ওরা আমাকে নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিলো
ওরা আমাকে বিছিন্ন করতে চেয়েছিল আমার ‘আমি’ থেকে
ওরা আমার মস্তিষ্ক, হৃদয়-বৃত্তি, ইন্দ্রিয়-চেতনা সবকিছুই
পরিপুষ্ট করতে চেয়েছিল ওদেরই চেতনার আলোকে-
ওরা আমাকে মুক্তি ও স্বাধীনতা স্বপ্ন দেখাতো
ওরা আমাকে বলতো, “বস্তুবাদের বিকাশেই তোমার মুক্তি”
ওরা আমাকে বলতো, “ইন্দ্রিয়ের বল্গাহীন সাধনাই তোমার সাধনা ”
ওরা আমাকে মুক্তচিন্তার কথা বলতো,
ওরা বলতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা,আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা-
ওরা বলতো মুক্তবাজারের কথা, বস্তুতন্ত্রের কথা –
ওরা বলতো, “পুঁজিই পবিত্র, "পুঁজিই সব ক্ষমতার উৎস”
আমি বিমুগ্ধ চিত্তে স্বপ্ন দেখতাম মানবমুক্তির;
আমি স্বপ্ন দেখতাম পৃথিবীর সব বন্ধন হতে মুক্ত হবো একদিন –
কোন শক্তিই আর আমাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না ।।
অনেক উল্লাসিত বছর পেরিয়ে এলাম ।
অনেক উল্লাসিত শতাব্দী পেরিয়ে এলাম ।
হিসেবের খাতা খুলতেই আজ অবশেষে
মানব চৈতন্যের স্বপ্নভঙ্গ হোল !
মুক্তি ও স্বাধীনতার নামে আজ দেখি বৈশ্বিক আগ্রাসন !
‘লিবারেল ডেমোক্রেসি'র নামে আজ দেখি
সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেটিক ডমিনেশন !
যুক্তিবাদিতার নামে আজ দেখি ইউরোপীয় ডিসকোর্সের অন্ধ অনুকরণ !
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে আজ দেখি গণবিচ্ছিন্নতার উদগ্র উন্মীলন !
মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে আজ দেখি তৃতীয় বিশ্বের ( !)
বাজার দখলের মহোউৎসব !
বিশ্বায়নের নামে আজ দেখি পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উন্মত্ত আগ্রাসন !
ঘাস-ফুল, নদীও নীলিমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
গণমানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
মাটির বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে
পুঁজি ও সম্পদের চার দেয়ালে বন্দী মানুষে পরিণত হওয়াকে
ওরা নাম দিয়েছে আজ আধুনিকতা !
আত্মার ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করে বস্তুর আলোয় উদ্ভাসিত
হওয়াকে ওরা নাম দিয়েছে ‘ এনলাইটেনমেন্ট ’ !
মানুষের অন্য সব সুকুমার বৃত্তিকে নাকচ করে দিয়ে
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই ওরা নাম দিয়েছে উন্নয়ন !!
এই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা আমাকে জানতেই দিবে না
উন্নয়নের নামে কতটা পুঁজির গোলামে পরিণত হয়েছি আমি !
এই রাষ্ট্রযন্ত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক হেজিমনি আমাকে বুঝতেই দিবে না
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের নামে কতটা বঞ্চিত হয়েছি আমি
নিসর্গের ঐশ্বর্য থেকে ;
কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি আমি আমার আত্মার ঐশ্বর্য থেকে;
আমার মৌলিক উপাদান থেকে ;
আমার রক্তের আহ্বান থেকে;
মাটির মমতা থেকে;
আমার অন্তর্গত ভালোবাসা থেকে –
আমাদের দুর্ভাগ্য পৃথিবীর সুন্দরতম নামগুলো আজ আর আমাদের নয় !
আমাদের দুর্ভাগ্য পৃথিবীর উন্নত আদর্শগুলো আজ আর আমাদের নয় !!
দিকে দিকে হাহাকার ছড়িয়ে ওরা সব আজ
আশ্রয় নিয়েছে দানবদের কোষাগারে !
যে সভ্যতা তিল তিল করে আমরা গড়েছি আমাদের সম্মিলিত কর্মপ্রয়াসে
তার ঐশ্বর্য আজ পৃথিবীর সব দানবদের দখলে !
যে মানবীয় সংস্কৃতি শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে
আমরা রচনা করেছি আমাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে
তা আজ নির্বিচারে পুষ্ট হচ্ছে পুঁজিপুত্রদের কামনার বিষাক্ত দংশনে !
যে বৈজ্ঞানিক সাফল্য আমরা অর্জন করেছি
হাজার বছরের মেধা ও শ্রম দিয়ে তার সবকিছুই
আজ চলে গেছে অভিজাতদের ভোগ-দখলে !
যে ফরাসী বিপ্লব সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার বাণী নিয়ে
আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল
আমাদের সেই স্বপ্নদ্রোহকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে
তাও চলে গিয়েছে স্বৈরাচারী দানবীয় একনায়কের দখলে !
যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব আমাদের রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলো
আমদের সেই স্বপ্নবিলাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে
তাও আজ পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে !
যে ‘লিবারেলিজম’ আমাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে
মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলো
আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষাকে নিমিষেই নিরাশায় পরিণত করে
তাও আজ পরিণত হয়েছে বুর্জোয়া আদর্শ বাস্তবায়নের হাতিয়ারে !
যে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ আমাদের রাষ্ট্রীয় আধিপত্য থেকে
মুক্তি দিবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো
তা আজ আমাদের পরিণত করেছে এক এক জন আত্মকেন্দ্রিক সমাজ-বিচ্ছিন্ন মানুষে !
যে ‘বস্তুবাদ’ আমাদের দার্শনিক মুক্তি দিবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো
তা আমাদের বঞ্চিত করেছে আত্মিক প্রশান্তি থেকে !
যে শিল্প-সাহিত্য-সাধনা আমাদের মানবিক অনুভূতির
শেষ আশ্রয় ছিলো
তাও আজ অত্যন্ত উল্লাস ভরে জমা হচ্ছে
কর্পোরেট ক্যাপিটালিজমের বর্ধিষ্ণু কোষাগারে !!