(আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, গল্পটি আমি ছোটো বেলায় কোথাও পড়েছি। স্মৃতি থেকে নিজের ভাষায় পরিবেশন করলাম, আপনাদের আনন্দদানের নিমিত্তে।)
তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার। বড় দু'ভাই বিয়ে-থা করেছে, ছেলে-পুলেও আছে। ছোট ভাইটি উচ্চশিক্ষার পাট শেষ করে ভালো চাকুরী করছে। যথারীতি যৌথ পরিবারে দুই বৌয়ের মধ্যে প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এসবের মাঝেই বড় দু'ভাই চাইছেন ছোট ভাইটিকে বিয়ে দিতে। বাড়ি এলেই বড় ভাইয়েরা এবং ভাবীরা প্রতিবারই ছোটভাইটাকে অনুরোধ করে, সে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যায়। খুব চেপে ধরলে বলে, বড় দুই ভাবীই তো সারাদিন বাড়ি মাথায় তুলে রাখছে। আরেকটাকে আনলে তো বাড়িতে আর তিষ্ঠোনো যাবেনা। কাজ নেই বিয়ে করে। ভাইয়েরা বলেন, তুই তোর রুচি মতো পছন্দ কর, আমরা আপত্তি করবোনা। ভাবীরা বলেন, আমরা তো ঝগড়াটে, তুই দেখে-শুনে আমাদের চেয়ে ভালো একটাকে আন, দেখি কেমন ভালো আনতে পারিস। অনেক চাপাচাপির পর ছোটভাইটি কিছু শর্ত দিয়ে বিয়ে করতে রাজি হলো। তার শর্ত হলো, সে নিজে মেয়ে ও সম্বন্ধ পছন্দ করবে, এ ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র কোন আপত্তি চলবেনা। আর আরেকটি অস্বাভাবিক শর্ত হলো, সে একা যাবে বিয়ে করতে, কোন বরযাত্রী থাকবেনা। অসন্তুষ্টচিত্তে হলেও বড় ভাইয়েরা এবং ভাবীরা তার এসব শর্ত মেনে নিল। ভাবলো, তবুও সে বিয়ে করুক। কিছুদিনের মধ্যেই ছোটো পাশের গ্রামে এক মেয়েকে পছন্দ করলো, ভাইয়েরা খবর নিয়ে তো অস্থির! মেয়ের বাবা নেই, মা ঝগড়াটে মহিলা হিসেবে সারা গ্রামে প্রসিদ্ধ। এমন মায়ের মেয়ে অতি ঝগড়াটে না হয়েই যায় না। কিন্তু একরোখা ভাইটিকে কিছু বলার সাহস কেউ পেলো না। নির্ধারিত দিনে ছোটো পূর্বাহ্নে সংগ্রহকৃত এক বুড়ো ঘোড়ায় চেপে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে সাধারণ বেশে চললো বিয়ে করতে। ভাই ও ভাবীরা হতবাক। যাক, বিয়ের পর্ব সেরেই ছোটো শাশুড়ীকে বললো, বৌ সাথে নিয়ে সে আজই বাড়ি ফিরবে। ছোটো দুর্বল বুড়ো ঘোড়াটির পিঠে পেছনে বৌকে উঠিয়ে রওনা হলো। ঘোড়াটির এতো দুর্বল অবস্থা যে নিজে হাঁটাই ওটার জন্য কষ্টকর, উপরন্তু, পিঠে দু'জন সওয়ারী। কিছুদূর গিয়েই ঘোড়াটি বরকনে সমেত হোঁচট খেয়ে পড়লো। ছোটো টেনে-হিচড়ে বৌ আর ঘোড়া, দু'জনকেই ওঠালো। তারপর ঘোড়াটির সামনে দাঁড়িয়ে বললো, একবার হলো। নতুন বৌ ভেতরে ভেতরে জ্বলছে, মুখে কথা নেই। আবার যাত্রা শুরু। কিছুদূর গিয়েই আবার পতন। একইভাবে ছোটোর চেষ্টায় বৌ এবং ঘোড়ার উত্থান এবং ঘোড়ার উদ্দেশ্যে ছোটোর উচ্চারণ, দু'বার হলো। ফের চলা। এবং স্বাভাবিকভাবে কিছুদূর না যেতেই তৃতীয়বার সম্মিলিত পতন। ছোটো নীরবে বৌকে টেনে ওঠালো, তারপর ঘোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলো, এ নিয়ে তিনবার হলো, আর না। এ বলেই ছোটো ঘোড়াটির মাথায় গুলি করলো। বৌটি, ঝগড়াটে মায়ের ঝগড়াটে মেয়ে, এ যাবত অনেক কষ্টে নীরব থাকলেও এবার আর নিশ্চুপ থাকতে পারলোনা। ঘোড়াটি অতীতে কতো সেবা দিয়েছে, দুর্বল ঘোড়াটির পিঠে সওয়ার হওয়াটা কতো অনুচিত হয়েছে, এভাবে ঘোড়াটিকে মেরে ফেলা কতো অমানবিক হয়েছে, তাবৎ বিষয়ে নববধূ এক দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে ফেললো। ছোটো নীরবে সব শুনে ভাষণশেষে শান্তভাবে বৌয়ের উদ্দেশ্যে বললো, একবার হলো। বলেই ছোটো একবারও পিছু না ফিরে বাড়িপানে হাঁটা দিলো, বৌটি ছোটোকে অনুসরণ করে শুড়শুড় করে এসে সেই যে ছোটোর ঘরে ঢুকলো, ছোটেকে আর কখনো " দু'বার হলো " বলার সুযোগ বৌটি দেয়নি। ভাইয়েরা-ভাবীরা ভেবেই পেলো না, ছোটো এ অসাধ্য কিভাবে সাধন করলো।