#
ভারী পা জোড়া বয়ে নিয়ে থেমে দাঁড়াই তিনতলা বাড়িটির সামনে। রাত জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি নির্জনতা নিয়ে। শহুরে ভবঘুরে কুকুরটি প্রতিদিনের মতো শুয়ে আছে গেট আগলে রেখে। একঘেয়ে চাকরি, একঘেয়ে দিনশেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবি আজ হয়ত ব্যতিক্রম কিছু দেখব। হয়ত কুকুরটা থাকবে না, হয়ত ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সাঁই করে চলে আসব নিমিষে, হয়ত শৈশবের গৃহত্যাগী জোছনায় ছাদে বসে আয়েশ করে সিগারেট খাব, কেউ চা বানিয়ে এনে দিবে। ঘামে সিক্ত হয়ে সিটি বাসের ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে একবার ভ্রম ভাঙ্গে, কুকুরটিকে দেখে দ্বিতীয়বার আর শরীরটা যখন বিছানায় ছেড়ে দেয় তখন ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সম্ভাবনা ঘুমের ভেতরে চুপচাপ মরে যায়। আজ কুকুরটিকে এক-ই ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ক্ষোভের উদগীরণ হলেও পাশ কাটিয়ে ঢুকে যাই ভেতরে। ক্ষোভ কখনো আমাকে কাবু করতে পারে না বরং আমি চিরকাল ক্ষোভের শিকার হই, অব্যর্থ শিকার; এফোঁড়-ওফোঁড় করে যায়, রক্ত বের হয় না।
আজ বোধহয় হিসেবে কিছুটা ভুল ছিল। ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা বিছানায় ছেড়ে দিতেই প্রচন্ড পেট ব্যথা আমাকে বিশ্রাম নিতে বাধা দেয়, বমি বমি ভাব হওয়াতে বাথরুমে যেতে বাধ্য করে, বৃদ্ধ বেসিনে যার এদিক-সেদিক ভেঙ্গে গিয়ে কেমন যেন পৌরানিক আকার পেয়েছে সেটি দীর্ঘদিন পর আমার অসুস্থ মূর্তি দেখে এবং সেজন্য কি’না জানি না তৎক্ষনাৎ কারেন্ট চলে যায়। এর পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে বলে ভেবে নেই। আমার শারীরিক দুরবস্থা দেখতে অনভ্যস্ত আয়নাটি অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে লাইট অফ করে দিয়েছে অথবা সত্যি সত্যি কারেন্ট চলে গিয়েছে কিংবা প্রায় তিনমাস ধরে বিল না দেওয়াতে লাইন এর অকাল কিন্তু সম্ভাব্য মৃত্যু ঘটেছে। এদিকে আমার পেট ব্যথা কমে না, বমি আসে আসে করেও আসে না, অন্ধকার বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকি নিস্তব্ধ হয়ে। পরবর্তী দুটো সম্ভাবনা বাস্তবসম্মত বলে মনে হলেও এই মুহূর্তে আধবাঁকা অবস্থায় ধনুকের আকার নিয়ে অন্ধকারে ডুবে থেকে প্রথম সম্ভাবনাটাই সবচেয়ে বেশী জোরালো মনে হচ্ছে। কেননা, আমার অসুস্থবোধ করাটা একটা অলৌকিক ব্যাপার সুতরাং আরেকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটতেই পারে। আমি এটা ভেবে ব্যথা সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করি যে, আমার ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা ঘটার স্বাদ আজ পূরণ হচ্ছে কিংবা হতে যাচ্ছে।
টের পাই পেট থেকে গলা বেয়ে কিছু একটা উঠে আসছে। কেমন যেন শিরশিরে অনুভূতি। বেসিনের স্টিলে ঠাস করে শব্দ হয়। ভোঁতা শব্দ। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাই না কিন্তু প্রচন্ড ব্যথা নিমিষেই চলে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কী বের হয়ে এল, জানার জন্য মনটা ছটফট করতে থাকে, বেসিনে হাত বুলিয়েও কিছু পাই না। ফুটো দিয়ে পড়ে গেল নাকি?
আমাকে স্বস্তি দেবার জন্য বোধহয় কারেন্ট চলে আসে। আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজে পাই না। গন্ধ এসে নাকে লাগে। কানে হাত দিয়ে পানি দিতে গিয়ে ঠিক বেসিনের নিচে ছোট একটা মাংসের দলা পড়ে আছে।
ফেলে দিতে গিয়েও দেই না। হাতে করে নিয়ে আসি রুমের ভেতরে। ছোট্ট একটা বয়ামে ভরে বন্ধ করে দেই। ব্যতিক্রম রাতের সমাপ্তি এখানেই। আমার ডিভোর্স হওয়ার তিন বছর পূর্তি রাতে পেট থেকে বের হওয়া মাংসপিণ্ড আমাকে খুব বেশি ভাবিত করতে পারে না। বিছানা আমাকে প্রিয়তমার মতো ডাকতে থাকে।
#
যেদিন ভার্সিটির হল ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবনে পা দিলাম সেদিন আক্ষরিক অর্থেই চোখে অন্ধকার দেখি। থাকার জায়গা নেই, ভালো কোনো চাকরি নেই। চারপাশে তাকিয়ে দেখি আর আট-দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের মতোই আমার অবস্থা। তারা ভেঙ্গে পড়েনি। একটার পর একটা চাকরি খুঁজে যাচ্ছে, কেউ বিয়ে করে ফেলছে আর আমি ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াই, রাত হলে গা এলিয়ে দেই ঝিকাতলার মেসে।
বাড়িতে খোঁজ নিতে ভয় লাগে। ছোট ভাই নাকি ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়ায়। বাবা বাড়ি এসে মা’র সাথে খিটমিট করে। মা সারাজীবনের মতোই রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একা একা কাঁদেন। আমি ফোন করলেই আমার বোনের জন্য ছেলে দেখতে বলেন। এলাকার কোন মাস্তানের সাথে নাকি প্রেম করে বেড়াচ্ছে, তাদের নাকি নাক কাটা যাচ্ছে। আর বাবাকে ফোন দিলেই আর কতদিন আমারটা খাবি? আর তো পারি না। তাই লুকিয়েই থাকি। নিজের কাছ থেকে, অন্যের কাছ থেকে। এই জীবন সবাই কাটায়। কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে না। আমি বড় ভঙ্গুর ছিলাম।
তবে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারলাম না। ঠিক, নিশার কাছে ধরে পড়ে গেলাম। নিশা বড়লোকের মেয়ে। তার হাজারটা খেয়ালের মতো আমিও একটা খেয়াল ছিলাম; এমন ভাবতাম আমি। কিন্তু হিসেবে কিছুটা ভুল ছিল। সে আমাকে ভালোবেসেছিল।
আমার মতো ছন্নছাড়া কাউকে কেউ ভালবাসতে পারে? এটা কী সিনেমা ছিল? কেননা সবকিছু একেবারে বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট মতো ঘটতে থাকল। নিশা আমাকে বিয়ে করতে চাইল। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার জীবনে ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসার মতো, বিয়ে ঠিক হতেই আমার ভালো একটা চাকরি হয়ে গেল।
আমি আমার বাসায় না জানিয়েই বিয়ে করে ফেললাম। কেন করেছিলাম এই ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না কিংবা খোঁজার চেষ্টাও করি না।
হাসিখুশি নিশা বিয়ের পর আমার মতো গম্ভীর হয়ে গেল। বিছানায় নিরুত্তাপ হয়ে গেল। প্রথমদিকের রোমান্টিসজম কেটে গিয়ে ঝগড়া, সন্দেহ কত কিছু এসে পড়ল।
অফিসে সহকর্মী রেহানার সাথে গুটুরগুটুর করে গল্প করলেও, নিশাকে তার বন্ধুদের সাথেও মিশতে দিতাম না। হাজার হোক, আমি পুরুষ মানুষ। এই পুরুষত্ব দেখাতে গিয়েই ওকে হারালাম। একদিন রাগের মাথায় চড় মেরে বসলাম। বাবা-মা’র আদরে বড় হওয়া মেয়েটি চড় খেয়ে সেই রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ক’দিন পর বাসায় ডিভোর্স পেপার পেলাম। সই করে পাঠিয়ে দিলাম কিন্ত ওদিকে রেহানাও আমাকে মর্মান্তিকভাবে প্রত্যাখান করল। ভেঙ্গে পড়া গাছের মত, ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম।
অফিস থেকে ফিরে সারাদিনের রাগ, ব্যর্থতাগুলো ঝেড়ে ফেলার মতো কাউকেই পাই না। এখন আমার কিছুই গায়ে লাগে না। মানিয়ে নিয়েছি, মানিয়ে নিতে হয়।
#
বিচ্ছেদের তিন বছর পরের সকালটা এবার আমার কাছে নতুন করে ধরা দেয়। টের পাই রাত্রিকালীন বিষণ্ণতা অথবা শারীরিক অসুস্থতা কোনোটাই অনুভব করতে পারছি না, তবে শ্বাস নিতে একটু একটু কষ্ট হচ্ছে।
সকালের আলোটা চোখে সয়ে এতেই আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠি। দেখি আমি বোতলের ভেতর বন্দী হয়ে আছি। আমার হাতগুলো ভীষণ ছোট, পা না থাকার মতো। পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারি না, বসে পড়ি। বুঝতে চেষ্টা করি, কী ঘটনা ঘটছে। নিশ্চয় গত রাতের দুর্ভাবনাজনিত কোনো দুঃস্বপ্ন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি।
চোখ খোলার পর অবস্থা পরিবর্তন হয় না, বরং দুঃস্বপ্নের বাস্তব সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আমি দেখতে পাই আমার অগোছালো বিছানা আজ অগোছালো নেই। নিশা থাকার সময় যেমন ছিল ঠিক তেমন হয়ে আছে। বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে আর গুনগুণ করে কেউ গান গাচ্ছে। জোরে একটা চিমটি দিয়ে দেখি। এত ছোট আঙ্গুল তবু ব্যথা পাই। তারমানে, এটা বাস্তব। আমি আবার চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ হই। পারি না। বোতলের শক্ত কাচ আমার নড়াচড়া বাধাগ্রস্থ করে।
এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করি। গতকাল রাতের ঘটনাগুলো রি-ওয়্যান্ড করি এবং সাথে সাথেই দেখতে পাই, আমি পেট থেকে বের হওয়া ছোট্ট মাংসপিণ্ডটি বোতলে ভরে খাটের ঠিক পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমি রুপান্তরিত হয়ে এই বোতলের ভেতরে চলে এসেছি। আর বাথরুমে যার গানের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে সে আসলে আমি। নিশা একবার বলেছিল কী একটা উপন্যাসের কথা। ভ্রু কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করি। অবশ্য এই ছোট্ট শরীরে ভ্রু কতটুকু কোঁচকাবে সেই ব্যাপারে যথেষ্ঠ সন্দেহ থেকে গেলেও আমার কার্যসিদ্ধি হয়ে যায়। উপন্যাসের নাম মেটামরফমসিস, ফ্রাঞ্জ কাফকার। ঐ উপন্যাসটা শুরু হয় এই ধরনের একটি ঘটনা দিয়ে। পুরো গল্পটা মনে পড়ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দুরবস্থা ছাপিয়ে নিজেকে উপন্যাসের নায়ক বলে মনে হতে থাকে। কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করি। আর কিছুটা আফসোস হতে থাকে কেন শেষটা জানা নেই।
গান গেতে গেতে বেশ নায়কোচিত এন্ট্রি হয় বাথরুমের থাকা লোকটির। যা ভেবেছিলাম তাই। বাইরে আমিই দাঁড়িয়ে আছি। তাহলে ভেতরে কে? বোতলে টোকা দেই। বেশ জোরে শব্দ হলো বলে মনে হলেও বাইরের লোকটির কোনো ভ্রূক্ষেপ হলো বলে মনে হলো না। বাহ, লোকটি সুন্দর করে শেভ করেছে। কোথা থেকে জানি ইস্ত্রি করা শার্ট বের করে গায়ে দিচ্ছে। ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথায় হেঁটে বেড়াচ্ছে, যেন মনে অনেক আনন্দ। আমি শেষ কবে আনন্দের সাথে হাঁটাহাঁটি করেছিলাম? আবছা আবছাভাবে মনে পড়ে স্কুলে থাকতে বাবা একবার একটা ফুটবল কিনে এনে দিয়েছিলেন। তখন এভাবেই বাড়ির উঠোনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে বেড়িয়েছিলাম। তখন ছিল বসন্তকাল। এরপর কত বসন্ত কেটে গেলে আমি কী ওভাবে হাসিমুখে সব ভুলে দৌঁড়াতে পেরেছিলাম? আমার ভূমিকায় লোকটির অভিনয় ঠিক হচ্ছে না। আমার ভূমিকায় কাউকে অভিনয় করতে হলে হতে হবে বিষণ্ণ, একা অথবা বউ পেটানো স্বভাবের যে সব জায়গায় ঠকে গিয়ে নিজের হতাশা বউ এর উপর ঝাড়বে। প্রথমেই হাসিখুশি হয়ে সূচনায় লোকটি বিশাল গরমিল করে ফেলেছে। আড়ালে মনের ভেতরে গোপনে কাটাকুটি চলতে থাকে লোকটি যে আমি না তার পক্ষের প্রমাণগুলো একসাথে করতে করতে।
লাভ হবে না। আপনি ভেতরেই বন্দী থাকবেন আর আমার সাথে ঘুরে বেড়াবেন। যা ইচ্ছে ভাবতে পারেন।
চমকে উঠি কিন্তু বোতলের ভেতর কিছু করতে পারি না। নিরাশ হয়ে চুপ করে যাই।
#
আমাকে লোকটি তার ছোট্ট ব্যাগে ভরে নিয়ে বের হয়। সাইড পকেটের চেইন একটু খোলা থাকে। ছোট্ট আমি ছোট্ট ফুটো দিয়ে বিশাল পৃথিবীর আলো বাতাস পেতে থাকি। গেট দিয়ে বের হয়ে নিচে আসতেই শুনি বাড়িওয়ালার কন্ঠস্বর।
রায়হান সাহেব, তিনমাস হতে চলল। এবার ভাড়া না দিলে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে।
আমি ব্যাগের ভেতরে থেকে মিনমিন করে বলতে চেষ্টা করি কিছু একটা। কিন্তু তার আগেই লোকটির উত্তর শুনে ফেললাম। লোকটি বলল, ধুর মিয়া ফাজলেমি বাদ দেন। এই দুই পয়সার ঘর ভাড়া দিয়া এত ভাব মারেন ক্যান? পানি থাকে না, বেসিন ভাঙ্গা, বৃষ্টি হইলে ড্যাম্প ওয়াল দিয়া টপটপাইয়া পানি পড়ে। এগুলা আগে ঠিক করেন। এই বাড়িতে থাকি বইলা তো আপনার কাছ থেইকাই উল্টা ভাড়া নেওয়া উচিৎ।
আমি কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে যাই, চিন্তাগুলো থেমে যায়। শালা তো জিনিয়াস। এই কথাগুলো তো আমার বলা কথা ছিল। নিজের জায়গা দখল করা কাউকে কী শালা বলা যায় নাকি, সেই ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা দেখা যায় না।
আমি বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে বাসের জন্য দাঁড়াই। আজ দেখি লোকটা রিকশা ঠিক করছে। রিকশা-ওয়ালা অদ্ভুত ধরনের একটা ভাড়া চাইলে লোকটি খুব সুন্দর করে বলে, তুমি দিনে আইনা দিনে খাওয়া আর মাসে আইনা প্রতিদিন হিসাব কইরা খাই। এইটা কোনো ভাড়া চাইলা?
এখন আর আমি অবাক হই না। সারাদিন ব্যাগের সাইড পকেটে বসে থেকে এমন আরো অনেক কিছু দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। প্রথম প্রথম অবাস্তব এবং বিরক্ত লাগলেও সময়ের সাথে সাথে বেশ উপভোগ করতে শুরু করি।
#
দিনশেষে ব্যাগের ভেতরে থাকতে থাকতে ক্লান্তবোধ করি। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা কিছুই যায়নি আমার উপর দিয়ে তবু। অথচ লোকটি সব কাজের ভার নিয়েও দিব্যি সতেজ। এর ওর সাথে হাসি তামাশা করে যাচ্ছে। একজনকে বলতে শুনলাম রায়হান ভাই, আজ সকালে কার মুখ দেইখা উঠলেন? চিনাই যাইতেসে না।
আমার ডুপ্লিকেট নিশ্চিন্তে জবাব দিয়ে দিল, ভাবীর মুখ দেখে।
শালা রসিকতাও করতে জানে!
তবে একটু যে কাজটি করল, আমার মেজাজ আবার খারাপ হয়ে যায়। কী দরকার ছিল বাবাকে ফোন দেবার?
বাবা, আপনার জমি বিক্রির টাকা দিয়া আমি বিয়া করসিলাম। আমারে মাফ কইরা দিও। কইদিন পর আসব আমি।
জানি না, অপরপ্রান্তে আমার বৃদ্ধ বাবার কেমন লাগছিল। হঠাৎ করেই বিষণ্ণ হয়ে যাই। কেমন আছে মা? আমার ছোট ভাই কী বড় মাস্তান হতে পেরেছে? বোনের বিয়ে হয়ে গেছে?
আরে,ব্যাটা ফোন করবি তো কর। এইগুলা জিজ্ঞেস করবি না?
কথাগুলো আমি মনে মনেই বলছিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। লোকটি উত্তর দেয়, হারামজাদা এতদিন খবর নেস নাই। আবার আমার উপর চ্যাত দেখাস। এখন তোর বউরে ফোন দিতাম। দিলাম না, সে হাসপাতালে। বাচ্চা হবে। কিন্তু তুই বাপ না।
আমার ভেঙ্গে যাওয়া পৃথিবী আবার ভেঙ্গে যায়।
লোকটি বলতে থাকে, বাড়ির সামনের কুত্তাটা অনেকদিন খায় না। তুই আজকে ঐটার পেটে যাবি। রেডি হ।
ভয়ে আতঙ্কে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়ার কথা থাকলে আমি স্বাভাবিকভাবেই নেই। আমার বেঁচে থেকে কিছু হবে না। বরং এই লোকটি থাকুক। বাবার কাছে যাক। বাবার অনেক বয়স হয়েছে।
#
আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বাড়ির সামনে শুয়ে থাকা অবস্থায়। আমার থেকে একটু দূরে কুকুরটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। লোকটিকে কোথায় দেখতে পাই না। তবে দেখতে পাই, আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছি। মনে পড়ে যায়, লোকটি আমাকে খাদ্যহিসেবে কুকুরটিকে খেতে দিয়েছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই।
মনে হয়,আমার বিষাক্ত মন কুকুরটিকে মেরে ফেলে আমাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। শালার,কুকুরের খাদ্য হবার যোগ্যতাটাও অর্জন করতে পারলাম না!