
হুমায়ুন আহমেদ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দুই বাংলার সাহিত্য আকাশকে ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন এই দুই মানুষ । দু'জনেই পরষ্পরের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন । নিউইয়র্কে হুমায়ুন আহমেদ খুব মিস করেছিলেন সুনীল গাঙ্গুলিকে । ফোনে শেষ কথা ছিলো হুমায়ুনের, "খুব শিগগীর দেখা হবে" । মাত্র তিন মাসের মাথায় তারা দুজনেই এখন দরোজার ওপাশে । তাদের মধ্যে কি দেখা হয়েছে ?
হুমায়ুন আহমেদ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে স্মৃতিচারন মূলক এই লেখাটি প্রখ্যাত লেখক-নাট্যকার-পরিচালক শাকুর মজিদের । উনার অনুমতি নিয়ে এই লেখাটি আমি সামহ্যোয়ারইন ব্লগে প্রকাশ করছি ।
তাদের কি দেখা হয়েছে ? : শাকুর মজিদ
১৯৯০ সালের নভেম্বর মাস। পড়ি থার্ড ইয়ারে। কোলকাতার ৩শ বছরপূর্তি উপলক্ষে একটা আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সেমিনার হবে বাড়ির পাশের দেশে। যশোর পেরোলেই বনগাও। ছাত্রদের মধ্যে যাদের পার্সপোর্ট আছে, তাদের অনেকেই যাচ্ছে। আমিও নাম লেখালাম। ভিসার ফরম পূর্ণ করতে গিয়ে পড়ি বিপাকে। কোলকাতার পরিচিত কারো নাম লিখতে হবে, ঠিকানা দিতে হবে। আমি কোলকাতার দু’জন মাত্র মানুষকে চিনি। একজন শংকর, আরেকজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শংকরের ঠিকানা জানি না, সুনীলের ঠিকানা জানি, দেশ পত্রিকার ঠিকানা মুখস্ত। আমি অবলীলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমার পরিচিতজন বানিয়ে ভিসার ফর্ম ফিলআপ করে ধানমন্ডি দুই নাম্বার রোডের ভারতীয় হাইকমিশনে জমা দিয়ে দেই এবং পরদিন ভিসার সীলযুক্ত পার্সপোর্টটি পেয়েও যাই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার ছোটবেলার বন্ধু বইপাগল খালেদ জাফরী। ১৯৮৪-৮৫ সালে আমি বুয়েটে ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় যখন গ্রামের বাড়ি অবসর সময় কাটাতাম, তখন তার বাড়িতে দেশ পত্রিকা দেখতাম। সে দেশ-এর একনিষ্ঠ পাঠক। কোন তারিখে বিয়ানীবাজার দেশ আসবে, সেদিন আমরা পায়ে হেঁটে ৩ মাইল পথ গিয়ে সুতা দিয়ে বাধা ম্যাগাজিনটি নিয়ে আসতাম। এ সময় পূর্ব পশ্চিম ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখক। পরের পর্বে কী ঘটনা ঘঠবে তা নিয়ে তার কৌতুহলের শেষ নাই। ওর পড়া শেষ হলে ম্যাগাজিনটা আমি নিয়ে আসতাম। এই শুরু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তিনি আরো দুই নামেও লিখতেন। একটা ’নীল লোহিত’, আরেকটি ‘সনাতন পাঠক’। সব নামই আমাদের চেনা হয়ে যায়। নানা নামে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ি।

কোলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে বসেছিল আমাদের স্থাপত্য সম্মেলন। হোটেলের রিসিপশন থেকে ফোন করে কথা বলি আনন্দবাজার-এ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চাই। তিনি কোলকাতা নাই। ফোনে পাওয়া যায় শীর্ষেন্দুকে। তাঁর দূরবীন পড়া হয়েছে। সুতরাং তাঁর সাথেও কথা বলা যায়। আগ্রহ প্রকাশ করি দেখা করার এবং এক সময় সেমিনারের দ্বিতীয় সেশন বাদ দিয়ে আনন্দবাজারে গিয়ে হাজির হই। কথা বলি শীর্ষেন্দুর সাথে, তিনি আলাপ করিয়ে দেন তার পাশের কামরার দিব্যেন্দু পালিত-এর সাথে। এক সময় নিয়ে যান এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছেও। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় কাটিয়ে চলে আসি। দেশে এসে একটা ভ্রমণ কাহিনীর মতো লিখি-‘আনন্দবাজারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট’। এ সময় পাক্ষিক ‘অনন্যা’তে নিয়মিত লিখতাম। লেখাটি নিয়ে যাই। ফারুখ ফয়সল ভাইর কাছে পৌঁছাই। তাদের ভ্রমণ সংখ্যা বেরোয় ১৯৯১ সালে, সেখানে এ লেখাটি ছাপা হয়। এটাই ছিলো ভ্রমণ বিষয়ে আমার প্রথম কোনো লেখা।
সুনীল গাঙ্গুলীকে স্বচক্ষে দেখার জন্য আমার আরো প্রায় তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৯৩ সালের পহেলা বৈশাখে বাংলা ১৪০০ সাল মহা উৎসবের সাথে পালন করা হচ্ছে। বিশাল আয়োজন। এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হয়ে পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ঘোড়ার গাড়ির উপর তিনিও সোয়ার হয়েছেন। আমি অনেক দূর থেকে তাঁর ছবি তুলি, এবং প্রথম দেখি।
দুপুরের দিকে বাংলা একাডেমীতে বসেছে আলোচনা অনুষ্ঠান। সেখানেও প্রধান বক্তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বললেন, তিনি খুব ভাগ্যবান যে, দুই বাংলার পহেলা বৈশাখের এই আয়োজনে তিনি উপস্থিত থাকতে পেরেছেন। কোলকাতায় পহেলা বৈশাখ পালন হয়েছিল গত কাল ১৩ এপ্রিল। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল। বাংলা সন আর ইংরেজী কিছু তারিখ [৮ ফাল্গুন, ১ লা বৈশাখ] ঠিক রেখে ২১ ফেব্রুয়ারী, ১৪ এপ্রিল ঠিক করা হয়েছে। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে মুগ্ধ হই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমার অন্তরঙ্গ পরিবেশে একবার আড্ডা হয়ে যায় অনেক বছর পর ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এটা সম্ভব হয় হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে।
এর মধ্যে বিগত প্রায় ২ বছর ধরে আমি হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ট সঙ্গীদের পর্যায়ে চলে আসি। তিনি ঘরে বাইরে যেখানেই যান তার যে বহর থাকে, সেখানে আমিও।
ঢাকা ক্লাবের সিনহা লাউঞ্জে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরের কিশোর এডভেঞ্চার গ্রন্থ’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান হবে। সেখানে সুনীল-সমরেশ-গৌতম থাকবেন। প্রধান অতিথি হুমায়ূন আহমেদ, উদ্বোধক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল-সমরেশ-গৌতম এখন ঢাকায় অন্য কারনে। পরদিন বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে সুনীলের উপন্যাস অবলম্বনে লালন ফকিরের জীবণ নিয়ে বানানো ছবি মনের মানুষ-এর প্রিমিয়ার হবে। এ জন্যে ওঁদেরকে কোলকাতা থেকে আনা হয়েছে, ঢাকা ক্লাবে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। ছবিটির একটা অংশের মালিক চ্যানেল-আই, সুতরাং সব মিলিয়ে দু’য়ে দু’য়ে চার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোড়ক খুললেন ফরিদুর রেজা সাগরের বইয়ের।
এই বইটির প্রকাশক অন্যপ্রকাশ। এতোদিনে তারাও আমার ভালো বন্ধু। সুতরাং তাদের প্রায় সকল আয়োজনেই আমি থাকি, সেখানে যদি কোন কারণে হুমায়ূন আহমেদ নাও থাকতে পারেন।
এই আয়োজনেও আছি। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে অতিথিদের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা আছে সিনহা লাউঞ্জে। বড় অতিথিদের মাথায় সিগারেট খাওয়ার নেশা চেপেছে, তাঁরা হল রুমের সাথে লাগানো টেরাসে চলে গেলেন। অন্যপ্রকাশের মাজহার-মাসুম-কমল, সঙ্গে আছেন ফরিদুর রেজা সাগরও। হুমায়ূন-সুনীল-গৌতম সিগারেট ফুকার ফাঁকে আড্ডায় মেতে ওঠেন। বেশীক্ষণ এই আড্ডা থাকে না। সুনীল হুমায়ূন পাশাপাশি, কিন্তু হুমায়ূন কথা বলছেন গৌতম ঘোষের সাথেই। সম্ভবত: ছবিটা নিয়ে আলোচনা।
খুব দ্রুত এই আড্ডা শেষ হয়ে যায়। দেড় তলায় আরেকটা রেষ্টুরেন্ট। সেখানেই বসার আয়োজন। এ আয়োজনে খুব বেশী লোক নাই। স্বাতী বৌদিকে হোটেলে রেখে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাথে তাঁর বহু পুরনো বন্ধু কবি বেলাল চৌধুরী। অন্যদিনের মাজহার, কমল, মাসুম আর স্থপতি আবু করিম। সঙ্গে আছেন হুমায়ূন আহমেদ আর শাওনও।

আসরের শুরুতেই পরিচয় পর্বের দরকার হলো আমাকে নিয়ে। কারন আমি ছাড়া বাদবাকি সবাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পরিচিত। হুমায়ূন আহমেদ আমার সম্পর্কে সব সময়ই অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করে রেখেছেন, যা প্রকৃত পক্ষে আমি নই। আমার পরিচয়ে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ও হচ্ছে একজন আর্কিটেক্ট, খুব ভালো ছবি তোলে, অসাধারণ কিছু নাটক লিখেছে, ডকুমেন্টারী বানায়, আর খুব ভালো ভালো কিছু ভ্রমন কাহিনী লিখেছে…এসব।
হঠাৎ দেখি, সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসি আমি। নানা ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ শুরু হয়ে যায়।
আমি সুযোগ পেয়ে তাঁর ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি নিয়ে আলোচনা করি। বইটি পড়ার সময় আমার মনে হলো, যদিও এটা অত্মজৈবনিক বই, ভ্রমণ কাহিনী, যিনি লিখেছেন, তিনি তো ফিকশন লিখেন, সে ক্ষেত্রে এখানকার সব চরিত্র বা ঘটনাই কি বাস্তব ছিলো? নাকি বানানো ? বিশেষ করে মার্গারিটার কথা।
সুনীল বলেন, না, আত্মজৈবনিক কোনো লেখায় আমি বানিয়ে কিছু বলি না। লেখায় যা পড়বেন, জানবেন যে সব সত্য। আমি অবশ্য বেনামেও কিছু লিখেছি, সেখানে কিছু ছিটেফোটা আছে, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের কোনো লেখাতে নেই।
আমার হাতে একটা আই-ফোন। এই ফোনের কারিশমা তার অজানা। বোঝা গেলা খুব বেশী ডিজিটাল তিনি নন। আমি বললাম, আপনি চাইলে এই মুহূর্তে আপনার তোলা ছবি এক্ষুণি আনন্দবাজার পাঠিয়ে দিতে পারি। তিনি বেশ অবাক হলেন শুনে।
আমাদের আড্ডা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। সবারই খিদে পেয়েছিল। এরপর দোতলায় গিয়ে আমরা দুপুরের খাবার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি।

( শাকুর মজিদ : স্থপতি-লেখক-নাট্যকার-পরিচালক )
মাজহার বলেছিল, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে যাওয়াতে ভালোই হলো। নেক্সটটাইম দখিন হাওয়া বা নুহাশপল্লীতে সুনীলদার সাথে আড্ডায় বসলে দেখবা কী জিনিস। কিন্তু সে সুযোগটা আর হলো কোথায়?
এক এক করে বড় বড় উইকেটের পতন ঘটেছে। দুই বাংলার সাহিত্য আকাশকে ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন এই দুই মানুষ; দু দজনই পরস্পরের কত ঘনিষ্ট। ৩ মাস আগে ১৯ জুলাই নিউইয়র্কে চিকিৎসা গ্রহণের সময় ছেড়ে গেলেন একজন: হুমায়ূন আহমেদ।
নিউইয়র্কে বসেও হুমায়ূন আহমেদ খুব মিস করেছেন সুনীল গাঙ্গুলিকে। ফোনে শেষ কথা ছিলো হুমায়ূনের, ‘খুব শিগগীরই দেখা হবে।’ মাত্র তিন মাসের মাথায় তারা দু’জনই এখন দরোজার ওপাশে। তাদের মধ্যে কি দেখা হয়েছে?
******************************************************
আমার ব্লগে প্রকাশিত শাকুর মজিদ ভাইয়ের আরও কয়েকটি লেখা..
ঘেটুপুত্রের লোকেশনে : শাকুর মজিদ
এতোদিনে পাইছি তোমার লাগ : রসিক আড্ডাবাজ হুমায়ুন আহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৪ রাত ৯:২৩