০.৩. ইতিহাস চেতনা: প্রেক্ষাপট মহাকাব্য
'মহাশ্মশান কাব্যের ইতিহাস চেতনা নিয়ে কোন সংশয় নেই। এই কাব্যের পূর্বে কোন মহাকাব্যই ঐতিহাসিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে রচিত হয়নি। কায়কোবাদকে এই ঐতিহাসিক দিক থেকে মৌলিক মহাকাব্য রচয়িতা এবং মহাশ্মশানকে মৌলিক মহাকাব্য বলা যায়।
কবি কায়কোবাদ মৌলিকতা দাবী করেছেন এবং তা অযৌক্তিক ছিলনা। তাঁর পূর্ববর্তী কবিগণ যেখানে পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে মহাকাব্য রচনা করে কাহিনী নির্বাচনে স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেন নি, সেখানে কায়কোবাদের এ চেষ্টা অবশ্যই প্রশংশনীয়। কায়কোবাদ ঐতিহাসিক বিষয়কে কাব্যের উপকরন করে বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছেন নতুনত্বের স্বাদ।
তবে এই কাব্যে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি প্রণয়রস সঞ্চারের জন্য কবি ইতিহাস বহির্ভূত কিছু চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন।ইতিহাসের প্রতি কবির আনুগত্য ছিল বলে কাব্যের প্রধান চরিত্র ও ঘটনা ইতিহাস আশ্রয়ী।এমন কি কবি ইতিহাস বিষয়ে পাঠকের আশংকা দূর করতে তথ্যের উৎস ও নির্দেশ করেছেন যা এরকম কাব্য রচনায় বিরল বলা যায়। এবং কাব্যের প্রয়োজনে যে সব ইতিহাস-বহির্ভূত চরিত্র এতে স্থান পেয়েছে সেগুলো মূল কাহিনী বা চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকে বিনষ্ট করেনি।
কায়কোবাদ ইতিহাসের সঙ্গে মানবহিতৈষণার সংযোগ সাধন করেছেন। মানবজাতির কল্যান কামনায় কবি ইতিহাসের গৌরবজনক তথ্যকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন। জাতীয় জীবনে তা প্রেরণার উৎস।
ডঃ কাজী আবদুল মান্নান মন্তব্য করেছেন,
''ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত আদর্শ-বীরত্ব, মহত্ব ও সর্বমানবের কল্যান কামনা মহাশ্মশান কাব্যের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিতে বিকশিত করার চেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়। এ কাব্যে পুরুষ চরিত্র যেমন ধৈর্য্যে,বীর্যে,ত্যাগে মহীয়ান, নারী চরিত্র গুলিও তেমনি প্রেমে, বীরত্বে,সেবায় মহীয়সী।''৩
ইতিহাস চেতনা কায়কোবাদের কবি মানসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস জাতীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নিজের ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া মানে নিজেকে ভুলে যাওয়া তাই আপন ইতিহাসকে অস্বীকার করে একটি জাতী পথ চলতে পারেনা। ইতিহাস থেকে শক্তি,সাহস,অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই একটি জাতী চলার পথে দিকনির্দেশনা পেতে পারে। ইতিহাস হল জাতীর অস্তিত্ব। আর সে ইতিহাস যদি হয় বীরত্বে, শৌর্যে-বীর্য, আত্মত্যাগে, ঐশ্বর্যে ঋদ্ধ, তবে সেই গৌরবময় ইতিহাস জাতীর জীবনে এনে দিতে পারে উজ্জ্বলতা। বিপদে ও সংকটে পতে পারে জাতীয় প্রেরণার শক্তি এবং দৃঢ় অবলম্বন। কায়কোবাদের ইতিহাস চেতনা ছিল তীব্র।
ডঃ আবুল হাসান শামসুদ্দিন মন্তব্য করেছেন,
''কায়কোবাদের ইতিহাস চেতনা ছিল,যুগের প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে তিনি সমকালের জীবন সমস্যার আলোকে উপস্থিত করেছেন- তা যত সরল ভাবেই হোক। যুগের প্রয়োজনেই তিনি অতীতের হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের চিত্রকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সৃষ্টির কাজে লাগিয়েছেন। এখানেই কায়কোবাদের আবেদন শ্বাশ্বত কালের কাছে,যদিও কালোর্ত্তীর্ণ বাক প্রতিমা তিনি তৈরি করতে পারেন নি, এমনকি কালোপযোগী রূপ-নির্মিতিও তার অনায়ত্ত ছিল।''৪
কায়কোবাদের ইতিহাস চেতনার একটি প্রধান দিক হচ্ছে, ইতিহাস সচেতনতাই নয় বরং তিনি ছিলেন ইতিহাসনিষ্ঠও। তাই কাব্যের শৈল্পিক মর্যাদা রক্ষার্থেও তিনি ইতিহাসের প্রকৃত সত্য বা তথ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ব্যাক্তিজীবনকে সত্যনিষ্ঠ ভাবে দেখে অভ্যস্ত কবি ইতিহাসকে সাহিত্যে এনে কোথাও বিকৃত করেন নি। বরং প্রকৃত সত্য ও তথ্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অসীম ধৈর্য্য ও শ্রম স্বীকার করে।
'মহররম শরীফ' কাব্যটি তার বাস্তব প্রমান। 'মহাশ্মশান' ও 'মহররম শরীফ'-এ দুটি কাব্যের মধ্যেই কায়কোবাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম শ্রম গেছে। এই দুটি কাব্যেই তিনি ইতিহাস ও সত্যনিষ্ঠার চূড়ান্ত আবেগ দেখিয়েছেন।
নবীনসেনের 'পলাশীর যুদ্ধ' যোগীন্দ্রনাথ বসুর 'পৃথ্বিরাজ', 'শিবাজী'; বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাজসিংহ' ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও সেখানে ইতিহাস বিকৃতি লক্ষনীয়। নবীন সেন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে আঁকতে গিয়ে ঐতিহাসিকতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু কায়কোবাদ কোথাও ভুলক্রমেও ঐতিহাসিকতাকে লঙ্ঘন করেননি বা সেরকম কোন চেষ্টাই কবির ভেতর ছিলনা।
কবি তাঁর স্ব-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি স্বরূপ তাদের কল্যান চেয়েছেন,চেয়েছেন সমগ্র বাঙালী জাতীর মঙ্গল।
কাজী দিন মুহাম্মদ তাই বলেছেন,
'' বাংলা ও বাঙালী জাতি বলিতে ইতিপূর্বে যেমন একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা গোত্রকে বুঝান হইত।-কায়কোবাদ তাহার প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ করিয়াছেন।''
ঐতিহাসিক মানবজীবনের মহিমাকেই কবি অঙ্কন করতে চেয়েছেন এই কাব্যে। তাই 'মহাশ্মশান' ঐতিহাসিক আখ্যান কাব্যের রূপ লাভ করেছে। ১৭৬১ সালের যে সংঘর্ষ পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের অবতারনা করেছিল তাকে উপজীব্য করে এই কাব্য রচিত বলেই পাক-ভারত ইতিহাসে জাতিগোত্রের উত্থান-পতনে পানিপথের স্মৃতি জড়িয়ে আছে কঠিন ভাবেই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে পাক-ভারতের ঐতিহাসিক গতিধারার যে পরিবর্তন তা কবির মনে গভীর আবেগ সৃষ্টি করেছিল। পানিপথের যুদ্ধ শুধু রাজায় রাজায় নয়, যুদ্ধের তান্ডবলীলায় কত মানব-মানবীর জীবনে যে অপরিসীম ব্যার্থতার হাহাকার সৃষ্টি হয় তা চিরকাল ঐতিহাসিকের অগোচরেই রয়ে যায়। পুরুষের সংগ্রামের পেছনে নারীর আত্মত্যাগের মহান কথা কোনদিন ই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়না। থেকে যায় মানব সমাজের অজ্ঞাতেই। এ বেদনা ব্যক্ত করতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার কথা বলাই যাই,
''কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি,কত বোন দিল সেবা
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?''
কায়কোবাদ তার বিপুল কাব্যের মধ্যে একদিকে যেমন পানিপথ প্রান্তরের ভয়াবহ রূপ অঙ্কিত করেছেন, অন্যদিকে পানিপথে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের পরিনতিকেও করুন ও মর্মান্তিকরূপে চিত্রিত করেছেন-তা যেমন জাতীয় জীবনে তেমনি ব্যাক্তি জীবনেও গুরুত্ব বহন করে।
'মহাশ্মশান' কাব্যে কবি প্রেরণার প্রধানত দুটি ধারা দেখা যায়-
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে দুটি বৃহৎ ঐতিহ্যবান জাতির সংঘাত এবং সেই সংঘাতে সৃষ্ট ব্যক্তিজীবনে বিপুল ব্যর্থতা।
হিন্দু ও মুসলমান জাতীর বলবীর্য এবং ঐশ্বর্য বর্ণনা যেমন তাঁর কাব্যের বিরাট অংশ অধিকার করেছে, তেমনি ইব্রাহীম-জোহরার দাম্পত্য প্রণয়ে নৈতিক দ্বন্দ্ব, আতা খাঁ-হিরনের একনিষ্ঠ প্রেম, সেলিনার অপূর্ব আত্মত্যাগ এবং লবঙ্গ-রত্নাজীর আদর্শের ঐক্য ও প্রেমের গভীরতাকেও তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন সব ঘটনার ঊর্ধ্বে।
তাঁর কাব্যে মহাশ্মশান শুধু ভারতের দুটি জাতির জীবনেই নয়, কতগুলো নর-নারীর জীবনেও। পানিপথ প্রান্তরে অনুষ্ঠিত যুদ্ধ-যজ্ঞ কবিকল্পনাকে অদ্ভুত উপায়ে উজ্জীবিত করেছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় 'মহাশ্মশান' কাব্যের ভূমিকাতে বলা কবির নিজের কথায়।
কবি বলেন,
''পানিপথ বড়ই ভীষণ প্রান্তর; ইহার রেনুতে রেনুতে বিপুল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ ও অস্থিমজ্জা ইহার সহিত মিশিয়া গিয়াছে।কত পতিহীন দুঃখিনী রমনীর মর্মভেদী দীর্ঘনিঃশ্বাসে ও তপ্ত অশ্রুজলে ইহা রঞ্জিত হইয়াছে,কত পুত্রহীন জনক জননীর ভীষণ আর্তনাদে ইহা প্রতিধ্বনিত ও স্তম্ভিত হইয়াছে।''
কাব্যের শুরুতে কবির কৈফিয়ত অংশে এবং সমালোচকদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়,মহাশ্মশান কবির ঐকান্তিক সত্যনিষ্ঠা এ ঐতিহাসিক সত্য প্রমানের তীব্রতায় কাব্যাকারে ইতিহাস হয়ে উঠেছে। কারন কবি সচেতনভাবেই কাব্যের শৈল্পিক দিকে লক্ষ্য না রেখে ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কাব্যে তাঁর ইতিহাস চেতনাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:০৫