠে এসে দুহাত দিয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরে,
-আরে সৈকত না! দোস্ত তুইও এখানে? ভালোই হলো..
চেনার ভান করে আমিও তার দুহাতের কবজি চেপে ধরি । ব্যাকব্রাশ করা কোকড়ানো চুল আর সাদা ফ্রেমের চশমা পড়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম মুগ্ধতা ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করি । ও বুঝতে সময় নেয় নি, "আরে আমি রবি, কলেজে এ সেকশনে ছিলাম"! এবার রবিকে চিনতে পেরেছি । আমি বি সেকশনে ছিলাম । রবিকে কলেজে দেখেছি, কিন্তু কখনো কথা বলা হয় নি ।
রবি অন্যরকম, রবি নিভৃতচারি । হলের কোণায় একটা রুমে উঠেছে রবি । কমনরুমের সব শেষের লাইনে চুপচাপ বসে টিভি দেখে । ডাইনিংয়ের এক কোণায় মাথা নিচু করে ভাত খায় । ক্লাসে বসে প্রথম সারিতে, মনযোগী ভাল ছাত্র সে । ক্লাস শেষ করে রবি ছুটে টিউশন বাড়িতে । ছাত্র পড়ানো শেষ করে একা একা ঘুরে বেড়ায় বেইলি রোডের নাটক পাড়া কিংবা ছবির হাটের আশেপাশে । রুমে বসে কেমেস্ট্রির মোটা মোটা বই পড়ে, কখনো পড়ে কবিতা । এমন সুনিপুণভাবে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে রবি, ক্যাম্পাসে তার অস্থিত্ব নিমিষেই অস্বীকার করা যায় । কিন্তু আমি তার অস্তিত্ব টের পাই, কিংবা আমাকে রবি তার অস্থিত্ব টের পাইয়ে দেয় ।
আড্ডাবাজিতে গা ভাসানো আমার পড়াশোনা কবেই শিঁকেয় উঠেছে । পরীক্ষার আগে যখন চোখে সর্ষে ফুলের নাচন দেখি, রবিই তখন এগিয়ে আসে কিছু শর্টনোট নিয়ে । এটা পড়েই কোনরকম পরীক্ষার ঘাট পার হই । এরই মধ্যে আমি জড়িয়ে পড়ি ছাত্র রাজনীতিতে । ক্যান্টিন আর ক্যাম্পাসের দোকানে বাকির পরিমান বাড়তে থাকে, নেতা হিসাবে আমার উত্থানের মতই । আমার এই হার্ডলাইফে রবির মত ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকার কথা না । তবু সম্পর্কটা থেকে যায়, টাকার অভাব পড়লেই রবির কাছে ছুটে যাই । রবির কাছে টাকা চাইতে হয় না, নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে কিছু লাগবে কিনা । তারপর বইয়ের ভাঁজ থেকে টিউশনির টাকাটা তুলে দেয় আমার হাতে, ফিরিয়ে দেব কিনা এটা নিয়ে রবি কখনো ভাবে না ।
কিছুদিনের ভেতরে আমাদের গ্রুপ রাজনীতিতে একটা পজিশনে চলে আসে । খুচরো টাকার জন্য এখন আর রবির কাছে যেতে হয় না । তবে রবিই মাঝে মাঝে আমার রুমে আসে, আমার খোঁজখবর নেয় । আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা রবিকে দেখলেই টিটকারি দেয়, যাক সকালবেলা ভালো একটা ছেলেকে দেখে ঘুম ভাঙ্গলো! কেউ কেউ তার দিকে গাঁজার স্টিক এগিয়ে দেয়, রবি টানলেই রাজা হয়ে যাবি! দে না একটা টান, হেভ্ভী ফিলিংস.. রবি মুখ টিপে জবাব দেয়, আমার ফিলিংস লাগবে না!
অনেকদিন রবিকে দেখিনা । আমি দিনমান ব্যস্ত পলিটিক্স নিয়ে, রবিও হয়ত অন্য কিছু নিয়ে । একদিন ক্যাফেতে জরুরী মিটিং করছি, দেখি রবি এসে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে । বুঝতে পারছিলাম আমার কাছে এসেছে, কিন্তু উঠতে পারছিলাম না । তবু দু'মিনিটের জন্য ওর কাছে গেলাম । আমাকে দেখে বললো, ফাইনালের ফর্ম ফিলআপ করেছিস? আমি বললাম, কিসের ফাইনাল? ওসব পরীক্ষা দেবার সময় আমার নেই! রবি মনে হয় প্রস্তুত হয়েই এসেছিল । বললো, তবু ফর্ম ফিলআপ করে রাখ! এটেন্ড করলেই হয়ত সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে যাবি । গ্রেজুয়েশনটা কমপ্লিট করে রাখ, তারপর ইচ্ছেমত পলিটিক্স করিস! আমি বললাম, চাইলেই এটেন্ড করা যায়না! গত দুই বছর ক্লাস-বইয়ের ধারে কাছে যাইনি, কোন টিউশন ফি ও জমা দেইনি! রবি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, তুই শুধু এটা পূরণ করে দে! রেজিস্ট্রার অফিস থেকে খোঁজ নিয়েছি, তোর সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগবে । আমি ওটা দিয়ে দিচ্ছি!
রবির একগুয়েমিতে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল । যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাস নেতৃত্বের প্রথম সারিতেও চলে এসেছি । রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ গালিচা পেরিয়ে আশ্চর্য্য মধুপানের নেশায় বুঁদ হয়ে সময় কাটাচ্ছি । ব্যাচমেটরা ইতিমধ্যে মাস্টার্স শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিয়েছে । এর মধ্যে একদিন রবি দেখা করতে আসে । এমএস করার জন্য সে ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে । খবরটা শুনে খুশিতে রবিকে জড়িয়ে ধরি । রবি আমার হাত দুটো চেপে ধরে গলা নামিয়ে বলে, তোরে নিয়ে খুব চিন্তা হয় দোস্ত, তুই ভাল থাকিস! আমি হাসি দিয়ে তার সকল চিন্তা উড়িয়ে দিতে চাই । একটা কাগজে তার মেইল এড্রেস লিখে আমার ব্যাকপকেট থেকে ওয়ালেট বের করে নিজ হাতে গুছিয়ে রাখে রবি ।
এদিকে রাজনীতিতে দ্রুত 'মধুরেণ সমপায়েৎ' ঘটে যায় । জুনিয়র ছাত্রনেতারা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে । ক্যাম্পাস নিজেদের দখলে নিতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে । আমরা সিনিয়ররা হঠাৎ করেই 'নো বডি' হয়ে যাই । আধিপত্যের লড়াই চরম মারমুখী হয়ে উঠে । ততদিনে অছাত্র হয়ে পড়া আমাদের ক্যাম্পাস ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয় । যে রাজনীতির জন্য বিগত সাত বছর এত কিছু ত্যাগ করলাম, সেই রাজনীতি যেন একটা নির্মম প্রতিশোধ নিল আমার উপর । মাস্টার্স শেষ না করেই শূন্যহাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে একটা মেস বাড়িতে উঠি । হতাশার করাল গ্রাসে ডুবে যেতে যেতে একদিন কপর্দকশূন্য ওয়ালেট নেড়েচেড়ে রবির মেইল এড্রেসটা পাই । গভীর তমসায় নিমজ্জমান আমার জীবনে আবার আলোর রেখা হয়ে ফুটে উঠে রবি ।
দুইঃ
ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করার জন্য রবি নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে । সেই রবি, আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু রবি । চরম বিপদে যে সব সময় দেবদূতের মত পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । আমার মেইল পেয়ে, আমার যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের কথা শুনে রবি এগিয়ে এসেছে । ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এমএস এ এডমিশন পাইয়ে দিয়েছে । রবি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ম্যানচেস্টার থেকে ষাট কিলো দুরে লিডসে, ওর বাড়িতে । গাড়ি ছুটে চলেছে উত্তর ইংল্যন্ডের বিস্তৃর্ণ তৃণভূমির মাঝদিয়ে মহাসড়ক ধরে । বসন্ত এসে গেছে, কিন্তু চারপাশের প্রকৃতির উপর শীতের আগ্রাসন এখনো দৃশ্যমান । পত্রহীন বৃক্ষ আর হলদেটে ঘাসের মাঝে কচি নতুন পাতার জেগে উঠা বসন্তের আগমনকেই নিশ্চিত করে । সূর্যের তেজ পেয়ে বোগেনভেলিয়া তার হলুদ পাপড়ি মেলে দিয়েছে । এর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে রবি গল্প জুড়ে দিয়েছে । রবির প্রিয়তমা বউয়ের গল্প, সুসান ম্যাগনাল্ডের গল্প । ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে রবির গল্প শুনছি আর কল্পনায় সেই নারীর ছবি আঁকার চেষ্টা করছি । কথায় কথায় রবি সুজান, সুজান বলে গলা শুকিয়ে ফেলছে । আর প্রতিবার এক অপার্থিব আলোয় তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে । রবির এই অকৃত্রিম আনন্দদোলা আমাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে ।
প্রায় মিনিট চল্লিশের পর আমরা রবির বাড়িতে পৌছলাম । দরোজা খুলে দিল সেই প্রিয়দর্শিনী শ্বেতাঙ্গিনী- সুসান ম্যাগনাল্ড । হ্যালো করতেই পরম উষ্ণতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরলো । আমি তাকে রবির কথা বললাম, ড্রাইভ করার সময় সুজান সুজান বলে ডেকে উঠার কথা বললাম । সুসান তো হেসেই খুন । নিজেই আমার ব্যাগেজ টেনে লিভিং রুমে পৌছে দিল । দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি আর এয়ার স্ট্রেস কাটাতে একটা লম্বা ঘুম দিলাম ।
বিকেলে রবি আর সুসান আমাকে একটি সুপারমলে নিয়ে গেল । টুকটাক যা কিছু দরকার সব কিনে ব্যাগ ভরে ফেলল । তারপর সন্ধ্যায় একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাসার পথে চললাম । এবার ড্রাইভিং সিটে সুসান, তার পাশে রবি । আমি পেছন থেকে ওদের ভালোবাসা, ওদের সম্পর্কের রসায়ন বুঝার চেষ্টা করছি । হঠাৎ আমি যেন সুসানকে হিংসে করা শুরু করেছি । বারবার মনে হচ্ছে, কি এমন আছে এই ইয়ান্কি মহিলার মাঝে, যার জন্য আমার বন্ধু রবি এমন পাগল হয়ে গেল!
দুদিন রবির বাসায় থেকে এবার আমার ইয়র্ক যাবার পালা । ওখানে স্টুডেন্ট কোয়ার্টারে একটা রুম আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিল রবি । সে নিজেই ড্রাইভ করে প্রায় পঞ্চাশ কিলো দুর ইয়র্কে আমাকে পৌছে দিল । রুমের সব সুযোগ সুবিধা কনফার্ম হয়ে ঘরটা অর্ধেক গুছিয়ে দিয়ে তবেই রবি বিদায় নিল ।
আস্তে ধীরে আমি ইয়র্কের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে থাকি । আগে বাইরে পার্ট টাইম জব করলেও এখন ইউনিতেই এসিসট্যান্টশিপ পেয়ে গেছি । এদিকে দেশ থেকে আমার বাবা-মা ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে । নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে বিয়ে করে ফেললাম, বাবা-মা'র পছন্দের মেয়েকে । বিয়েটা টেলিফোনে হলেও মাস খানেকের ভেতরেই রিয়া কে নিয়ে আসলাম ইয়র্কে । রবি-সুসান পার্টি দিয়ে আমাদের সেলিব্রেট করে । রিয়া আসার পর আমার ব্যস্ততা বেড়ে যায় অনেকটুকু । রবির সাথেও ইদানিং যোগাযোগ কম হয় । কয়েকমাস পর পর কেউ হয়ত হ্যালো করি, নিজেদের খোঁজ খবর নেই । তবুও বুঝতে পারি এখানকার ব্যস্ত জীবন আমাদের ক্রমেই দুরে সরিয়ে দিচ্ছে । রবির সাথে এই যোগাযোগহীনতা প্রায়ই পোড়ায় আমাকে ।
সেদিন ল্যাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় । এসেই শুনি সুসান ফোন দিয়েছিল, রবি হসপিটালে এডমিটেড । খবরটা শুনার পর আমি পাগলপ্রায় হয়ে উঠি । নিদারুণ আত্মগ্লানীতে ভুগতে ভুগতে আমি ছুটে যাই লিডসের দিকে । রবি একটা সেনেটোরিয়ামে সপ্তাহখানেক ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে । অজানা আশন্কা আর উদ্বেগ নিয়ে রবিকে জড়িয়ে ধরি । আমার স্পর্শ পেয়ে রবি আহ্লাদিত হয়ে উঠে । এই কয়দিনে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে সে । তারপর সব শুনে আমি বিষম খাই । রবি সুসানের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না । সুসান কিছুদিন ধরে আলাদা থাকছে । রবি এমনিতেই ড্রিন্ক করত, সম্পর্ক খারাপের পর তার ড্রিন্কের মাত্রা বেড়ে যায় । একাকীত্বের যন্ত্রণা ঘোচাতে সে কোকেনেও আসক্ত হয়ে পড়ে । এরই প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে তাকে সেনেটোরিয়ামে আসতে হয়েছে ।
সুসান এসে মাঝে মাঝে রবিকে দেখে গেলেও আমি বুঝতে পারি তারা পরষ্পর থেকে অনেকটা দুরে চলে গেছে । অফিসিয়ালি হয়ত সম্পর্কটা এখনো আছে, কিন্তু এটা বেশি দিন টিকবে বলে মনে হয়না । রবি এখন মোটামুটি সুস্থ । কিন্তু ওর শুশ্রূষা দরকার । তাই সেনেটোরিয়াম থেকে অনেকটা জোরাজুরি করে রবিকে নিয়ে এসেছি আমার বাসায় । রিয়াও তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহন করে । আমরা দুজন মিলে ওর দেখাশোনা করছি, ওর মন ভাল রাখার চেষ্টা করছি । সপ্তাহ ধরে রবি আছে আমার বাসায় । এর ভেতরে আমি জবেও যাচ্ছি । তাই দিনের বেশিরভাগ সময় রিয়াই ওকে দেখাশোনা করছে । জানি রিয়ার কষ্ট হচ্ছে, তবু রবির সাথে আমার সম্পর্কটা বিবেচনা করে আশা রাখি রিয়া বিরক্ত হবে না ।
আমার বন্ধু রবি আমাকে বেশিদিন অস্বস্তির মাঝে রাখেনি, একটু সুস্থ হয়েই সে লিডসে ফিরে যেতে উদ্যত হয় । আমি না না করে উঠি, রিয়াও আমাকে সায় দেয় । তবু রবি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে । আমাকে আর রিয়াকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে সে চলে যায় তার শহরে, তার একাকী জীবনে ।
রবি আবার কোকেনে জড়িয়ে যেতে পারে, আশন্কাটা ডাক্তাররাই জানিয়ে রেখেছিল । তবু ভেবেছিলাম রবি হয়ত ফিরে আসবে এ পথ থেকে । চেয়েছিলাম, সুসান আবার ফিরে আসুক তার জীবনে । কিন্তু এবার সুসানের ফোন পাওয়ার পর উদ্বেগটা বহুগুনে বেড়ে যায় । ছুটে গেলাম লিডস হসপিটালের আইসিইউ'তে । রবি সেখানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ভেন্টিলেশনের সাপোর্টে । সুসান উদভ্রান্তের মত চারদিকে ছুটোছুটি করছে । তার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম দেশে, রবির বাবাকে । ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন চেপে গিয়ে শুধু জানালাম রবি অসুস্থ । ভারী হয়ে আসা কন্ঠে রবি'র বাবা জানালেন, বাবা যে করেই পার রবিকে দেশে পাঠিয়ে দাও!
কন্ঠ আমারও রোধ হয়ে এসেছে । রবি'র সাথে সুসানের আলাদা হওয়াটা রবির বাবা জানেন । আর আত্মজ বলেই হয়ত তিনি ক্রিটিকেল সিচুয়েশনটা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন । রবি'র বাবাকে দেয়া কথাটা আমি রেখেছিলাম । রবিকে দেশে পাঠিয়েছিলাম, কফিনে পুরে । সুসান, যাকে রবি তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিল, রবি'র মৃতদেহ দেখে তাকে একটুও কাঁদতে দেখিনি । শুধু হাটু গেড়ে বসে এক গুচ্ছ শাদা ফুল রবি'র মাথার কাছে রেখে নিরবে তাকিয়েছিল ।
তিনঃ
প্রায় এক যুগ পর দেশে ফিরেছি । নিজের তিক্ত অতীতের জন্যই এই কটা বছর দেশমুখী হতে মন চায়নি । তারপর রিয়া এলো, ঘর আলো করে দুটি সন্তান এলো । তারা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল । স্ত্রী-সন্তানের চাপেই অনেকটা বাধ্য হয়ে দেশে এসেছি । ঢাকায় পা দেবার পর তাদের আনন্দ দেখার মত । সেই আনন্দ আমার মনেও ছুঁয়ে গেছে । কিন্তু আমার আনন্দ দুদিনের ভেতরেই মিলিয়ে যায় । দেশে আসার পর থেকেই আমার বুকের ভেতর অনবরত খুঁচিয়ে চলেছে আমার বন্ধু রবি'র স্মৃতি । খুব পোড়াচ্ছে মনটা, একবার রবি'র বাবাকে দেখে আসা উচিত ।
অশান্ত হয়ে উঠা মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রিয়াও বললো, যাও দেখে আসো একবার । ডায়েরি ঘেটে রবি'র বাবার নাম্বার পেয়ে গেলাম । ফোন পেয়ে রবি'র বাবা খুব খুশি হলেন, সিদ্ধান্ত হল আগামিকালই যাব । বৃহত্তর সিলেটের একটা থানা সদরে রবি'দের বাড়ি । সায়েদাবাদে গিয়ে বাসে চড়ে বসলাম । দুপুরের দিকে জেলা শহরে পৌছে একটা ছোট গাড়িতে করে বিকেল নাগাদ ওখানে গিয়ে পৌছলাম । রবি'র বাবা সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন । সফেদ শশ্রুমন্ডিত বয়স্ক মানুষ, আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন । অনেকটা সময় আমাকে উনার বুকের মাঝে ধরে রাখলেন । আমার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছিল, কোনরকম মুছে নিজেকে শান্ত করলাম । তারপর একটা রিকশা নিয়ে দুজনে রবি'দের বাড়ির দিকে যেতে থাকলাম ।
একটা বড় দিঘীর পাড়ে এসে রিকশা থামল । শেষ বিকেলের রুপালী আলোয় দিঘীর জল টলমল করছে । বাড়ির সামনে প্রচুর গাছপালা, মাঝখান দিয়ে সবুজ ঘাসে মোড়া প্রাকৃতিক চলার পথ । কিছুটা চলার পর একটা সুন্দর বাগান, খুব যত্ন নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো । বাগানের পরেই একটা ছোট্ট চৌচালা টিনের ঘর, নকশি কাঠের বেড়া দেয়া । এটা রবি'দের বাংলো ঘর, মেহমানদের থাকার জায়গা । বাংলো ঘরের পরেই বিশাল উঠোন, তারপর মুল ঘর । উঠোনের দুই পাশে সারি সারি ফুলের গাছ । বাংলোঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো । চাচা নিজ হাতে লেবুর ঠান্ডা শরবৎ আর সেমাই নিয়ে এলেন । শরবৎ পান করে মনটা জুরিয়ে গেল । চাচা বললেন, ক্লান্ত হয়ে এসেছো গোছল করে নাও । দিঘীর পানিতে গোছলের কথা শুনে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি । অনেকক্ষণ ধরে দিঘীর স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটলাম । চাচা রবি'র কবরে নিয়ে গেলেন, উঠোনের পাশে যত্ন করে বাঁশের বেড়া দেয়া জায়গা । ভেতরে সুন্দর করে লাগানো ফুলের বাগান । স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম রবি'র কবরের পাশে ।
খেতে বসেছি, চাচা নিজের হাতে মাছ সবজী তুলে দিচ্ছেন । এই বাড়িটা যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে তার নাম সুজি । চাচা বললেন, 'সুজিই আমাদের দুজনের দেখাশোনা করে । একটা স্কুল করেছে গ্রামের গরীব বাচ্চাদের জন্য, সেখানে আমিও পড়াই' । চাচার কথা শুনতে শুনতে আমার খাওয়া হয়ে গেল, একটু রেস্ট নেয়ার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ।
চোখ বুঝে শুয়ে শুয়ে রবি'র কথা ভাবছি । আমার বন্ধু রবি, প্রাণপ্রিয় বন্ধু রবি, এত মায়া এত ভালোবাসা রেখে কোথাকার কোন বিদেশিনীর প্রেমে পড়ে জীবনটা বিলিয়ে দিলি! ঠিক তখনই উঠোনে ব্যাপক হইচই, এক উদভ্রান্ত মহিলা উঠোন জুরে ছুটাছুটি করছে আর কাকে যেন শাপশাপান্ত করে যাচ্ছে । চাচা তাকে ধরে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন । মহিলাটিকে কোনরকম সামলিয়ে এসে তিনি আমার পাশে বসলেন । মাথা নিচু করে বললেন, কিছু মনে করোনা বাবা, এই হলো রবি'র মা । রবি মারা যাওয়ার পর থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ । সুজি ছাড়া ওকে কেউ সামলাতে পারেনা ।
মনটা বিষাদে ভরে গেল । আত্মজের অকাল প্রয়ান একজন মায়ের মনে কতোটা আঘাত হয়ে আসে যে তিনি পাগল হয়ে যান । আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে চাচা বললেন, চলো বাইরে হাটাহাটি করলে ভাল লাগবে । দিঘীর পাড় ধরে আমরা হাটছি, চাচা একমনে রবি'র গল্প বলে যাচ্ছেন । ছোট বেলায় রবি অসম্ভব চঞ্চল ছিল, কিন্তু তার মায়ের জন্য তাকে কেউ কিছু বলতে পারতো না । সেই রবি যখন মা কে ছেড়ে কলেজে পড়তে যায়, তখন থেকেই ভীষণ চুপচাপ হয়ে যায় ।
হাটতে হাটতে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি । সূর্য গোধূলির লালিমা না ছড়িয়ে হঠাৎ করেই যেন ডুবে গেল । হয়ত প্রচুর গাছপালার জন্য এমন মনে হচ্ছে । দিঘী থেকে শিরশিরে একটা ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে । শীতল বাতাস আমার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে । মনে হলো, হঠাৎ করে দিঘীর পানিতে নামা ঠিক হয়নি, হয়ত ঠান্ডা লেগে গিয়েছে । আমরা ফিরে যাচ্ছি রবি'দের বাড়ির দিকে । অন্ধকার অনেকটাই ঘনিয়ে এসেছে, সন্ধ্যা বাতিগুলো ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে । শরীরের কাঁপুনিটাও সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে । হঠাৎ মনে হলো আমার মাথার উপর পৃথিবীটা ঘুরছে । চাচা ঝপাট করে আমাকে জড়িয়ে ধরেন । একি, তোমার শরীর দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! আমি বুঝতে পারছি, কয়েকজন মিলে আমাকে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে । একথাল ঘন কালো অন্ধকার আমাকে ঘিরে রেখেছে, আর আমি শুধু তলিয়ে যাচ্ছি এই অন্ধকারের গহ্বরে ।
ভোরের আলো ফুটতেই আমি জেগে উঠি । পাশে চাচা এবং আরো একজনকে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি তারা আমার পাশে রাত্রি জেগেছেন । তাদের অযথা কষ্ট দেয়ার জন্য আমি গ্লানি বোধ করতে থাকি । চাচা কপালে হাত দিয়ে বললেন এখন আর জ্বর নেই । আরো বললেন, সারারাত জ্বরের ঘোরে আমার প্রলাপ বকার কথা, ডাক্তার-ইনজেকশন আর সুজির সারারাত ধরে আমার কপালে জলপট্টি দেয়ার কথা । আমি উঠে বসলাম, বললাম বাইরে হাটাহাটি করলে আমার ভাল লাগবে । চাচা আমাকে উঠতে সাহায্য করলেন । তারপর বাংলোর সামনে বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম । নিচের সবুজ ঘাসগুলো শিশিরে ভিজে আছে । ইচ্ছে হচ্ছে পা দিয়ে শিশির মাড়াই । বাগানে থরে থরে ফুল ফুটে আছে, বেশিরভাগই শাদা ফুল । ভোরের নরম আলোয় ফুলগুলোর শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে । একটা অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠছে মন ।
চাচা বললেন, 'জ্বর নিয়ে ঠান্ডায় বেশি সময় বাইরে থাকার দরকার নেই । ঘরে চলো, তোমার চাচীকে দেখবে, সুজিকে দেখবে'! চাচার সাথে ধীর পায়ে আমি চলেছি রবি'দের মুল ঘরের দিকে । রবি'র কবরের ফুল গাছগুলোও যেন জেগে উঠেছে । উঠোনের দুপাশের শাদা ফুলগুলো আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে । ঘরের বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । শাদা শাড়িতে চিকন বেগুনী পাঁড় যেন ভোরের শুভ্রতাকে রাঙিয়ে দিচ্ছে । রোদমাখা ফর্সা মুখটায় মিটিমিটি হাসি ।
একি! এ যে সুসান ম্যাগনাল্ড!!
সুসানকে দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক! রবি'র বাবার আদরের সুজি! রবি'র উদভ্রান্ত মায়ের সেবিকা সুজি! আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু রবি'র প্রিয়তমা সুজান আজ পুত্রহারা পরিবারে সুধা বিলিয়ে যাচ্ছে অকাতরে !
ম্যাগনোলিয়া, ছড়াও সুধা মনমধুপে...!