somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের গল্প

০৬ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কি মনে করে দরজা খোলা পেয়ে ঢুকেছিলাম। সোহমের ঘর লাগানোই থাকে। কচিৎ এ বাসায় এলেও ভুল করেও আমি সোহমের ঘরের দিকে উঁকি দিইনা। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়।
খুব বাচ্চা বেলায় এ বাসায় এলে সারাক্ষন তার কোলে বসে থাকতাম। এখন আমার পনেরো। কোলে বসার কথা ভাবতেই কান লাল হয়ে যাচ্ছে। সোহমের বাবা আমাদের পাড়া সম্পর্কীয় চাচা। চাচীর মেয়ে নেই বলেই কি না কে জানে আমাদের তিন বোনকেই ভীষন ভালবাসেন। আমাদের তিনজনের বয়সের তফাৎ পাঁচ ছয়। মাঝখানে আমি।
বিকেল বেলা যখন আম্মু গুটুর গুটুর করে চাচীর সঙ্গে গল্প করতেন একদিন হঠাৎ শুনলাম চাচী বলছে ভাবী আপনার টুপু কে কিন্তু আমি ছেলের বৌ করবো। টুপু আমাদের বড় বোন। সোহম তখন কলেজে পড়ে। আমি কেবল ক্লাস টু শেষ করেছি। আমার কষ্টে বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের বাসায় গেলাম। সোহম কেবল কলেজ থেকে ফিরেছে। সেদিন সম্ভবত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ছিল। গোসল করে বের হয়ে খেতে বসবে আমি গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়া শুরু করলাম। সে বাথরুম থেকে চিল্লাচ্ছে কে কে বলে! আমি আবার ছোট বেলা থেকেই ওকে নাম ধরে ডাকি। সুন্দর করে সোহম বলতে পারতাম না কেটে ছেঁটে সোম বলতাম। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম ,সোম তুমি খবরদার টুপুকে বিয়ে করবানা। তুমি যদি টুপু কে বিয়ে করো আমি কিন্তু মরে যাব।

তখন বোধ হয় বাংলা সিনেমা সদ্য দেখা শুরু করেছিলাম।
সময় মত একটা ডায়লগ দিতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম নিশ্চয়।
পরের দিন থেকে কি হল? কলেজ যাবার আগে সোম আমাদের বাড়ি এসে আম্মুকে বলে গেল খবরদার ঝুমু কে একটুও বকবেন না চাচী। আমার আমানত আপনার কাছে রেখে কলেজে যাচ্ছি। সবাই হাসছে। এমন কি টুপুও আমাকে খেপানো শুরু করলো!
ইস্কুল থেকে ফিরেই আমি চাচীর কোলের মধ্যে এসে ঢুকতাম। কি রান্না হচ্ছে। সোম কোনটা খাবে আমি কোনটা খাব সব তদারকির দ্বায়িত্ব যেন আমি নিজেই নিজের কাঁধে নিয়ে ফেললাম।
চাচীও খুব মজা পেত। এই ঝাঁকাটা ওই সেল্ফে রেখে আয় মা। পেঁয়াজ নিয়ে আয়তো। ওখান থেকে বটিটা দে। এসব কাজ তখন আমার সংসারের কাজ। আর ফুরসত পেলে কয়েক মিনিটের জন্য আমাদের বাসায় যেতাম। আম্মু বকা দিতো। স্কুল থেকে ফিরেই দৌড়াতে হবে? খাওয়া নাই গোসল নাই পড়া নাই? আবার পালিয়ে আসতাম। আর সোম কলেজ থেকে ফিরলেই কোলের ভিতর ঢুকে সব অভিযোগ আম্মু আজ বকেছে।
আমার হলুদ জামাটা কাঁটায় বিঁধে গেলো পলিদের বাড়ি যাচ্ছিলাম যখন। ছিঁড়ে গেলো আর আম্মু বকেছে। আমি কি ইচ্ছে করে ছিঁড়েছি। সোম তুমি কিন্তু আরেকটা হলুদ জামা কিনে দিবা।
আমার আবদার আহ্লাদ অভিযোগ সব কিছুই সোমের কাছে। ও গোসলে যেত আমি দরজার কাছে টাওয়েল ধরে দাঁড়ায় থাকতাম। এসবই ছোট বেলার কথা।

বছর তিন চারেকের মাথায় আমার আহ্লাদ ভাবটা কমে গেলো। আর ভীষণ রকম লজ্জা এসে ভর করলো। চাচী মাঝে মাঝেই বাড়ি বয়ে অভিযোগ আনে। ভাবি আমার ছেলের বৌ তো এখন থেকেই আমার খোঁজ রাখেনা।
আমি লজ্জায় ঘরের কোনে লুকিয়ে থাকি। রাস্তায় হঠাৎ করে সোহমের সাথে দেখা হয়ে গেলে আমি মুখ নিচু করে থাকি। আর সব রক্ত তখন আমার দু গালে এসে জমে যায়। আমার কান গরম হতে থাকে। ওদের বাসায় আসি যখন সোহম থাকেনা। তারপরও মাঝে মাঝে দেখা হয়ে গেলে সোহম হাসতে হাসতে বলে আমার ঝুমু বৌ দেখি আমার আর কোন যত্নই করেনা। মা তুমি ঝুমুকে কিছু বলেছো? ও আসেনা! ওকে আর দেখিনা কেন? ওরা হাসতে থাকে আমি পালিয়ে বাঁচি।

আমি তখন ক্লাস এইটে উঠেছি কেবল। একদিন টের পেলাম টুপু প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে হাতের মধ্যে কি লুকিয়ে এনেছে। খুব ঘামছে। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ফেললো। আম্মু বাথরুমে ছিল। আমি সবই খেয়াল করলাম। ওর গোপন জিনিস রাখার জায়গা টা আমার চেনা। আমি মাঝে মাঝেই দেখি। সম্ভবত টুপু জানেনা। টুপু ইন্টার দিবে। খুব চাপ। সকাল বিকাল প্রাইভেট কোচিং! রাত জেগে গুন গুন করে পড়ে। আব্বু একটা চমৎকার নীল রং এর টেবিল ল্যাম্প কিনে দিয়েছে টুপুকে।

পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আমার খুব কষ্ট হল। আমি অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর ঘুরলাম, আলমারীর ভেতর থেকে অযথায় আমার কাপড় রাখার তাক থেকে সব কাপড় নামালাম। গোছানো জিনিস আবার গোছালাম। শুধু শুধু বইয়ের পাতা উল্টালাম। পরের দিন সকালে টুপু প্রাইভেটে গেলে দেখলাম চিঠিটা সোহমের।

আমি ছোট বেলা থেকেই টুপু কে দেখতে পারতাম না। কোনদিন আদর করে আপু ডাকিনি। আর তখন তো শত্রু মনে হতে লাগলো। টুপুর থেকে আমি সুন্দরী ছিলাম এটা ছোট বেলা থেকেই আমার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। পাড়া পড়শী আত্মীয় স্বজন এক বাক্যে প্রশংসা করে। মাঝে মাঝে আমার মনে হতে লাগলো সোহম কি করে এত বড় ভুল করলো? আমি বড় হিংসুটে হয়ে গেলাম সেদিন থেকে।
টুপুর সাথে কথা বন্ধ করে দিলাম। এক ঘরে থাকি কিন্তু সে আমার অচেনা কেউ। প্রথম প্রথম টুপু প্রশ্ন করতো। আম্মুকে নালিশ দিতো। আমি শুধু বলতাম আমার কথা বলতে ভাল লাগেনা। আমার সমস্ত অভিমান জমা হতে লাগলো সোহমের প্রতি।
পড়ালেখা বাড়িয়ে দিলাম। আমি খুব দ্রুত বড় হতে চাইতাম।

পুরো তিন বছর আমি একদিনের জন্যেও সোহমের বাড়ি যাইনি। চাচী কতবার ডেকেছে! ওই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি চাচীর বাড়ি গেছে আমাদের ছোট বোন নুপুর। আমার ভাবতে হাসি পায় নুপুর কি সোহমের বৌ হবে বলে ভাবে!

দুদিন আগে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। গতকাল আমার মনে হয়েছে এবার হয়ত সোহমের সামনে দাঁড়ানো যায়। সোহম দু বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করছে। বাসায় টুপুর বিয়ের কথা হচ্ছে এক লন্ডন প্রবাসীর সাথে। খেতে বসে আম্মু বলছিলো ছেলেটা নাকি টুপুর কোন বান্ধবীর বিয়েতে টুপু কে দেখেছে। টুপু বলেছে তার অনার্স শেষ হতে আরো দু বছর। সে বিয়ে করবেনা। আব্বু শুনে রাগ করেছে। ভাল পাত্র সবসময় পাওয়া যায়না।

আজ হঠাৎ করে সোহমের ঘরে এতদিন পর ঢুকে কেমন অদ্ভুত লাগছে। ঘরের সব কিছু অচেনা। নতুন একটা খাট। আগের টা ছিল পূর্ব-পশ্চিমে শোয়ানো। আর এখন উত্তর দক্ষিনে আড়াআড়ি পাতা।
টেবিলে চমৎকার একটা ফ্লাওয়ার ভাস। বেগুনি রঙ এর গ্লাডিওলাসে সাজানো। নীল পর্দায় দারুন আলো আসছে ঘরের ভেতর। আমি চেয়ার টা টেনে বসতে যাব এমন সময় সোহম ঘরে ঢুকেই চমকে গেছে। পেছন থেকে আমাকে বোঝেনি হয়ত। কে!
আমি আস্তে করে মুখটা ফিরিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম।
আমি এখন বড় হয়েছি। এরকম একটা আত্মবিশ্বাস ই হয়ত আমাকে বড় করে তুলেছিলো। সোম কি কিছু বুঝতে পারছে। মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন। আমি কত দীর্ঘ দিন শুধু জানালা দিয়ে ওর ঘর ছেড়ে বেরুবার সময় ওকে দেখেছি। আর দু একদির টুপুর সাথে রিকশায়। এসব আমি মনে রাখিনি।

সময়টাকে স্বাভাবিক করতেই যেন অস্বাভাবিক দ্রুততায় সোহম হাসলো। কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছিলো। খুব মনোযোগ ছিল আমার দৃষ্টিতে। অবাক হয়ে দেখলাম সোহমের মুগ্ধ চোখ। সে হাসতে হাসতে বলেই ফেললো কি রে ঝুমু? তুই তো দেখি প্রিন্সেস হয়ে গেছিস তিন বছরের মধ্যে। সর্বনাশ! এখন নিশ্চয় চ্যাপা শুটকি সোহম কে তোর পছন্দ হবেনা। তোর জন্য তো দেখি সত্যিকারের রাজপুত্র লাগবে!

আমার শুনতে ভীষন ভাল লাগছিলো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম লজ্জায়!
ভেবেছিলাম বলবো তুমি ভুলে গেছো ? তোমাকে না বলেছিলাম টুপুকে বিয়ে করলে আমি মরে যাবো?
তা না বলে বললাম, সোহম ভাই তোমার চাকরির কি খবর?
গতকাল একটা ইন্টারভিউ ছিল। ভালই হয়েছে এখন দেখা যাক। তোর কি খবর? পরীক্ষা তো শেষ। এখন কি করবি?
আমি আস্তে পা ফেলে বেরিয়ে আসছিলাম। দরজার কাছে এসে কি মনে করে ঘুরে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে করছিলো অন্যরকম কিছু করতে। ভাবছিলাম এখন যদি এক লাফে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি খুব কি অশালীন হবে? তারপর জমানো কান্না দিয়ে ভিজিয়ে ফেললাম বুকের কাছটা। হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে অভিযোগ করলাম না হয়, কেন তুমি টুপু কে চিঠি দেবে কেন?

একটু হেসে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম।

আমি তখন ও জানতাম না পরবর্তী ছ মাসের মাথায় ধুমধাম করে বাসায় একটা বিয়ের আয়োজন হবে। আর টুপু সত্যিই সোহমের বৌ হয়ে যাবে!

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১২ রাত ৮:৩৮
৭০টি মন্তব্য ৭১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×