আগের পর্ব যারা পড়েন নি,
বাংলাদেশের সিনেমা : সর্বকালের সেরা দশ । ১ম পর্ব
চলচ্চিত্র একই সংগে আর্ট এবং ইন্ডাষ্ট্রি, তাই একই সাথে মানবিক এবং বানিজ্যিক । বাংলাদেশের সিনেমা এই দুটোর অপূর্ব রসায়নে স্বর্ণালী চূঁড়ায় আরোহন করেছে । কিন্তু আমাদের জন্য এটা সত্যি কষ্টের, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গৌরবময় দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার পর বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র অশ্লীলতা, ভাঁড়ামি এবং স্থুলতা দোষে দুষ্ট । যা বর্তমানে রুচিশীল দর্শকদের হল বিমূখ করে দিয়েছে ।
১ম পর্বে আমি নিজের খেয়ালে সেরা দশ সিনেমার প্রথম পাঁচটির তালিকা দিয়েছিলাম । সম্মানিত ব্লগারদের অভিভূত সাড়ায় একটা কথাই মনে এসেছে, আমরা সত্যিই আমাদের চলচ্চিত্রকে ভালবাসি । তাই অতীতের স্বর্ণালী পথ পরিক্রমায় আমরা আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্রের এগিয়ে যাওয়া দেখতে চাই । এই আশাতীত সাড়া আমাকে কিছুটা মধুর সমস্যায়ও ফেলেছে । প্রথম দশে আসার মত পন্চাশোর্ধ সিনেমা থেকে শুধু দশটা নির্বাচন করা যেমন দুরুহ তেমনি বিতর্ক সাপেক্ষ । আর অনেক ভাল সিনেমা রয়েছে যেগুলি আমি হয়ত দেখিনি তাই আমার তালিকায়ও আসেনি, তাই আমার এই প্রচেষ্টা কোন ভাবেই সম্পূর্ন নয় । শুধু বাংলা সিনেমাকে ভালবেসে এই চেষ্টায় আপনাদের উৎসাহ আমাকে আমাদের সিনেমার ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদি করে তোলে । এই পর্বে আমি প্রতিটা নাম্বারে দুটো করে সিনেমা রেখেছি । তারপরেও প্রথম দশে আসার জোরালো দাবিদার, এরকম আরও অনেকগুলো সিনেমার তালিকা এবং দর্শক-সমালোচক জরিপে সেরা দশ-দশ আমি শেষ পর্বে দেবার চেষ্টা করব ।
সেরাদশ ০৬(ক) : সারেং বউ (১৯৭৮)
পরিচালক : আব্দুল্লাহ আল মামুন ।
শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্মান করেন 'সারেং বৌ' । বাংলা সিনেমার সাড়া জাগানো ছবি এটি । এই সিনেমা দিয়ে কবরী জিতে নেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরষ্কার । আব্দুল জব্বারের গাওয়া 'ওরে নীল দরিয়া..' আজও সবার মুখে মুখে শুনা যায় ।
সেরা দশ ০৬(খ) : রংবাজ (১৯৭৩)
পরিচালক : জহিরুল হক ।
বিভিন্ন কারনে 'রংবাজ' ছবিটি আমাদের চলচ্চিত্রে মাইলফলক হয়ে আছে । আমাদের সিনেমা ইতিহাসে 'রংবাজ' ই প্রথম 'এন্টি হিরো' ইমেজের ছবি । এই ছবিটি রাজ্জাক এবং কবরী কে জনপ্রিয়তার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায় । 'সে যে কেনো এলোনা, কিছু ভাল লাগেনা' গানটি আমাদের সিনেমার স্বর্নালী অধ্যায়ের এক অনুপম প্রেমের সংগীত ।
সেরা দশ ০৭(ক) : তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
পরিচালক : ঋত্বিক ঘটক ।
অদ্বৈত মল্লবর্মনের বিখ্যাত উপন্যাসকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত । উপন্যাসের মতই সিনেমায় উঠে এসেছে তিতাস নদী ও তার তীরবর্তী মানুষদের জীবনের চিত্র । ছবিতে অভিনয় করেছেন গোলাম মোস্তফা, কবরী । ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জরিপে ছবিটি দর্শক এবং সমালোচক দুই শ্রেনীতেই প্রথম স্থান অধিকার করে ।
সেরা দশ ০৭(খ) : চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)
পরিচালক : তানভীর মোকাম্মেল ।
'চিত্রা নদীর পাড়ে' তানভীর মোকাম্মেলের পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবি । ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ছবিটির মূল উপজীব্য । পরিচালক ধর্মের পরিচয়ে দেশভাগ পরবর্তি বিপুল সংখ্যক মানুষের দেশবদল, তাদের ইমোশন এবং অনিশ্চয়তা শৈল্পিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই সিনেমায় । অভিনয়ে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আফসানা মিমি, রওশন জামিল ।
সেরা দশ ০৮(ক) : আগুনের পরশমনি (১৯৯৫)
পরিচালক : হুমায়ুন আহমেদ ।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় ছবিটি নির্মিত । আসাদুজ্জামান নূরের দূর্দান্ত অভিনয় ভুলার নয় । শিলা আহমেদ শিশু শিল্পী শাখায় এবং বিপাশা হায়াৎ সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন এই সিনেমায় অভিনয় করে ।
সেরা দশ ০৮(খ) : ওরা এগারো জন (১৯৭২)
পরিচালক : চাষী নজরুল ইসলাম
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত 'ওরা এগারো জন' । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র এটি । অভিনয় করেছেন খসরু, রাজ্জাক, শাবানা । শ্রেস্ট চলচ্চিত্র (১৯৭২) হিসাবে জাতীয় পুরষ্কার বিজয়ী ।
সেরা দশ ০৯(ক) : কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)
পরিচালক : জহির রায়হান ।
আমার দেখা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ছবি । সাধারন গল্প, বাবা মা বিহীন একটা মেয়ে মামার বাসায় থাকে, তাচ্ছিল্য-গন্জনা নিয়ে ।কিন্তু শেষে অবস্থা পাল্টে যায় মেয়েটি যখন লটারী জিতে । ছবির মেকিং এমন ঝরঝরে যেন বয়ে চলা ঝরনা । শেষটা সবচেয়ে দারুন, লটারী পাওয়ায় সবাই যখন তোষামোদি করছে মেয়েটার তখন সে পালায় তার খারাপ সময়ের বন্ধু বেকার মামাকে নিয়ে । অভিনয়ে সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, খান আতা । খান আতার কন্ঠে গানটা নিশ্চয়ই সবাই শুনেছেন, 'শ্যামল বরন মেয়েটি, না না তার নাম বলবো না..'
সেরা দশ ০৯(খ) : ঘুড্ডি (১৯৮০)
পরিচালক : সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী ।
সূবর্না আর আসাদের প্রেমের ছবি । তারুন্য ভরা এই ছবিটি আমার সব সময়ের পছন্দ । আর হ্যাপি আকন্দের সেই হৃদয় ছোঁয়া গান যা আজো লাখো তরুন-যুবকদের মাতিয়ে রাখে, বয়স্করা হারিয়ে যান স্মৃতির নস্টালজিয়ায় । 'আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে.. চলনা ঘুরে আসি..'
সেরা দশ ১০(ক) : নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭)
পরিচালক : খান আতাউর রহমান ।
পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফর-উঁমিচাদের কূটচালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে পরাজিত হন । সেই সাথে দুশ বছরের জন্য অস্তমিত হয় বাংলা-ভারতের স্বাধীনতার সূর্য । পরাজিত দূর্ভাগা নবাব অবশেষে ধরা পড়েন শত্রুদের হাতে । বন্দীজীবনে চেষ্টা করেন দেশের সাধারন মানুষকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করতে । তার আগেই মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদি বেগ তাঁকে হত্যা করে ।
আনোয়ার হোসেনের গলায় আজও যখন কেউ এই সংলাপ শুনে, 'বাংলার আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা.. কে দেবে আশা, কে দেবে ভরসা..' চোখে পানি আসেনি এমন বাঙ্গালী কম আছে ।
সেরা দশ ১০(খ) : নয়নের আলো (১৯৮৪)
পরিচালক : বেলাল আহমেদ ।
বাংলাদেশের সবচে্যে স্মার্ট নায়ক জাফর ইকবাল, সাথে কাজরী, সুবর্না মোস্তফা । 'নয়নের আলো' মুলত গানের ছবি । আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বিখ্যাত সেই সব গান, 'আমার বুকের মধ্যখানে, মন যেখানে হৃদয় যেখানে..', বা 'আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি..', কিংবা 'আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান..'
সময়ের তুলনায় অনেক স্মার্ট মেকিং, 'নয়নের আলো'।
**********************************
বাংলাদেশের সিনেমাঃ সর্বকালের সেরা দশ । শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:০৮