আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। লেখা ভর্তি কাগজের ওপর জল পড়লে যেভাবে কালি ছড়িয়ে যায়। আকাশের গায়ে হয়ত তেমনি পড়েছে দু এক ফোটা। সূর্য উঠবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। কিছু কিছু মেঘ বাংগী রঙের। সালাউদ্দিন সাহেবের ঘরটা বেশ। জানালায় রঙীন থাই। তা দিয়ে আকাশ দেখা যায় চমৎকার।
সারারাত ঘুম হয়নি । চোখ জ্বালা করছে। আশ্বীন মাস, কোথায় একটু ঠান্ডা থাকবে ! ঢাকা শহরটাই এমন। মাথার উপর বোঁ বোঁ করে ফ্যান ঘুরছে তবু ভ্যাপসা গরমে বার বার গলার কাছটা ভিজে যাচ্ছে। চিটচিটে বালিশটা দু একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করা যায়। নাহ ভাল লাগছেনা। ওযু করে এসে নামাজ টা পড়ে নিলেন সালাউদ্দিন সাহেব। মাজার পেছন দিকটা একটু একটু ব্যাথা করছে। ঠান্ডা পানি লাগিয়ে মনে হচ্ছে একটু আরাম হল। মনের অস্থিরতা কমতে শুরু করেছে। প্রার্থনায় শান্তি পাওয়া যায়। অবশ্য নামাজ টা সবসময় পড়া হয়না। পায়ে কাপড়ের জুতোটা গলিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন তিনি।
ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেন চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে।
এই সাত সকালে কত বিচিত্র রকমের মানুষ যে এখানে আসে! ভাবতে ভালই লাগে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রথম প্রথম দু এক দিন জড়তা ছিল। এখন বেশ ভালই লাগে। বেশিরভাগ মানুষের মুখ চেনা। রাস্তার ধার ধরে সারি বেধে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি তে চড়ে মানুষ জন আসে। মোটর বাইকের সংখ্যাও নেহাত কম না। সকালের মিঠে রোদে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই কাঁচা বাজার টা সেরে ফেলেন তিনি।
আজ মকবুল সাহেব আসেন নি। কি জানি ঘুম থেকে উঠতে পারেন নি হয়ত। অথবা হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। কাতরাচ্ছেন আর ব্যস্ত বৌকে সেঁদ করে দিতে সাধছেন। একটু মন খুলে গল্প করা যেত কিছুক্ষন! হলনা। এখনো বছর সাতেক চাকরি আছে । তারপর এল,পি, আর এ যেতে হবে।
গত দু'দিন বাড়ি মেজবানে ভর্তি। বয়স বাড়লে মানুসের মেজাজ খিটমিটে হয় তাই বলে নিজের মেয়েরে মেজবান ভাবা যে অন্যায় তা আর না বললেও হয়। নিজের উপর বিরক্তিতে মন ভরে যায়।
আজ ঠিক বিয়াল্লিশ দিন! মাগরেবের নামাজ পড়ে বুক ব্যাথা , গ্যাসের ওষুধ একটা খাইয়েছিল বোধ হয় বড় ছেলের বৌটা। তার কিছুক্ষন পরেই মুখে ফেনা উঠে তার স্ত্রী রমিজা মারা গেল। তখন তিনি বাড়িতেই। উপর তলার ফ্ল্যাটে এক ডাক্তার থাকেন। তাঁকে ডেকে আনার পর তিনি দেখে বিমর্ষ মুখে বললেন ডেড! আচ্ছা ডাক্তার রা কি আসলেই দুঃখ বোধ করেন নাকি মৃত্যু দেখতে দেখতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে যান! একদিন সময় সুযোগ করে কথা টা তুলতে হবে ওই ডাক্তারের সামনে।
সবজির ভ্যান থামিয়ে বড় বড় করলা কিনলেন। হাইব্রিড, তিতা একদম নাই। আলু ছাড়া শুধু পেঁয়াজ বেশি দিয়ে ভাজি করতে বলতে হবে। লাউ শাক, কলমি শাক আরো কয়েক রকম শাক আছে ভ্যানটায়। লাউ শাকের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত টেনে নিলেন । তাঁর স্ত্রীর ভীষন পছন্দের ছিল এই লাউ শাক। লাউ শাক তেল দিয়ে রান্না করতে নেই। এটা অনেকেই জানেনা। গোটা গোটা রসুনের কোয়া একটু থেঁতা করলেও হয় না করলেও হয় শাকের মধ্যে ফেলে রান্না করতে হয়। পেঁয়াজ লাগেনা। নিয়ম হল এক মুঠো কুচো চিংড়ি, লবন, এক চিমটি হলুদ দোষ কাটানোর জন্য আর রসুন ব্যাস। ধীর আঁচে সিদ্ধ হবার পর যে জিনিস তৈরি হয় তা দিয়ে গামলা খানেক ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে যে কেউ। তবে হ্যা ভাত গরম হতে হবে কিন্তু। তাঁর স্ত্রী ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত ছাড়া খেতে পারতেন না। পঁয়ত্রিশ বছর সংসার করে তাঁরও এই অভ্যেস হয়েছে।
চন্দ্রিমা উদ্যান পেরিয়ে গনভবন পেছনে ফেলে এগুতে থাকেন সালাউদ্দিন সাহেব। জায়গায় জায়গায় দুটো করে পুলিশ ডিউটি করছে। একটু পরেই হয়ত ডিউটি বদলে যাবে। সারারাতের পর তাদের চোখেও ক্লান্তির ছোঁয়া। পাশ দিয়ে ১৬/১৭ বছরের এক মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পায়ে কেডস! স্বাস্থ্য মোটার দিকে। কেমন হেলেদুলে এগুচ্ছে। এ বয়সেই কেমন শ্রান্ত মনে হয় মেয়েটাকে। তরুনীর সাথে ছিপছিপে শব্দটার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। ছোট মেয়েটার বিয়ে দিলেন ক'দিন আগে। সাত কি আট মাস বড়জোর! এর মধ্যে ফুলে ফেঁপে নিজেকে কুমড়া বানিয়ে ফেলেছে।
খুব অল্প বয়সে বাবা একবার বিয়ে দিয়েছিলেন। পড়ালেখা শেষ করে সংসার শুরুর আগেই সেই স্ত্রী মারা গিয়েছিল হুট করেই। এই স্ত্রী তাঁকে দিয়ে গেছে দীর্ঘ আনন্দময় মুহূর্ত আর তিন ছেলে তিন মেয়ে। প্রথম স্ত্রীর মুখটাও এখন আর মনে পড়েনা। আচ্ছা তিনি কি বৌ খাকি? মেয়েদের স্বামী খাকি বলে পুরুষদের এমন বলে কিনা কে জানে। ছোট দু ছেলের বিয়ে হয়নি। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের মনের কথা, সুখ দুঃখের আলাপ তিনি স্ত্রী ছাড়া কার কাছে করবেন! কি যে অদ্ভুত লাগে। সারাদিন পরিশ্রমের পর চোখ ভরা ঘুম নিয়ে বিছানায় যান। হঠাৎ তার মনে হতে থাকে পাশে কেউ শুয়ে আছে। কুটুর কুটুর করে সুপারি চিবুচ্ছে। রমিজার মুখ সারাক্ষন চলত। পান না হয় সুপারি আর সেসব না থাকলেও দারুচিনি এলাচ কিছু একটা থাকতোই।
এসব নিয়ে প্রথম প্রথম কম বচসা হয়নি।
একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুমুতে পারেন না। ভয় করতে থাকে তার। যে মানুষটা মাস দেড়েক আগেও জীবিত ছিল , চলতে ফিরতে টুক কথা নিয়ে অভিমানে কথা বন্ধ করে দিত দিব্যি তাকে নিজের হাতে আজিমপুরে শুইয়ে রেখে এসেছেন। বুকের উপর মাটির দলা ফেলে বন্ধ করে দিয়েছেন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের রাস্তা। বাঁধন দিয়ে বন্ধ করেছেন তার নড়াচড়ার পথ। নাহ ভুল হয়ে গেল। মৃত মানুষের সে ক্ষমতা থাকেনা। অথচ গভীর রাতে তিনি স্পষ্ট রমিজার শ্বাস আর শ্লেষার আওয়াজ পান।
অনুভব করতে পারেন বালিশ দখল করে শুয়ে পড়েছে রমিজা। পাশ ফিরছে। না তাকিয়েও আতঙ্কে জমে যেতে থাকেন তিনি। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা ভয়টা স্রোতের মত বইতে থাকে। সারারাত আর ঘুমাতে পারেন না। প্রত্যেকটা দিন এভাবে কাটছে। দু চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে। মনে হয় কেউ লেপ্টে কালি মাখিয়ে দিয়েছে দোরগোড়ায়।
এভাবে আর কিছুদিন গেলে তিনি নিজেই আর বাঁচবেন না। আবার বিয়ে করলে এই সমস্যা মিটবে হয়ত। কলিগরাও তেমন পরামর্শই দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা রাজি হচ্ছেনা। লোকে কি বলবে! আরে বাল লোক ধুয়ে কি পানি খাব! স্ত্রীকে তো তিনি ভালবাসতেন ই। তাই বলে এই জীবিত মুহূর্তটাকে মেরে ফেলে কিভাবে বাঁচা যায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেমেয়েরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যে দুনিয়ার যে নিয়ম। তার কথা কেউ ভাবছেনা।
তিনি ঘরে ঢুকতে পারেন না। সব খানে এক মানুষের স্মৃতি । দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের মধ্যে থম ধরে থাকে সবসময়। এভাবে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে! সারাদিন অফিসে তবু কাটে। রাত হলে মনে হয় ফুরোতেই চায়না।
রাস্তার ধারে ধারে মাঝারী সাইজের রাধাচূড়া গাছ। ফুল ফুটে আছে । দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে থাকেন সালাউদ্দিন সাহেব।
পরিশিষ্ট: সালাউদ্দিন সাহেব এখন চন্দ্রিমায় অনিয়মিত। মকবুল সাহেব রোজ আসেন।
-ভাই শুনেছেন নাকি? এ বয়সে লোকটা আবার বিয়ে করেছে। বুইড়া বয়সেও ছোঁক ছোঁক কমে নাই। কি যে আজব অবস্থা! কোথায়
ছেলেদের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌ আনবেন। তা না নিজেই বিয়ে করে বসে আছেন। এইটা কি নিজের বিয়া করার বয়স কন? এখন হইল আল্লাহ রসূলের নাম নেওনের টাইম। ছেলে মেয়েরা সব বাপের বিরুদ্ধে বুঝলেন?
এই রুস্তম এ দিকে! দু কাপ চা দিয়া যা এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:২৩