


মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্যবসা। বাংলাদেশে নিন্দিত হলেও বিশ্বজুড়ে এই ব্যবসা নন্দিত এবং এই ব্যবসা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশে এই ব্যবসা নিন্দিত হবার পেছনে প্রচুর কারণ রয়েছে। সবগুলো নিয়ে আলোচনা করলে কখনই শেষ হবেনা।
তবে বিডিতে এই ব্যবসা সম্পূর্ণ ত্রুটিযুক্ত উপায়ে চলছে এবং সেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেনা বিধায় এইসব সমস্যা হচ্ছে এই ব্যবসা নিয়ে। অথচ এই ব্যবসার শক্তি যে কতটা তা যদি আমরা বিশ্বের ব্যবসায়িক ডাটার দিকে তাকাই তবে খুব সহজেই আমাদের চোখে ধরা পড়বে।
আমাদের দেশে যতগুলো কোম্পানী আছে তাদের মধ্যে ডেস্টিনি-২০০০ লিমিটেড ই একমাত্র এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই গ্রোথের পেছনে কত যে দুই নম্বরী এবং ধান্দাবাজি চলেছে এবং স্টিল চলছে তা আসলে খুব কম মানুষই বাহির থেকে দেখে বুঝতে পারবে।
আমি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিফহাল নই। এই বিষয়ে আমি বিদেশ থেকে পড়াশোনাও করে আসিনি। কিন্তু আমি প্রচুর ঘাটাঘাটি করি এই বিষয়ে যার কারণে এই ব্যবসা সংক্রান্ত অনেক তথ্য আমি যোগাড় করতে পেরেছি এবং সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
আমি ব্লগে এই ব্যবসা সম্পর্কে মানুষকে আহবান করার জন্য লিখছিনা। দয়া করে কেউ সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে ভূত খুঁজতে যাবেন না। আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আমি এই ব্যবসা সম্পর্কে সচেতন হবার আহবান জানাচ্ছি। বিডিতে যেসব কোম্পানী ব্যবসা করছে তারা যে কিভাবে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে এবং কিভাবে যে সমাজের স্থিতিশীলতাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা যদি মানুষ না বুঝতে পারে তবে প্রতিনিয়ত মানুষ এসব ধোঁকাবাজদের কবলে পড়ে নিজেদের সর্বস্ব খোয়াবে।
টাকা-পয়সা জীবনে বড় জিনিস নয়। মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ হচ্ছে সময়। এই ব্যবসার পেছনে সময় ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত যদি দেখা যায় যে এই ব্যবসাটায় খুঁত আছে তবে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হতে পারে সেটি হচ্ছে মূল্যবান সময়ের অপচয়।
FTC বা Federal Trade Commission হচ্ছে আমেরিকান সরকারের একটি independent agency. এই সংস্থার মূল কাজ হচ্ছে consumer protection বা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা।
এই FTC মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসার ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে দিয়েছে এবং কিভাবে একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানীকে এর বৈধতার বিচার করতে হবে সেটিও উল্লেখ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। যদিও এই রিপোর্টগুলো অনেক আগে থেকেই সেখানে আছে তবুও যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছে সেহেতু তারা এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নয়। যার কারণে সত্যিকারের এমএলএম ব্যবসার নিয়ম-নীতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান একেবারেই নেই বললেই চলে। ফলশ্রুতিতে তারা প্রতিনিয়ত ধান্দাবাজদের শিকার হচ্ছে এবং এইসব অন্যায় আচরণের সাথে নিজেদের জড়াচ্ছে।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এবং পিরামিড স্কীমের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। এই পিরামিড স্কীম শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, এটা সকলের জন্যই ক্ষতিকর। বিশেষ করে এর দ্বারা একটি সমাজব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আমরা যদি পিরামিড স্কীম এবং সত্যিকারের এমএলএম কোম্পানীর মধ্যে ফারাকটা বুঝতে পারি তবেই আমাদের সকল সন্দেহ দূর হবে।
পিরামিড স্কীম এবং এমএলএম ব্যবসার তফাৎ নিয়ে FTC এর একটি রিপোর্ট আছে। আমি সেই রিপোর্টের মূল অংশের বাংলা অনুবাদের চেষ্টা করলাম। মূল আইডিয়াটার পাশাপাশি আমি সেটার একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যাতে সবার বুঝতে সুবিধে হয়।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
বিশ্বায়ন এবং শিল্পায়নের বর্তমান যুগে পিরামিড স্কীমগুলো এত বিভিন্ন চেহারায় এবং বিভিন্ন কাঠামোতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যে তাদেরকে শনাক্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিটি পিরামিড স্কীম কোম্পানীর একটি সাধারণ শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার মাধ্যমে একে চেনা যায়। বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে:
১. মূলত নতুন মানুষকে সদস্য হিসেবে যোগদান করাতে পারলে এরা এদের বর্তমান সদস্যদেরকে কমিশন দেয়।
২. নতুন সদস্য যোগদান করলে বর্তমান সদস্যরা যে কমিশন পায় তা কোন সত্যিকারের বিনিয়োগ কার্যক্রম বা প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয়ের কার্যক্রম থেকে আসেনা।
দ্বিতীয় পয়েন্টটি নিয়েই মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দ্বিধা তৈরী হয় এবং মানুষ ফলশ্রুতিতে অনেক পিরামিড স্কীমের আসল রূপ চিনতে পারেনা।
কিছু কিছু কোম্পানীর কার্যক্রমে দেখা যায় যে তারা পণ্য বিক্রয় করছে। কিন্তু সেই পণ্য মূলত মানুষের চোখকে ফাঁকি দেবার জন্য এবং কোম্পানীর সত্যিকারের চেহারাকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
যদি কোন কোম্পানী তাদের কার্যক্রমে পণ্য অন্তর্ভুক্ত করেও থাকে তবেও সেটি পিরামিড স্কীম হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোম্পানীকে বিচার করার জন্য মূলত দুটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে:
১. তালিকাভুক্ত পণ্য মজুদকরণ
২. খুচরা বিক্রয়ের অনুপস্থিতি
এবার এ দুটো বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক :
* তালিকাভুক্ত পণ্য মজুদকরণ : একটি কোম্পানীতে একটি পণ্য থাকতে পারে অথবা একাধিক পণ্যও থাকতে পারে। পণ্যের সংখ্যা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে কোম্পানীটি তাদের সদস্যদের দ্বারা পণ্য মজুদ করাচ্ছে কিনা। যদি কোন কোম্পানীর কমিশন প্ল্যান এমনভাবে সাজানো থাকে যে কোম্পানীতে পণ্য বিপণনকারী হিসেবে কাজ করতে হলে প্রথমে কোম্পানীর সদস্য হতে হবে এবং সদস্য হবার সময় প্রয়োজনের চেয়েও অত্যধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় করতে হবে তবে সেটা পিরামিড স্কীম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
অত্যধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় করার মানে এই নয় যে দামী পণ্য ক্রয় করা। এর অর্থ হচ্ছে লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয় করা এবং লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয় করতে হলে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হয়। যদি কেউ লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয় করে এবং অত:পর তার নিজের বাসায় পণ্য মজুদ করে রাখে তবেই সেটাকে তালিকাভুক্ত পণ্য মজুদকরণ বলা হয়।
যখন এভাবে অসংখ্য মানুষ পণ্য মজুদকরণের মাধ্যমে কোন একটি নির্দিষ্ট কোম্পানীর সদস্যপদ লাভ করে তখনই সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরী হয়। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ সদস্যই বেপরোয়া হয়ে তাদের মজুদকৃত পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা করতে থাকে। যখন সেটা সম্ভব হয়না তখন সদস্যরা তাদের মজুদকৃত পণ্য কোম্পানী কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বাহিরে বিক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানীর ব্যবসা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় কোম্পানীর সদস্যরা। বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন দামে পণ্য বিক্রয় করার কারণে সেই পণ্যের বাজার ধসে পড়ে। পরবর্তীতে সেই পণ্য বাজারে বিক্রয় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
মজার বিষয় হচ্ছে যদি এই ধরনের পণ্য মজুদকরণ এবং পরবর্তীতে কম মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের ঘটনা কোন একটি কোম্পানীর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিপণন ব্যবস্থায় ঘটতে থাকে তবে পিরামিডের ওপরের স্তরের সদস্যরা কল্পনাতীতভাবে লাভবান হয় যদিও এক্ষেত্রে কোন পণ্য বাজারে বা প্রকৃত ভোক্তার নিকট পৌঁছায় না।
এই অশুভ চক্র পিরামিডের যে কোন স্তরেই শুরু হোক না কেন, সাধারণত পিরামিডের একেবারে নিচের স্তরের সদস্যরাই প্রতারণার শিকার হয় কারণ তাদেরকে লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয়ে অধিকাংশ সময়ই প্ররোচিত করা হয়। যখন তারা এই অন্যায় আচরণের শিকার হয় তখন তারাও নতুন মানুষকে সদস্য হিসেবে যোগদান করানোর সময় লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয় এবং সেই পণ্য মজুদকরণে চাপ সৃষ্টি করে। এবং সেক্ষেত্রে কোন নতুন মানুষ যদি পণ্য মজুদকরণের ফাঁদে পা দেয় তখন পুনরায় তাদেরকে ওপরের স্তর থেকে উদ্বুদ্ধ করা হয় একই কাজ করার জন্য।
এবার সেই নতুন সদস্য দুটো কাজ করতে পারে:
* তার নিচের স্তরে নতুন সদস্যকে যোগদান করানোর সময় লার্জ ভলিউমে পণ্য ক্রয় এবং পণ্য মজুদকরণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
* নিজের মজুদকৃত পণ্য একটি একটি করে সাধারণ ভোক্তার কাছে বা নতুন সদস্যকে যোগদান করানোর সময় তার কাছে বিক্রয় করতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে এই নতুন সদস্য দ্বিতীয় কাজটি তথা মজুদকৃত পণ্য সাধারণ ভোক্তার নিকট বিক্রয়ে বাধাগ্রস্ত হয় কেননা পিরামিডের ওপরের স্তরের সদস্যরা তাদের নিজেদের মজুদকৃত পণ্য ইতিপূর্বেই কম মূল্যে বিক্রয় করে পণ্যের বাজারদর ধ্বংস করে রেখেছে। যখন সেই নতুন সদস্য পুরো বিষয়টা বুঝতে পারে তখন সে নতুন মানুষকে সদস্য হিসেবে যোগদান করার সময় বলতে বাধ্য হয় যে বাহির থেকে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করলে শুধু পণ্যই পাওয়া যাবে কিন্তু পরবর্তীতে কোম্পানী থেকে কমিশন আয়ের সুযোগ থাকবেনা যেহেতু বাহির থেকে কম মূল্যের পণ্য কিনলে কোম্পানীতে কোন সদস্যপদ তৈরী হয়না। শুধু তাই নয়, সেই নতুন সদস্য উপায়ান্তর না দেখে তার নিজের মজুদকৃত পণ্যও কম মূল্যে বিক্রয়ে বাধ্য হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় নিজের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার লক্ষ্যে সেও পুরো অন্যায়টির পুনরাবৃত্তি করতে থাকে অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত প্রথম কাজটি করে। এভাবে পিরামিডের প্রতিটি স্তরে এই অশুভ কার্যক্রম চলতে থাকে। ফলশ্রুতিতে কোম্পানীর ব্যবসায়িক কার্যক্রম অবধারিতভাবেই ভেঙে পড়ে এবং সকল সদস্য মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
চলবে............