পরোটা হাতে রাস্তায় হাঁটছে ছোট্ট এক ছেলে, দূর হতে একটি কাক তাকে লক্ষ্য করল। পরোটা ধরা আঙ্গুল গুলো আলগা ভাবে ধরা, যেন কোনরকমে ঝুলে আছে। কাকটি ছোঁ মেরে টান দিতেই তাই গোটা পরোটা চলে এল ঠোঁটের আগায়, উড়ে সোজা চলে গেল তার ডেরায়, তার বউ তখন ডিমে তা দিচ্ছে। তেলে চুপচুপা হয়ে গেছে ঠোঁট, বউয়ের ঠোঁটের কাছে পরোটা রাখতেই, টাকুস- টুকুস করে সে কিছু খেয়ে নিয়ে বিরক্তিতে ঠোঁট ঘুরিয়ে নিল। একরত্তি পরোটার দশরত্তি তেলে তার মেজাজ চড়ে গেছে।''বাদাইম্মা ব্যাটা কুনানকার, এতখন পর এই নি লইয়া আইছস?'' বউয়ের গজগজাতিনে কাকটি মন মরামরা হয়ে গেল ; দেহি আর কি পাওন যায় - বলে কাকটি আবার উড়াল দিল। উড়ে যেতে যেতে কাকের মাথার ক্যানভাসে পিকাসিয় আঁকিবুঁকি চলতে থাকে ..............
শহরে এলাম কয়দিন? ২ সপ্তাহ? এরি মাঝে বউ কেমন বাজখাঁই হয়ে গেছে! বউয়ের ছোট ভাই, নাম তংবং, তাকে কেমন হাঙ্গামায় ফেলে রেখে চলে গেল! আহারে শালা আমার! বড় ভাল ছিল! তার ঘ্যানর ঘ্যানরেই শহরে আসা। আহা! সে কত কিছু জানত, কত কিছু চিনত ! কত শহর, কত গ্রাম সে ঘুরে বেরিয়েছে। কয়েক দিন পর পর গ্রামে আসত আর শহরের কথা বলত, হা করে সবাই সবটুকু গিলে নিত। বুড়োরা বলত, ভালাই গুল পারে! তার সাথে ও কি কম কথা! শুনতে শুনতে কাকের শব্দেরা সব হারিয়ে যেত, বউয়ের চোখ দুটো বড় বড়! শেষে ঝোলা থেকে ছাড়ত আসল কথা,
দুলাভাই!
শহরে চলেন,একবার গেলে আর আইতে মন চাইব না, কসম! হেরপরও ভালা না লাগলে আমি নিজেই আবার আপনেগো এইখানে দিয়া যামু। লাজুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত বউ, বউ তখন এমন মুখরা ছিল না। শালা বলে যেত, না অয় চলেন আমার লগে, কয়দিন ঘুইরা আবার আমার লগে আয়া পড়বেন। ভালা লাগলে থাকবেন, নাইলে না।শালার সব কথাই কাক ঠোঁটের আগায় ধরা চালের কণার মত উড়িয়ে দিত। কেন যাবে সে শহরে হ্যা, কেন যাবে?
এ গ্রাম তার দেশ, এখানের সবকিছুই তার নিজের। কা কা করলেই এখানে সলিমের বউ উঠোনে এটা - ওটা ছিটিয়ে দেয়। কুট কুট করে খায় কাক আর শালিক, তা দেখে সলিমের বউ মুচকি হাসে। ব্যাপারির বাড়ীর পিছনের জঙ্গলে পড়ে থাকে হরেক রকম মাছ, মাছ গুলোর কি টেস্ট, কি গন্ধ! কাকেরা এই মাছে এক ঠোঁকর, ওই মাছে আরেক ঠোঁকর। সবাই মিলে চলে ঠোকরা - ঠুকরি খেলা। বাচ্চা মুরগি বাটে পেলেই ছোঁ মেরে খাওয়া, কি মজা! ঘাসের ভিতর লুকিয়ে থাকা পোকাদের চট করে তুলে নেয়া, পোকারা তখন ঠোঁটের চিপায় উথাল - পাতাল নড়ে - চড়ে। নদীর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় টলটলা পানিতে নিজেকে দেখে তার বড্ড ভাল লাগে। এসব ছেড়ে - ছুড়ে কেন শহরে যাবে সে? অ্যাঁ?
তবুও একদিন কাকটিকে শহরের কথা ভাবতে হল। শহর হতে বিশাল মোচলা এক আদমি এল, দড়ির মত শক্ত পাকানো,সবাই তাকে শফিক সাহেব বলত,শফিক সাহেব শুধু হাসত। তার সাথে সবসময় থাকত দু - তিন জন লোক, তাদের ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝুলে থাকত।শফিক সাহেব বললেন, এবার আর কারো দুঃখ থাকবে না, সবাই হাসবে। সলিম, মফিজ, আবুল, আলমগীর, করিম আর ওদের সাথে থাকা ১০ - ২০ জন লোক শফিক সাহেবের প্রতিটা কথায় হাসত,তালি দিত, হাত কচলাত। তারপর তাদের টিনের চালা ইটের দালান হয়ে গেল, সলিমের বউকে তখন ছাঁদে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখা যেত। তাদের হাসি সকালের রোদের মত যেখানে - সেখানে লেপ্টে যেতে লাগল। সিকদার বাড়ির ২ যুবক একদিন ইরেজার দিয়ে শফিক সাহেবের হাসি মুছে দিল।পরের দিন তারা পেটের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে নদীর পাড়ে পড়ে রইল। তখন শকুন - শকুনিরাও গ্রাম ছেড়ে চলে গেল।
আতশবাজির মত মিলিয়ে গেল ব্যাপারি, পিছনের জঙ্গলে মাছ আর থাকে না। সিকদার পাড়ার লোকেরা একে একে কোথায় যেন চলে গেল।তখন থেকে কাকেরা মুরগী দেখে না, গরু দেখে না, মেঘের দিকে চেয়ে থাকা রাখাল - বালক রাও একদিন কই উবে গেল! খোলা জায়গাগুলো সব ইটের ভিতর, সাইনবোর্ডে মালিক আবুল মফিজদের নাম।
যে সব বাড়ির উঠোনে কাকেরা টুক টুক করে খেত, এমন অনেক উঠোনই বিশাল - বিশাল পুকুর হয়ে গেল।দোয়েল, টুনি , ফিঙে বসা গাছগুলো এক নিঃশ্বাসে মাটিতে নুয়ে পড়ল। দেখতে - দেখতে সব প্রাইভেট কোম্পানি হয়ে গেল! যারা ব্যবসা বুঝে তারা শফিক সাহেবের সাথে হাসতে লাগল। হাহাহা, হো হো হো। শফিক সাহেব বললেন, নদীর পাঁড়ে মিল করতাছি ভাইসব! কোন চিন্তা নাই। বেকার থাকবে না কেউ। টাকা কামাবে সবাই! কাকেরা অবাক হয়ে দেখল, মিলের মেশিনের হা করা মুখ নদীর মত পানি বের করে। তখন অনেক টিউবওয়েলে পানি নেই, জমির পানিতে চলে এল নুন,ভেঙ্গে গেল অনেক ধানের শীষ ।এ পানি খেয়ে কাকের মার পালক পড়ে যেতে লাগল,হঠাৎ একদিন দপ করে শ্যাষ! এভাবে আরো অনেক কাঁক মরে গেল । খালের পানি শুকিয়ে গেল , তার কাদা- মাটিতে থাকে মরা চিংড়ি। নদী ও ধীরে ধীরে মাছ দেয়া কমিয়ে দিল। তখন জেলেরা হারিয়ে গেল , কামার - কুমোর পালিয়ে গেল । একদিন নদীর পানিতে কাক তার ছায়া দেখতে পেল না। পানি যে কাকের চেয়েও কালো!
শরীর ও আত্মার সবকটা জানালা যখন বন্ধ হয়ে গেল , কা্ক তখন গ্রাম ছাড়ার ডিসিশান নিল।
তংবং বলল , কোন সমস্যা নাই দুলাভাই , আগ্রাবাদের সর্দারের লগে আমার ভালা খায় - খাতির , দেইখেন আপনেরে কেমুন তূয়াজ করে ! তারপর একদিন কাক দম্পতি শালা সমেত শহরে চলে এল । যখন এল , তখন দুপুর। তংবং ওদেরকে একটা ডাস্টবিনে নিয়ে এল । খেতে খেতে তংবং মুরগীর মাংসের একটা টুকরার দিকে তাদের কে ইঙ্গিত করল।
- খায়া দেহেন আপা - দুলাভাই ! এই ডারে গ্রিল কয় ! কি নেই ডাস্টবিনে! হরেক পদের খাবার। অনেক দিন পর কোন ঝুট - ঝামেলা ছাড়াই কাক দম্পতি পেট টা ভরে খেল । কি সোয়াদ প্রতিটা খাবারের!
তুই বুঝি রেগুলারই ভালা - মন্দ খাস ? আহ্লাদী কন্ঠে ভাইকে জিজ্ঞেস করে কাকের বউ।
তা আর কইতে - তৃপ্তি ভরা মুখে শালা বলল।
পেট ভরে খেয়ে তিন জনেরই মনে তখন ফুরফুরা ভাব।
আহা , তুমি যদি আগেই আমার ভাইয়ের কথা হুন তা। এদ্দিন হুদ্দাই কষ্ট পাইলাম ! - কাকের প্রতি আবদারে অভিযোগ হানে বউ ।প্রত্যুত্তরে কাক চোখ টিপ দেয়! তংবং খুশিতে কয়েকবার কা - কা ডাকার পর বলল, চলেন দুলাভাই ! সর্দারের কাছে যাই। তারপর তিন জনই হেলে দুলে উড়তে লাগল , কিছুদূর গিয়েই একটা বৈদ্যুতিক তারে চড়ে বসল তংবং।
' আহেন এনে একটু জিরাই। তার খালি দুলব , সিরাম মজা দুলাভাই ! আসলেই। সম্পূর্ণ অন্যরকম অনুভুতি হল কাকের। লিলুয়া বাতাস পুরো গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সবার মন টা আউলা করে দিল।
শালা গান ধরল -
দুনিয়াটা মস্ত বড়
খাও - দাও ফুর্তি কর!
হঠাৎ বিকট শব্দে কখন যে তার ছেড়ে রাস্তার পাশের বিল্ডিঙটায় চলে এল কাক বলতেও পারল না । ঝাড়া ২ - ৩ মিনিট কি হল কিছুই স্মরণ করতে পারল না সে। বাপের জন্মেও সে এমন শব্দ শুনেনি। ইতিমধ্যে অনেক গুলো কাক ডেকে ডেকে নরক গুলজার করে ফেলেছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে ডান দিকে তাকাতে ই বউকে দেখতে পেল, তখনো বেচারি কাঁপছে। তারপর শালার কথা খেয়াল হল, তংবং কই? এদিক - ওদিক তাকিয়ে চোখ টা রাস্তার দিকে যেতেই সোজা নিচে নেমে এল সে , রাস্তায় তার আদরের শালা মরে লেপ্টে আছে । হতবাক হয়ে সে তংবং এর দিকে তাকিয়ে থাকে - কি হইতে কি হইয়া গেল!
এই আহো যাই গা - বউয়ের ডাকে বাস্তবে ফিরে কাক।
কই যামু ? - বউকে জিজ্ঞেস করে কাক । তার মাথা এখনো কাজ করছে না ।
- কই যামু মানে ? এহনো বাসা পাই নাই , সন্ধ্যা হইয়া যাইব একটু পর । কই থাকুম আমরা!
- কিন্তু তোমার ভাই ? ওর লাশের কি হইব!
- মাথা - মুথা দেহি পুরাই গেছে তুমার! ওর ব্যবস্থা সিটি কর্পোরেশন করব ।
- তুমি ক্যামনে জান ?
- আমার ভাই ই একদিন কইছিল খিয়াল নাই ? রাস্তার কাউয়ার লেইগা সিটি কর্পোরেশন আর মাইনসের লেইগা আনজুমানে মফিদুল ! ওহন লও , খাড়াই থাইক্কা কাম নাই।
এভাবে হুট করে মরে তংবং বড়ই ফ্যাসাদে ফেলে দিল । এখন ওরা কই যায় , কি করে !? এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে , অস্থির হয়ে উড়ার গতি বাড়িয়ে দেয় দুজনেই।
মরার আর টাইম - টিবল পাইল না! আমাগো সিস্টেম কইরা দিয়া না ওয় মরতি ! - গজ গজ করে বলতে থাকে বউ।
ভাগ্যক্রমে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই একটা ডাবগাছের দিকে তাদের নজর গেল , খালি আছে।সেখানেই নীড় বাধল ওরা । পরদিন সকাল না হতে না হতেই তাদের ডাবগাছে ডেরা বাধার খবর মহল্লার সর্দার বংচং এর কানে গেল । মহল্লাবাসী এতে দারুণ ক্ষ্যাপা , উইড়া আইসা জুইড়া বইছে! খেলা নি!
হালার পেটা পুটা সবডি গাইল্লা লামু - ঘোষণা দেয় এক যুবক জিদ্দি কা্ক ।
সর্দার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ।
' আমিই দেখতাছি খাড়া । বিষয়টা কি আগে মালুম অই । '' - সর্দার বলে । দুপুরের দিকে সর্দার আট - দশ জন জোয়ান কাউয়া নিয়ে ওদের বাসার দিকে উড়াল দিল । এর মধ্যেই সরদার যা ভাবার ভাবছে -''আগে হালার লেঞ্জা দেহন লাগব । হালার ব্যাকিং - বুকিং কি ! নাইলে ত আমারে না জানাইয়াই হুট কইরা কেউ বাসা বান্দনের হিম্মত করে না ! ২ - ৪ বাতচিতেই ওজন মাইপ্পা লাইতে হইব । শুরুতেই গরম গরম ডায় -লগ দিতে হইব! "
কাকের বাসায় ঢুকে তাই সর্দার কাকাঙ্কার দিয়ে উঠল - তোরা কারা?
আসলেই ত! আমরা কারা!! - কাক মনে মনে বলে উঠে ।
-আমরা কাউয়া ! - সর্দারকে বলে কাক ।
- হালার ভাই ! মদস্টিক কুনানকার !! আমরা হগলেই ত কাউয়া ! আমরা মানুষ নি ! কোত থিকা আইছস তুই ?
এর মধ্যে সর্দার টের পেয়ে গেছে কাকটা পুরাই ফাউল । সর্দার মনে মনে হেসে ঠিক করল - কথার চোটে ওকে মুতিয়ে ছাড়বে! তারপর সিরাম ছ্যাচা দিয়ে এ পাড়া ছাড়া করবে। কাকের গুবলেট অবস্থা দেখে এবার কথা বলে উঠল কাকের বউ।
' আমরা আইছি ....
কাকের বউয়ের দিকে নজর যেতেই সর্দার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ।সুন্দরী মনোহরিনী ! যৌবন সারা দেহে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। মুহূর্তেই তার গলার মরদ পারদ হয়ে গেল! এরপর বউ বলে যায় আর বংচং তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ দুটো তখন নেশায় কাই। '' ইরাম খাটি জিনিস জীবনেও দেহি নাই, এক্কেরে মাখখন !'' - মনে মনে বলে বংচং।
'' কুনু সমস্যা নাই । আইছ ভালাই করছ । গেরামে মানুস থাহেনি ! তোমা গো কেউ কিছু কইবনা। তোমরা ইনেই থাকবা ।''
- সব শুনে সে বলে।
................. উড়তে উড়তে আর ভাবতে ভাবতে আজ অনেকদূর চলে এল কাক । জায়গাটা কোথায় ? এক কাক কে জিজ্ঞেস করে জানল জায়গাটার নাম দেওয়ান বাজার । সে এখন দুপাশের বিল্ডিং এর সারির মধ্যবর্তী এক টা সরু জায়গা দিয়ে উড়ছে । এ কয়দিনে বেশ কিছু ব্যাপার জানা হয়ে গেছে তার । বিল্ডিঙের রান্নাঘরের পেছনের কার্নিশে টুকটাক খাবার পাওয়া যায়। সে অনেক ছোট ছেলেকে দেখেছে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে চুরি করে খাবার ফেলে দিতে । এসব চিপা - চাপা জায়গাগুলো কাঁকের জন্য বেশ সুবিধার । ভিড় - বাট্টা কম এখানে । টাইমিং করে চলতে পারলে গেঞ্জাম ছাড়াই কম - বেশ কিছু খাবার মেলে । এরকম একটি কার্নিশে সে একটা মাছের টুকরা পেল। গুপ গুপ করে খেতে খেতে তার নাকে চমৎকার একটা সুগন্ধ ধরা দিল । বিপরীত দিকের বিল্ডিঙের রান্নাঘর হতে গন্ধটা আসছে । সেখান হতে কিছু সুগন্ধ নিজের দিকে টেনে নিল সে। শহরের মানুষের এ জিনিষটা তার খুব ভাল লাগে। রানতে গেলেই মাতাল গন্ধ ছড়ায় ! পারে বটে ! এবার কাক তার চোখদুটো ঐ রান্না ঘরের দিকে ঘুরাল । দেখল এক মহিলা রান্না করছে আবার তার দিকে ও তাকিয়ে আছে ! হঠাৎ সে মহিলার একটা হাত উঁচু হতে দেখল। সতর্ক হয়ে গেল কাকের সারা শরীর । ব্যাপার কি - কিছু ছুড়ে মারবে নাকি?
মানুষের এই ব্যাপার টা কাকের খুব খারাপ লাগে। খাবার সময় , বা এমনিতেও মানুষ কাককে বড্ড ডিস্টার্ব করে । দেখলেই খালি তাড়ায় । কিছুতেই স্থির হতে দেয় না । মহিলা ঠিকই কাকের দিকে কিছু একটা ছুড়ে মারল । সতর্ক থাকায় কাক সরে গেল । জিনিসটা কার্নিশে পড়ল । ওমা ! এ ত মাছের টুকরা । একটু আগের টেনে নেয়া গন্ধ মাছের টুকরা হতে আরো স্পীডে বেরুচ্ছে । টুকরাটায় তেল চকচক করছে ।গরম । কাক চটপট খেয়ে নিল । দারুণ একটা তৃপ্তি পেল খেয়ে , সেই শহরে আসার প্রথম দিনের মত । খাওয়া শেষে আবার ওই রান্নাঘরের দিকে তাকাল । দেখল মহিলা টা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । মন টা বড় ভাল হয়ে গেল কাঁকের । অনেকদিন হয়ে গেল তার দিকে তাকিয়ে কেউ হাসেনি । বউ ও না । সলিমের বউয়ের কথা মনে পড়ল । কেমন খিলখিল করে হাসত !
বাসায় এসে দেখে বংচং এসে বসে আছে , বউ রিন রিন করে যেন কি বলছিল - তাকে দেখেই থেমে গেল। থামলেও , নিজেই যেন ফুর্তিতে উছলে পড়ছে এরকম মনে হল তার ।
কি মিয়াভাই , এহনো শহরের বাও - বুও বুঝো নাই ? - সর্দার বলে।
''দুই দিন বাদে ছাও বাইর হইব । এমুন টাইমে বউ গো বেশি খানা পিনা দেয়ন লাগে । হুনলাম তেমুন নাকি খাবার - টাবার জোগাড় করতে পার না ? ''
এ কথা শুনে বউয়ের দিকে তাকাল কাক । বউ অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
- শহরে কি খানার অভাব আছে মিয়া ! একটু চালাক - চতুর হও। কেউ কিছু কইলে আমারে কইবা । যাক আইজ কিছু খাওন লইয়া আইলাম তুমার বউয়ের লাইগা । আমাগো মহল্লায় আইছ আমাগো এক টা দায়িত্ব আছে না!
সর্দার চলে যাবার পর বউ মুরগীর মাংসের একটা টুকরা বের করে দিল - চিকেন কারী ! - সর্দার আনছে , খাও !
কাকের প্রথমে খেতে মন চাইল না । সে ঠিক করল সে টুকরাটাকে পা দিয়ে লাথি দেবে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ঠিক তখনই খিদায় পেট টা মোচড় দিয়ে উঠল তার। সে মাথা নিচু করে খেয়ে নিল।
দুই দিন পর সে প্রথমবারের মত বাবা হল। সর্দার আর তার লোকেরা বাসায় অনেক খাবার আনল। এই কয়দিন তার আর বাইরে বেরুনোর দরকার হল না। বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে দেখেই সে দিন পার করল। এই সময়টুকু তার অনেক সুখের মনে হল। বাচ্চা টা কেমন কুত কুত করে , কত নরম , কত অসহায় ! মা যখন তার কচি ভিতর খাবার ভরে দেয়, তখন এই দৃশ্য টা দেখতে তার বড় ভাল লাগে । তার তখন মার কথা মনে হয় । মাও একদিন তাকে ডানা দিয়ে আগলে রাখত । বাচ্চাটা একটু বড় হতেই তাকে খাবারের খোঁজে বেরুতে হল । বিধিবাম , সে যেখানেই যায় , কাঁকেরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। কোন খাবার মুখে নিলেও চার পাঁচ জন ঘিরে ধরে তাকে, ঠোকর মেরে মেরে খাবার ছিনিয়ে নেয়।কাকের কান্না পায়।
সর্দারকে কমু সব! - ওদেরকে বলল কাক।
যা যা ! বল গা - তুই কি করবি আমরা দেহুম। - কাকেরা ভেঙচিয়ে হেসে নেচে ঠোঁট কেলিয়ে বলে।
মন খারাপ করে সে তখন বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে দেখে বংচং! সর্দার বলে উঠে, কি মিয়াভাই! তুমারে এমুন পেরেশান লাগে ক্যান ?
- এর একটা বিহিত করন লাগব সর্দার। যিনেই যাই তুমার পুলাপাইন খাড়াইতে দেয় না, আমার মুখের খাবার কাইড়া নিছে, সারাদিন কিছু খাই নাই - বলতে বলতে কেঁদে ফেলে কাক।
আহা! - বংচং দুঃখে চুক চুক করে। আমি হগলতেরে কইয়া দিমু,বোঝনা,তুমি ত গাইয়া! তাই হগলে একটু মশকরা করে! ইয়াং পুলাপাইন, ফাজিল একেকটা, কথাও হুনেনা! যাউজ্ঞা টেনশন লই ও না, আমি কইয়া দিমুনে, আইজ তোমার বউয়ের লাইগা কাটলেট আনছি।তুমিও দুগা খায়া লইয়।- একথা বলে সর্দার চলে যায়।
কাটলেট খেতে খেতে কাক বলে - আমি বাইরে গেলেই বংচং আইয়া পড়ে, না ?
- ক্যান, তুমার লগে জোড়া নি, তুমি থাকলেও কি না থাকলে ও কি! ওই ব্যাডা কি তোমারে ডরাইয়া আইব ? - বউ মুখ ঝামটা মেরে বসে ।
কথা ঠিক। সর্দার মানুষ ! আমি কোন রাজার পুত , আমারে জিগান লাগব ! - মনে মনে এ কথা ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে কাক।
এর পর কয়েকদিন হুবুহু একই ঘটনা ঘটল। সে কোথাও খাবার পায় না , বেহুদা এদিক - সেদিক ঘুরে ঘুরে ঘরে এলেই দেখা মিলে বংচং এর। সে বুঝে গেছে সব বংচং এর চাল , ঘরের বউয়ের কাছে বেপদা মরদ বানাবার ফন্দি । একদিন বাসায় এসে দেখল বউয়ের গলার নিচের তিলে সর্দারের ঠোঁট লেগে আছে! তাকে দেখে দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
- '' বুঝলা , তুমার বউয়ের গলার নিচে ছোট পোক আটকাই গেছিল , মাইয়া মাইনসের শইল ত , পুক - টুক বেশি বহে ! বাইর করলাম !! আজ সর্দার চড়ুই পাখির মাংস এনেছে।
সর্দার চলে গেলে মাংসের একটা টুকরা কাকের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে , খা , বাদাইম্মা, খা!
'' কেমুন জামাই আমার , আমার কথা বাদই দিলাম , নিজের পুলার লেইগাও কিছু আনতে পারে না । -
কাক ছেলের দিকে তাকাল । এর মধ্যে ছেলে কিছুটা বড় হয়েছে । ঘুমিয়ে আছে এখন সে।
ক্যান !তুমার ত বংচং আছে ! -কাক ফোঁস করে উঠে।
ও ! হিংসা লাগে, না? এই বেডা না থাকলে কি অবস্থা হইত আমাগো, একবার ভাবছ? না খাইয়া মরণ লাগত !
কাঁক কিছু বলে না । রাত গভীর হলে সে বউকে এ পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার প্রস্তাব দেয় ।
- কও কি ! এত ভালা জায়গা ছাইড়া যামু কিল্লাইগা ? -বউ চোখ উলটে ফেলে ।
- থাকুম না । তোমার দিকে বংচং এর নজর পড়ছে । আমি বুঝি এইসব । - কাক বলে ।
- হেইডা ত আমিও বুঝি। কিন্তু কই যাইবা? অন্য হানেও কি এমুন সুন্দর জায়গা পামু ? তুমি কি রেগুলার খাওন জোগাড় করতে পারবা ? ইনে ত না খাইয়া থাকন লাগে না , ডিস্টার্ব করে না , অন্য হানে যদি ক্যাচালে পড়ি ?
ঠিক ! কাক তখন গভীর ভাবনায় ডুবে পরে। এর মধ্যে শহরের অনেক জায়গায় ই ত ঘুরল সে । সব জায়গাতেই কম্পিটিশন । আর কম্পিটিশন মানেই আমি গাইয়া ভুতের হার! - বিরক্ত হয়ে ভাবে সে।
অন্য জায়গাতেও গেলে যে সে স্বর্গ পেয়ে যাবে এমন নয় ।সুন্দরী বউ মানেই বিপদ ! তখন হয়ত এক রাক্ষসের বদলে দশ খোক্ষস জুটতে পারে । এমন সময় তার সেই মাছ দেয়া মহিলার কথা মনে পড়ে ।ওখানে গেলেও পারে সে ! কিন্তু ওদিকে কি সবসময় এমন পাওয়া যাবে ? নাহ ! আরো কয়েকদিন দেখা যাক তাইলে ! - মনে মনে বলে কাক ।
পরেরদিন উঠেই সে ওই এলাকায় যাওয়ার জন্য ঊড়াল দিল । কয়েকবার রাস্তা ভুল করলেও অবশেষে পৌছাতে পারল সে । আগের বার মনে হয় এমন টাইমেই এসেছিলাম । - ভাবে কাঁক।কার্নিশে এসে দাঁড়াতেই রান্নারত অবস্থায় সেই মহিলাকে দেখা গেল ।মহিলাকে দেখেই মনে আনন্দ - অনুরণ অনুভব করল সে । সে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে । মহিলা এখনো তাকে খেয়াল করছে না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে কা কা বলে ডাক দিল । এবার মহিলা তাকাল। মহিলা কাক কে দেখেই কিন্তু চিনতে পারল , গলার নিচে বড় একটা দাগ দেখে । কিছুদিন আগে এই কাকই এসেছিল ! কাকটিকে দেখে মহিলার মুখ কেন জানি উজ্জ্বল হয়ে গেল । তিনি কাঁকের দিকে একটা মুরগির টুকরা ছুড়ে দিলেন । খাওয়া শুরু করতেই হঠাৎ ইটের একটা টুকরা কাকের পেটে আঘাত হানল ।প্রচণ্ড ব্যাথা পেয়ে কাক কোঁত করে উঠল । মহিলা , যাকে সবাই এখন বাবলুর মা বলে ডাকে ,পুরো দৃশ্যটাই দেখতে পেলেন । কিছু একটা আন্দাজ করে তিনি পাশের রুমে গেলেন । ওই রুমের জানালাটাও কার্নিশ বরাবর । যা ভেবেছিলেন তাই , তার ছেলে বাবলু গুলতি দিয়ে কাকের গায়ে ইটের টুকরা মেরেছে । রেগে উম্মাদ হয়ে গেলেন তিনি , তার হাত - মুখ থরথর করে কাঁপছে । বাবলুকে তিনি কষে চড় লাগালেন । চড় খেয়ে বাবলুর মন খুব খারাপ হল । সামান্য একটা কাকের জন্য মা তাকে মারল ! তিনি মনে মনে বাবলুর হয়ে কাকের কাছে ক্ষমা চাইলেন । কাকটি বাবলুকে ভালভাবেই চিনে নিল ।
তারপর হতে প্রতিদিনই এদিকে চলে আসে কাক, সন্ধ্যায় ফেরে। জানে বাসায় খাবার অভাব নেই , বংচং আছে।এর মধ্যেও সে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। কিভাবে আসবে ! ওখানে ৩ -৪ দিন যেতেই আরো কয়েকটি কাঁক ভিড় জমাতে শুরু করল । তখন আর মহিলা খাবার দেয় না । বসে থাকতে থাকতে তখন অন্য কাকেরা বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যায় । যখন সে ছাড়া আর কেউ থাকে না , তখনি মহিলা খাবার ছুড়ে মারে । সে দ্রুত মুখে পুরে নেয় । অন্য কাকেরা কিন্তু বুঝে গেছে এখানে তাদের বেইল নাই । এর প্রতিশোধ তারা অন্যভাবে নেয় । গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে তারা । কাককে আসতে দেখলেই তারা দৌড়ানি দেয় । তাদের হাত হতে পালাতে এত জোরে দৌড়াতে হয় যে বাসায় ফেরা মাত্রই তার খিদে পায় । তারপরও ব্যাপারটা মজা লাগে তার । এতগুলা কাক তাকে ঠোকর দিতে চায় , ধাওয়া দেয় তবুও একবারের জন্য ছুঁতে পারে না । হাজার হোক গাইয়া ত !
এই একটা কম্পিটিশনে সে বারবার জিতে যায় ।খাওয়ার সময়টাতেও শান্তি নেই । বাবলুর দিকে একটা চোখ রাখতে হয় । মার অগোচরে সে ইটের টুকরা,পাথর ইত্যাদি ছুঁড়ে মারে। দিন দিন টুকরাগুলোর সাইজ বড় হচ্ছে। তবে একটা ঢিল ও সে লাগাতে পারে না । এসবে কাকের অভ্যাস আছে । গ্রামেও কোন দুষ্টু ছেলে পুলে তাকে ঢিল লাগাতে পারে নি । অথচ এখনি কোন সিদ্ধান্ত না নিলে দেরি হয়ে যাবে সেটাও সে বুঝতে পারে।
বউ একদিন জিজ্ঞেস করে বংচং যে বারবার আসে সে বিরক্ত হয় কিনা। কাক চুপ থাকে ।
বউ আবার বলে , বুঝলা , ব্যাডায় খুউব দুখী , খুউব একা , আমার কাছে কইয়া একডু হাল্কা অয় । -কাক কোন উত্তর দেয় না । তার বলায় কি বা আসে যায় !
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখে তার বউ ছেলে কেউ নেই । পরদিন সাত সকালেই কয়েকটা কাক তার বাসায় আসল ।
কি মিয়া ! তোমার বউ বিলে সর্দারের লগে ভাইজ্ঞা গেছে ? - হাসি চেপে রেখে ওরা বলে , কাক কোন উত্তর দেয় না , চুপ করে থাকে ।
বেশ কয়েকদিন কাক ঝিম মেরে থাকল , তেমন কোথাও গেল না।ওদিকে ওই মহিলাও প্রতিদিন কার্নিশের দিকে তাকিয়ে থাকে । কাক আসে না । এ কাকটাকে কেন জানি তার ভাল লেগে গেছে। কাকের কালো চোখটায় বড় মায়া! তিনি খেয়াল করেছেন কাকটা ঠিক ১২.৩০ এ আসে । এ সময় টায় তার খোকন ও স্কুল হতে ফিরত । এসেই বলত - মা কি আছে দেও ! কি আছে দেও ! ছেলেটা একদিন হারিয়ে গেল । কই গেল আমার ছেলে ? লোকজনের মুখে শুনেছে , স্কুল গেটে এক লোক খোকনকে বলেছিল , আইসক্রিম খাবে খোকা ? তারপর আর কেউ খোকনকে দেখেনি । খোকা কি আমার আইসক্রিম এর মত গলে গেছে ! তাই বাবলুকে আর বাইরে বেরোতে দেয়া হয়না। কাক টাও কি আমার ছেলের মত ............. তাই যেদিন কাককে মহিলা আবার দেখতে পেল , অনেক খুশি হল । কাকটার জন্য বাবলুর মা ছাগলের মাংসের একটা টুকরা রেখে দিয়েছিল , সেটা ছুড়ে দিল । কিন্তু অবাক কান্ড । কাক তা ছুঁয়েও দেখছেনা । সে সোজা মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে ।
আজ সে এতদূর এসেছে শুধু বাবলুর মাকে দেখার জন্য । আগে ও আসত , তবে সেই সাথে খাওয়ার প্রত্যাশাও রাখত । আজ সে ঠিক করেই এসেছে কিছু খাবে না , শুধু মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কাক কি শুধু খাওয়ার জন্য বাঁচে ? তাই আজ তাকে যা দেয়া হল সেদিকে তাকালও না , বরং বিরক্ত হল । কি ভাবে মহিলা ? এখানে কি শুধু সে খাওয়ার জন্যই আসে ? জানালা দিয়ে বাবলুর মা তাকিয়ে আছে। তিনি বিস্মিত । অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পর ও কাকটা কিছু খাচ্ছেনা , তার দিকে তাকিয়ে আছে । বাবলুর মার খোকনের কথা মনে পড়ে গেল । খোকনও তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকত । আম্মু আমার দিকে তাকাও ! আমি ঘুমাব ! আম্মু এদিকে তাকাও ! আম্মু এদিকে তাকাও ! হঠাৎ তিনি ডানে - বামের বিল্ডিংগুলোয় চোখ বুলিয়ে দেখলেন কেউ আছে কিনা ! তারপর কাকটার দিকে ইশারা করলেন।
সে প্রথমে অবাক হয়ে গেল, বিশ্বাস করতে পারছে না , মহিলা কি তার দিকেই ইশারা করছে ? বার বার ইশারা দেখে কাক এবার বুঝতে পারল । সোজা এগিয়ে গিয়ে জানালার হুকে পা রাখল। গ্রিল থেকে মহিলা বের করে দিল হাত , সে হাত কাকের সারা শরীরে পরম মমতায় ঘুরাঘুরি করল । বাবলুর মায়ের স্পর্শ পেয়ে অনেকদিন পর কাকের কাল চোখে লিচুর রসের মত জল টল টল করল । কাকের বুকটা হু হু করে উঠল , তিরতির করে কাঁপছে দেহের প্রতিটা পালক । মহিলার সাথে , একজন মানুষের সাথে কিছু কথা বলতে জীবনে প্রথম বারের মত ইচ্ছে হল । মহিলাকে তার মার মত মনে হল , মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হল , বলতে ইচ্ছে হল , মা ! মার পর জীবনে আর কোথাও মায়া পাইনি , মায়ার জন্যই ত কাকেরা বেঁচে থাকে ! কোথাও কেউ এতটুকু ভালবাসা দেখায়নি , যাপিত জীবনের নিরব দহন ফাঁদে শুধু আটকে গেছি । আপনি ত মানুষ , মানুষ আমাদের ঘৃণা করে , দূর দূর করে , আমাদের অপছন্দ করে , আপনি কেন আমায় এমন ভাবে ভালবাসতে গেলেন , মায়া লাগাতে গেলেন । বঞ্চনার মরুভূমিতে এ কেমন একফোঁটা বারি ! বুকের খাঁচা হতে উৎসারিত শব্দমালা উত্তাল সাগরের মত বের হতে চাইল , কিন্তু সে জানে মানুষ শুধু তার কা কা শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাবে না ।কাক এটাও জানে , তাদের কা কা শব্দ মানুষ অনেক অপছন্দ করে ।প্রকাশের অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাকের বুকের খাচাটা দুমড়ে - মুচড়ে যেতে লাগল । শুধু মহিলা যখন শেষবারের মত হাত বুলিয়ে নিল তখন তার হাত সে ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিল । বিশ্ববিধাতার প্রতি বড্ড অভিমান হল তার । মানুষের পাশে যার নিত্য বসবাস , তার নেই মানুষের সাথে কথা বলার এতটুকু অধিকার । বাবলুর মার চোখেও কেন জানি অশ্রু টল মল করছে । হাতের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় তিনি নীরব ভাষার তরঙ্গ বইয়ে দিলেন ,যে ভাষার অন্তমর্ম,সুর , তাল , লয় তার নিজেরই অনেকটা অজানা ।
গলির মুখে আজ আর সে অন্য কাকেদের ফাঁকি দিল না , তারা ঠোকর মেরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চামড়া ছিলে দিল , ঝরে গেল অনেক পালক । বাসায় এসে কাক টি আর কয়েকদিন বের হলনা ,তেমন খানা - পিনে করলনা , শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল সে । তবু আজ তার মনে দুঃখ নেই , মনে জ্বলে উঠেছে তৃপ্তিপ্রদীপ , সে একদম ফেলনা নয় , নয় অবাঞ্চিত , সে সামান্য হলেও খাঁটি ভালবাসা পেয়েছে । বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় তার । কত ভালবাসত তার বউকে ! কথায় কথায় বউ বলত আমি তোমার জন্য জীবন দিয়ে দিব । আহারে বউ , জীবনের প্রথম ভালবাসা !কতবার দুজন মিলে একসাথে পাড়ি দিয়েছে নদী , নদীর বুকে পড়েছে দুজনের মিলিত ছায়া। ছোট ছোট পোকাগুলো দুজনে ভাগ করে খেয়েছে ,ঠোঁটে - ঠোঁটে হয়েছে কতবার ভালবাসা বিনিময় । তখন দুজনের ঠোঁটে - মুখে - মনে ভালবাসা ছাড়া আর কিছু ছিলনা । না ! এখানে থাকলে সে পাগল হয়ে যাব , মরতে হয় নিজের দেশে গিয়ে মরব - এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কাক ।
নিদিষ্ট দিনে কার্নিশে হাজির হয় সে,বাবলুর মা তখন রান্না করছে। কাকটিকে দেখে মহিলা প্রচণ্ড খুশি হয়ে হেসে দিলেন, সেদিনের পর হতে তিনি আর কাকের দেখা পাননি। তারপর কাঁকটির জন্য ফ্রিজে রাখা বিরিয়ানি আনতে গেলেন।ওদিকে পাশের রুমের জানালা দিয়ে বাবলু কাকটিকে দেখামাত্রই নিজের ভেতরের জমে থাকা ক্রোধে উম্মাদ হয়ে গেল।- এই কাউয়া মার ভালবাসায় ভাগ নিছে! জমিয়ে রাখা পাথরের টুকরাগুলো হতে, একটি বড় সাইজের পাথর বাবলু তুলে নিল।
কাকটি তখন অস্থির হয়ে গেছে, কই গেলেন উনি? কই গেলেন? শেষবারের মত দেখতে যে খুব মন চাইছে! তখুনি কাকটির ইন্দ্রিয় সাড়া দিল, একটি পাথরের টুকরা তার দিকে এগিয়ে আসছে।এই প্রথমবারের মত কাঁকটি নড়ল না, এগিয়ে আসা পাথরটার দিকে সোজা তাকিয়ে রইল। টুকরাটা মাথায় আঘাত করল, কার্নিশে বিছিয়ে রাখা পায়ের আঙ্গুলগুলো আলগা হয়ে প্রচণ্ড গতিতে শরীরটা উলটে ঠোঁট - মাথা আকাশের দিকে গেল ঘুরে, তারপর নিচে পড়ে যেতে লাগল। শেষবারের মত ঊর্ধ্ব গগনের দিকে চাইল সে, লাভ হল না, প্রচণ্ড রোদের সামিয়ানা ঢেকে দিল তার চোখের আকাশ।নিচে নেমে পড়া দেহটায় বেজে উঠল প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।
কিছুক্ষণ পর, তার জাত ভাইয়েরা - বেঁচে থাকতে যারা তার কোন খবরই নেয়নি , সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:৩৮