যুগে যুগে আলেমদেরই এক শ্রেণি আল্লাহর দ্বীনের ভিতরে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন: “মানুষ ছিল এক উম্মত (এক জাতি)। অত:পর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরুপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করতে। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অত:পর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন”। (সূরা বাকারাহ-২১৩)
এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে আল্লামা বাগবী তার তাফসীরে বলেন, ইহুদী খ্রিস্টানদের ইখতিলাফটা দুই ধরণের ছিল-
এক. তারা কিতাবের কিছু অংশ মানতে আর কিছু অংশে কুফরি করতে। তারা বলতো আমরা কিছু মানি কিছু মানিনা। দুই. তারা আল্লাহর কিতাবের তাহরীফ বা বিকৃত সাধন করতো। ।
আজকে আমাদের সামাজের আলেমদের একই অবস্থা, কেউ কুরআনের কিছু অংশ মানে তার সুবিধা মতো এবং কিছু অংশকে অস্বীকার করে তার নিজস্ব মতের বিরুদ্ধে হওয়ার কারণে। আরেক দল আলেম আল্লাহর কুরআনের বিকৃতি সাধন করে কুরআনের অর্থ ঘুরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ. বলেন, দুই দল মানুষ কুরআন পড়তে গিয়ে গোমরাহ হয়।
প্রথম দল: ঐসকল লোকেরা যারা পূর্ব থেকেই একটি বিশেষ আক্বীদা ও বিশ্বাস ধারণ করে আছে, অত:পর যখনই কুরআনের কোন আয়াত সামনে আসে তখন তারা চেষ্ট করে ঐ আয়াতটি তাদের আক্বীদার পক্ষে দলীল হিসেবে ব্যবহার করতে। অর্থাৎ এ জাতীয় লোকেরা একটি বিশেষ দল বা তরিকার রঙ্গিন চশমা দিয়ে কুরআন-হাদিসকে গবেষণা করে। তারা সবসময় চেষ্ট করে কুরআনের আয়াতকে তাদের আক্বিদাহ ও বিশ্বাসের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করতে। যদি কোন আয়াত তাদের দলীয় মতের বিপক্ষে যায় তাহলে সে আয়াতকে তাদের দলীয় আলেম ও পীর-বুযুর্গেদের অপব্যাখ্যার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, দুমড়িয়ে, মুচড়িয়ে নিজেদের স্বপক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয় দল: ঐ সকল লোকেরা যারা শুধুমাত্র আয়াতের শাব্দিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করেই তফসীর করে থাকে যেভাবে সাধারণ একজন আরবী লোকের কথার তাফসীর করা হয়। অথচ তারা চিন্তা করে না যে, এ কুরআন কে নাজিল করেছেন? কার উপর নাজিল করেছেন? কাদেরকে সম্বোধন করে নাজিল করা হয়েছে?
আর এ দুটি কাজ এক শ্রেণির আলেমরাই করে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেনঃ “নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশত: যারা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিত রুপ আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত।(সুরা আলে ইমরান-১৯)
এসব আয়াতে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুগে যুগে বিজ্ঞ আলেমদেরই একটি শ্রেণি মুসলিম জাতিকে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত করেছে।
সুতারাং কোন বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে কোন আলেম/বুজুর্গ বা বড় বড় [মুফতী মুহাদ্দেস সাহেবদের দোহাই না দিয়ে কুরআন-সুন্নাহ যা বলে তাই সঠিক বলে গ্রহণ করা উচিত। হকের কথা বললেই-‘অমুক আলেম কি বললেন’ বা ‘অমুক পীর সাহেব কি কম বুঝেন? এগুলো বলা যাবে না। বরং কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী যা সত্য তার অনুসরণ করতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘হে ইমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলুল আমর’ তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যার্পন কর যদি তোমারা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিনতির দিক থেকে উত্তম। (সূরা নিসা-৫৯)
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল স. এর আনুগত্যের ক্ষেত্রে উভয় স্থানেই (আতি’উ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ‘উলুল আমর’ এর ক্ষেত্রে (আতি’উ)শব্দ ব্যবহার করা হয় নি। কারণ উলুল আমরের আনুগত্য স্বতন্ত্র নয়; বরং তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল স. এর আনুগত্যের অধীনে থাকবে, ততক্ষণই কেবল তারা ‘উলূল আমর’ বলে বিবেচিত হবেন। আর কেউ যদি আল্লহ ও তাঁর রাসূলের স. তথা কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন বিধান অনুসরণ করে সে ‘উলূল আমর’ নয়। বরং সে ‘উলুল খাম্র’ (মাতাল)।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের শাসকদের চাটুকার, তাগুতের পা-চাটা গোলাম এক শ্রেণির ‘ওলামায়ে ছু’ এই আয়াত দিয়ে বর্তমান শাসকদের আনুগত্য করাকে ফরয বলে দাবী করে। তারা বলে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলূল আমর’ তাদের। আর উলুল আমরের ব্যাখ্যায় বেশীর ভাগ মুফাচ্ছিরগণ শাসকদের উদ্দেশ্য করেছেন। অতএব শাসকদের আনুগত্য করা কুরআনের এই আয়াত অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজে আইন।
এই জ্ঞানপাপী তথা-কথিত আলেমদের জানা উচিত যে, উলূল আমরে’র আনুগত্য করাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের অধীনে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা যদি নিজেরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে এবং কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাহলেই কেবলমাত্র তারা উলূল আমর বলে বিবেচিত হবে এবং তাদের আনুগত্য করতে হবে। আর যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করে এবং কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক দেশ শাসন না করে তাহলে তারা কুরআনে বর্ণিত ‘উলুল আমর’ নয় বরং তারা হলো ‘উলূল খাম্র’ (মদের হেফাজতকারী)। তাদের আনুগত্য করা ফরজ হওয়াতো দুরের কথা বরং তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদেরকে অমান্য করা, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা ফরজে আইন হয়ে যায়।
সুতারং দেখবেন, যে যেই দলের তার কাছে সেই দলের বাইরে কিছুই পাবেনা না। তাবলীগ ওয়ালাদের কাছে আপনি একখানা কুরআনের অনুবাদ/তাফসীরের বই পাবেন না। কিন্তু মসজিদে মসজিদে ফাজায়েলে আমলের কিতাব ঠিকই পাবেন।পীর সাহেবদের দেখবেন তারা ওয়াজ নসীহতের নামে শুধু পীরের বয়ান দিয়েই আলোচনার ইতি টানেন।মূল কুরআন হাদিসের আলোচনা তো নেই বরং মুসলমানের ঐক্য বিনষ্টমূলক আলোচনা করে মানুষদেরকে দরবার মুখী করাই হলো তাদের একমাত্র কাজ। আর এটা না হলে তো তারা মাহফিলের আয়োজন করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে না।