এক.
১৯৯৪ বা ১৯৯৫ সালের কথা। স্মৃতি বিভ্রাট ঘটলেও তার আগে পরের কোনো বছরের ঘটনাও হইতে পারে। ওই বছর হুমায়ূন আহমেদের একটা বই বের হয়েছিল তিথির নীল তোয়ালে নামে। সেই বইটা নিয়ে একটা তীব্র বিতর্ক উঠেছিল। সে বিতর্কটিকে ধারণ করেছিল তখনকার জামাতি এখনকার আওয়ামী ইনকিলাব পত্রিকা। উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র ইসলামে উত্তরাধীকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের হিসাবে একটু গরমিল দেখে বলেছিল তোমাদের আল্লাহর অংক জ্ঞান একটু কম। (হুমায়ূন পাঠকরা তথ্যগুলো পরীক্ষা করে দেখলে ভাল হয়।) বিতর্ক উঠেছিল মূলত এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। ওলামা-মাশায়েশ, মোল্লা মাওলানারা চিঠির পর চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইনকিলাব দফতরে। হুমায়ূন আহমেদ তসলিমা নাসরিন নন। কুরআনের গুরুতর একটি বিষয়ে বেফাঁস মন্তব্যের কারণে তার উপন্যাসের চরিত্র বা তার শাস্তির দাবি ওঠে নাই। ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ আলোচনাটিকে মডারেট করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যাতে হুজুররা বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের না করে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের একটি চরিত্রের বেফাঁস কথা হিসেবেই মূল্যায়ন করেন। তর্ক আর আগায় নাই। ফলে ঘটনাটা তেমন প্রচারও পায় নাই।
ওই ঘটনা থেকে কয়েকটা ব্যাপার আমার মাথায় এসেছিল :
১. গুরুতর আল্লাহ বা নবী বিরোধী মন্তব্যও হুজুররা ছেড়ে দিতে পারেন যদি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ মধ্যস্থতা করেন।
২. প্রয়োজনে তারা একটি মন্তব্যকে কোনো আনপড়াহ, অজ্ঞানীর মন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন আবার সিরিয়াসলি নিয়ে পানি ঘোলা করতে পারেন।
৩. কুরআনে প্রদত্ত হিসাবে যদি কোনো গরমিল থেকেও থাকে তবে তা নিয়ে কথা না বলাই ভাল। এর পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশে খুব কম প্রতিষ্ঠানেরই আছে।
দুই.
মুসলিম পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আমি কিছু জানি না। দেশে বর্তমানে প্রচলিত আইনের সঙ্গে এ আইনের সম্পর্ক কী সে বিষয়েও আমি অজ্ঞান। যদি দেশে শরিয়া আইন প্রচলিত না থাকে তাইলে মিশ্রভাবে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে বা পারিবারিক বিষয়ে ধর্মীয় আইন আবার ফৌজদারি ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে পাওয়া আইন কেন প্রচলিত থাকবে সেটাও আমি বুঝতে পারি না।
আইনের ক্ষেত্রে সমরূপতা থাকা দরকার এইটুকু মোটামুটি বোঝা যায় সাধারণ জ্ঞানে। আবার এটাও বোঝা যায়, পারিবারিক ক্ষেত্রে প্রচলিত ধর্মীয় আইনের গুরুতর সংস্কার করতে হলে সামাজিক বিপ্লব ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। সমাজের গভীর পর্যন্ত নানা প্রাতিষ্ঠানিক শেকড় বিস্তৃত হয়ে যাকে যুগের পর যুগ প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তাকে স্রেফ একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর একটা নীতি প্রণয়নের দ্বারা পরিবর্তন করার চিন্তা স্রেফ গাধামো ছাড়া কিছু নয়।
আমি এই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মানতে রাজী নই যে, সরকার জঙ্গী মোল্লা ও জঙ্গী প্রগতিশীলদের মুখোমুখি করতে নারী নীতি হাতে নিয়েছে। দেশকে একটি সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে দিয়ে তার ফায়দা তুলে তারা নিজেদের ক্ষমতার মসনদ শক্তিশালী করবে।
এই সরকারটি একটি মিশ্র সরকার। সিভিল ও মিলিটারি সমাজের সমর্থন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বার্থ, সেমি প্রগতিশীল ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদী অবস্থান, মিস গভর্নেন্স, বাজার নিয়ন্ত্রণে অদক্ষতা, ব্যবসায়ী তোষণ ও নিপীড়ন সব মিলিয়ে এ সরকার একটা মিশ্র চেহারা পেয়েছে। যে যেদিক থেকে পারে এ সুফল তুলছে বা কুফল ভোগ করছে। কেউ ঘরে মদ রাখার দায়ে জামিন অযোগ্য মামলায় ঝুলে আছে আবার কেউ মদ কারখানা করে জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাতির ইতিহাসে এমন মিক্সড মাসালা আর আসে নাই। ডান/বাম, সিভিল/মিলিটারি, প্রগতিশীল/প্রতিক্রিয়াশীল, আন্তর্জাতিক স্বার্থ/ দেশীয় স্বার্থের এমন মিশ্রন সচারচর দেখা যায় না।
সরকার অবশ্য নিজেদের বাঘ মনে করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় তারা নিজেদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সবাই দেখেছেন। পান থেকে চুন খসা তো দূরের কথা পান থেকে চুন খসতে পারে এই ভেবে অনেক বিষয়ে তারা পানে চুন লাগাতেই দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখিয়েছে। কিন্তু হুজুরদের বেলায় তারা একটু উদার। সাধারণত এই ধরনের সরকারকে প্রথম সমর্থন দেয় হুজুররা। এবার তারা পিছিয়ে গেছে। ফলে, এক ধরনের নৈকট্য ও দূরত্বের মেলবন্ধন হুজুরদের সঙ্গে সরকার অনুভব করে থাকতে পারে। পরন্তু তারা এটা ভুলে যায়নি হয়তো যে, বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী ইউনিফর্ম টুপি-পাঞ্জাবী। সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতি ধর্মানুভূতি। হুজুরদের হাতে রাইফেল থাকলে আপনি তাদের ফাঁসি দিতে পারেন। কিন্তু লাঠি থাকলে আপনাকে পিছু হটতেই হবে। ফলে, সরকার হুজুরদের মিছিলকে টুপি ফুলের বাগান মনে করে একটু সমঝেই এসেছে।
আর সরকার এও জানে যে, এনারা জনগণ নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেউ কোনো উদাহরণ দেখাতে পারবে না যে, চাল-ডাল-আলু-তেল-বেগুনের দাম বৃদ্ধির ফলে বায়তুল মোকারমে কোনোদিন কোনো অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। মানুষের ন্যায্য দ্বৈনন্দিন দাবির পক্ষে কোনো ওলামা-মাশায়েখ কখনো দাঁড়িয়েছে। তারপরও কোর্টপরা হুজুরদের জ্বালায় টুপিপরা হুজুররা সরকারের কাছে ভিড়তে পারছিল না। এই দুঃখ তাদের রাজনীতিবোধকে নিয়মিত পীড়িত করে চলেছে বলেই অনুমান হয়। শক্তিপ্রদর্শন করে রাজনীতিতে দাখিল হওয়ার চেষ্টা তারা করবে এটাই স্বাভাবিক। করেছে, সফল হয়েছে। এই প্রাথমিক সাফল্যের জন্য বায়তুল মোকাররমের হুজুরদের প্রাথমিক অভিনন্দন জানাই। তারা বিড়াল নয়, বাঘতে কেজি কেজি মরিচ খাওয়াচ্ছে এখন।
তিন.
আমার ধারণা, নারীর সমানাধিকার নীতি সরকারের সদিচ্ছারই ফল। কিন্তু সদিচ্ছা এতটাই প্রখর ছিল যে, আমাদের সোসাইটির কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় তারা ভুলে ছিলেন। তারা সোসাইটির ভেতর কোনো আলাপ আলোচনা চালু করেন নাই। কথাবার্তা বলেন নাই। সোসাসাইটিকে কোনো প্রস্তুতি নিতে দেন নাই। এই প্রস্তুতিহীনতার ফলটাই হুজুররা তুললো।
বাঙালি মুসলমানের সমাজে অধিকাংশ মানুষই আস্তিক। আল্লাহ, মহানবী, কুরআন ও হাদিসের ওপর পূর্ণ আস্থাই এই আস্তিকতার মূল লক্ষণ। এখন প্রশ্ন, কুরআনে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান আছে সে বিষয়ে ভিন্ন প্রস্তাব কেন একজন আস্তিক মুসলমান মেনে নেবেন? কোনো হুজুর যদি তাকে যুক্তি দেন যে কুরআনের বিরুদ্ধে আইন হইতেছে কুরআন বাঁচাইতে রাস্তায় নামো। তাইলে তিনি কোন যুক্তিতে হুজুরের কথা শুনবেন না?
আমার মতে, এই একটি নীতি ছাড়া আর কোনো নীতিই কুরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না। সেটা হলো, সম্পত্তিতে নারীদের সমানাধিকারের নীতি। অন্যগুলা হুজুররা যে চেঞ্জ করতে চায় তার কারণ। মাথায় যখন উঠতে পারছে তখন কাঁঠাল খাইয়া, আঠা মাখাইবার লোভ তারা সংবরণ করতে পারতেছে না।
বাঘা সরকার হোক কি বিড়াল সরকার সোসাইটির সাধারণ নিয়মের সঙ্গে যুক্ত এমন কোনো বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করতে গেলে তাকে অবশ্যই সেই সোসাইটির সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে হবে। না রাখলে কী হবে? একটা নীতি যখন কুরআনের সঙ্গে অসঙ্গত তখন পুরো নীতিই তার ভালো দিকগুলো নিয়ে খারিজ হয়ে গেল। আপাতত সরকারি ভাষায় স্থগিত। আগামী কোনো সরকার এই নীতি উঠাইতে পারবে? এই নীতি বাস্তবায়ন করতে পারবে?
নারী নীতির আম ও ছালা দুইটাই হারিয়ে গেল শুধু এই মিশ্র সরকারের মিস গভর্নেন্সে ও মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে।
চার.
সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার বিষয়ে মুসলিম আইন নিয়া মেলা কথা হইছে। অধিক বাগবিস্তার অনাবশ্যক। আমার অভিজ্ঞতার কথা শুধু বলি। আমি আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের যে রীতি দেখছি তাতে জমানো টাকা ছাড়া মেয়েরা আর কিছুই সরাসরি ভোগ করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় বাপের পক্ষে সন্তানদের জন্য জমিজমা ছাড়া জমানো টাকা রেখে যাওয়া সম্ভব হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। জমির জগতে মেয়েদের অংশগ্রহণ সামান্য। বাঙালি মুসলমান মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমি নিজ দায়িত্বে চাষবাস করতে বা ভোগদখল করতে পারেন না। ভোগদখল করে স্বামী। নামেই সম্পত্তি তার নামে হয়। ফলে, মেয়েরা এক তৃতীয়াংশ পাইলো না অর্ধেক পাইলো তাতে একজন মেয়ের অবস্থার কোনো হেরফের কার্যত হয় বইলা আমার মনে হয় না।
ফলে, নারী তার অর্জিত ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর ভোগদখল কায়েম করতে পারুক এইটাই হওয়া উচিত নীতির মূলকথা। অথচ দেখা যাইতেছে সম্পত্তির ভোগদখলের কথা না বইলা সম্পত্তির উত্তরাধিকারের কথা বলা হইতেছে।
আরেকটা কথা। বাংলাদেশে কতভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে?
কত ভাগ মানুষের স্থাবর সম্পত্তি আছে? কতভাগ মানুষ সন্তানদের জন্য সম্পত্তি রেখে যেতে পারে? এই নীতি তাইলে কাদের জন্য?
যাদের জন্য তাদের সন্তানদের মধ্যে উত্তরাধিকার আইনের সমবণ্টন নিয়ে মাথা খাটানোর কথা না। আমার গ্রাম ও শহরের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।