somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘরপালানো

২৪ শে মে, ২০১৬ রাত ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক

"ঘর পালিয়ে ছেলেরা হয় পুরুষ আর মেয়েরা হয় বেশ্যা!"
কে যেন বলেছিল কথাটা? সাইফ মনে হয়।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে মিয়ি। শেষ রাতে তারার আলোয় হাঁটতে বেশ লাগছে। চন্দ্রনীলাদের যেন কোন দিকে? ঠাওর করতে পারছে না মেয়েটা। অনেক আগে জেনে রাখা চন্দ্রদের বাড়ির ঠিকানা বের করতে যে খুব বেগ পেতে হবে, তা জানা ছিল মিয়ির। চাইলে চন্দ্রকে ফোন করে এক নিমিষে ওদের বাড়ি চলে যেতে পারে। তা করবে না। চন্দ্রকে চমকে দিতে চায় ও।

অন্ধকার থাকতেই চন্দ্রমহল খুঁজে পেল মিয়ি। সিঁড়ি বেয়ে সরাসরি ছাদে চলে এল সে। মিয়ি জানে, চন্দ্র ঘুমায়নি।
মেয়েটা ঘুমায় না, ঘুমুতে পারে না।
এবারে হয়তো ঘুমাতে পারবে চন্দ্র।

রিং হচ্ছে,
একবার …
দুইবার ……
তিনবার ………
'আপুনা!' উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে চন্দ্র'র গলায়। 'জেগে আছিস, তাই না রে?' ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিয়ি আবার বলল, 'চট করে ছাদে চলে যা তো। আমিও ছাদেই আছি। আয়, একসাথে ভোর দেখব।'
বলেই ফোন কেটে দিল মিয়ি। আপন মনেই হাসলো। ও জানে, চন্দ্র পাঁচমিনিটের মাথায় ছাদে উঠে আসবে। এর আগে বহুবার দু'বোনে ছাদে বসে একই ভোর হতে দেখেছে। কিন্তু একসাথে বসে নয়। চন্দ্র নিশ্চয়ই ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করবে না, ওর আপুনা ওদের বাড়ির ছাদে বসেই ফোন করেছে ওকে।

মেয়েরা ঘর পালিয়ে বেশ্যা হয়, না? আমি দেখিয়ে দেব, ঘর পালানো মেয়ে মানেই বেশ্যা না!
আপন মনে বিড়বিড় করে মিয়ি। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মুখে কঠিন সংকল্পের ছাপ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে।
ঋষিদের মত বন্ধ চোখে আসন গেড়ে বসে আছে সে।

দুই

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হতেই মিয়ি চোখ মেলে তাকালো। এই আবছা আলোয় ছাদে কাওকে বসে থাকতে দেখে চন্দ্র ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠতে পারে। ছাদে পা রাখতেই নিরুত্তাপ গলায় মিয়ি বলল, 'চেঁচিয়ে বাড়ির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিস না।'
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তবুও মিয়ি জানে চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে মেয়েটার।
'চিনতে পারছিস?' আবার বলে উঠল সে।

সহসা হুড়মুড় করে পড়ে গেল মিয়ি। ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
'চন্দ্র,' মৃদু গলায় ডাকল মেয়েটাকে। 'কান্না বন্ধ কর।'
মেয়েটা তবুও কাঁদছে।
'চন্দ্র!' এবারে ধমকে উঠলো মিয়ি। 'চিন্তাভাবনা করার জন্য পাঁচ মিনিট সময়। আমি ঘর ছেড়ে এসেছি। যাবি আমার সাথে?'
হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে চন্দ্র।

'কিন্তু … '
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল চন্দ্র। ওকে থামিয়ে দিল মিয়ি। চোখের পানি মুছিয়ে কপালে চুমু দিল। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে। সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো মেয়েটা।

'আপুনা!'
ধরা গলায় পিছন থেকে ডাকলো মেয়েটা। 'আমি যাব তোমার সাথে!'
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালো মিয়ি। 'আমি রাস্তায় দাঁড়াচ্ছি, তোর যা যা সাথে নেওয়া লাগে, নিয়ে আয়। বেশি কিছু নিস না। ভারি ব্যাগ ক্যারি করতে তোরই সমস্যা হবে। আর শোন,' ব্যাগ হাতড়ে একটা খাম বের করলী মিয়ি। সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা তোর টেবিলে রেখে আসবি। ভিতরে কী আছে সেটা জানার দরকার নেই।'

তিন

দ্রুতহাতে ব্যাগ গোছাচ্ছে চন্দ্র। ধর্মীয় কঠোর অনুশাসনে বেড়ে ওঠায় আজীবন বন্দী জীবন যাপন করেছে সে। বাইরের দুনিয়া দেখার সুযোগ হয়নি। এই প্রথমবারের মত সে সাহসী হবে। একা একাই দেখে নেবে নিজের দেশটাকে। আপুনার হাত ধরে।

মনটা যে একটু খুঁতখুঁত করছে না, তা নয়। বাবা-মায়ের ঘরের দরজার দিকে তাকালো মেয়েটা। একবার উঁকি দিয়ে দেখে নেবে?

দেরি করা ঠিক হচ্ছে না, জানে চন্দ্র। এক্ষুনি ফজরের আজান পড়বে। বাবা নামাজ পড়তে উঠবেন।
ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে উঁকি দিল চন্দ্র। বাবার সৌম্য চেহারার দিকে তাকিয়ে হুট করেই ভয় এসে গেল মেয়েটার। সে কি ঠিক করছে? পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। হারাবার আর কিছুই নেই তার।

অস্থিরভাবে বড় রাস্তায় পায়চারি করছে মিয়ি। চন্দ্র ব্যাগ হাতে এগিয়ে গেল সেদিকে। মুখ তুলে ওকে দেখে মৃদু হাসলো মিয়ি। পায়ের পাতায় উপর দাঁড়িয়ে চন্দ্রের মাথার উপর দিয়ে কী যেন দেখল সে। চন্দ্রও হাসলো। তারপর মিয়ির একটা হাত শক্ত করে ধরে ছুট লাগালো। দূরের কোন মসজিদ থেকে দিনের প্রথম আজান ভেসে আসছে, "আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম … "

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে ওরা। চন্দ্রের ব্যবহৃত সীমটি এরই মধ্যে খুলে ফেলা হয়েছে। বেলা বাড়লেই ওর খোঁজ পড়বে।
চন্দ্র খুব উশখুশ করছে। মিয়ি ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 'তোর যদি মনে হয় যে তুই ভুল করছিস, এখনো সময় আছে, চলে যা।'
'না আপুনা, আমি অন্যকিছু বলতে চাচ্ছি।'
'বলে ফেল।'
'চলো না আমরা প্রথমে পঞ্চগড় যাই?'
শোনা যায় না, এমনভাবে ফিসফিস করে বলল চন্দ্র। বলেই নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আপুনের চোখের দিকে তাকাতে বড্ড ভয় লাগছে ওর। নিচের দিকে তাকিয়েই বলল, 'শুধু একবার চোখের দেখা দেখব আপুন। সামনেও যাব না।'
একটু থেমে যোগ করল, 'তুমি যদি বারণ করো, আর কখনো এই কথা মুখেও তুলব না।'
সামনে তাকিয়রয়েছে মিয়ি। মাথা ঝাঁকিয়ে খানিক আগে এসে দাঁড়ানো বাসে উঠে পড়ল সে। পিছন পিছন চন্দ্রও উঠলো।

চার

হাইওয়ে দিয়ে তীব্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকাগামী বাস। এতক্ষণে চন্দ্রের জানা হয়ে গেছে, ওরা ঢাকাতেই যাচ্ছে। বাসে উঠার পর আর একটা কথাও বলেনি মিয়ি। মোবাইলের নোটপ্যাডে কী যেন টাইপ করে যাচ্ছে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে চন্দ্র। আপুনের প্রতি নিস্পাপ অভিমানে মনটা শিক্ত হয়ে আছে ওর। কী এমন হত আগে পঞ্চগড় গেলে? বাংলাদেশ ঘুরতে হলে যেকোন একটা শহর দিয়ে তো শুরু করতেই হবে। সেটা কি খুলনা হতে পারতো না?
একটু পরেই অভিমান কেটে গেল ওর। এই যে আপুন ওকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসেছে, সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। ওকে এভাবে নিয়ে আসায় ওর ভালোমন্দের সমস্ত দায়িত্ব তো এখন আপুনের ঘাড়ে। এত বড় দায়িত্ব কীভাবে সামাল দেবে সে?

'কীরে? কী ভাবছিস অত?'
ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল মিয়ি।
লজ্জা পেল চন্দ্র।
'কিছু নয় আপুনা। আমরা পৌঁছে গেছি?'
'হ্যাঁ, চল যাই।'

পাঁচ

দুই সপ্তাহ পর।
মিয়িকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে চন্দ্র। ঘুমের মধ্যেই হাসছে মেয়েটা। কতদিন পর একটু স্বস্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে ও?
শুয়ে শুয়েই ভাবছে মিয়ি। চন্দ্রের ঘরপালানোর প্রথম এক সপ্তাহ যেন আনন্দে কাটে সেই ব্যবস্থাই করে রেখেছিল মিয়ি। ঢাকায় এসেই প্রচন্ড চমকে গিয়েছিল সে। যাকে একনজর দেখবার জন্য প্রথমেই পঞ্চগড় যেতে চেয়েছিল, তাকে চোখের সামনে দেখে যেন বিশ্বাসই করতে পারেনি। তারপর আগে থেকে করে রাখা প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকার কাছাকাছি জেলাগুলি ঘুরেছে সবাই মিলে। গাজিপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা। সবাই বলতে মিয়ি আর চন্দ্রের বন্ধুরা, যারা ঢাকায় থাকে। এখন আছে কুয়াকাটায়। ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়াকাটা চলে আসেনি, যাত্রাপথে যেসব শহর ছিল, সব জায়গায় থেমে দেখতে দেখতে এসেছে। ওরা তো কেবল দর্শনীয় স্থানগুলি দেখবে না। পুরো বাংলাদেশ দেখবে।

কিন্তু আজকে পড়তে হবে চরম বিপর্যয়ে। এই বিপর্যয় তৈরি করে রেখেছে মিয়ি নিজেই।

কুয়াকাটায় ওদের সঙ্গে আসা বন্ধুরা সবাই গতরাতে চলে গেছে। আজ এখান থেকে খুলনা যাবে ওরা। বরিশাল হয়ে খুলনা যেতে হবে। বরিশাল বাসস্ট্যান্ডে খুলনাগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছে দুইবোন।
নিজের অস্বস্তি প্রাণপণে চেপে রাখার চেষ্টা করছে মিয়ি। বাসের সাথে সাথে ও অন্য কিছুর জন্যও অপেক্ষা করছে। মিয়ির উৎকণ্ঠা চন্দ্রকে বিন্দুমাত্র ছুঁতে পারছে না। সে বুঝতেই পারছে না, মিয়ির মধ্য দিয়ে কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিশোরীসুলভ উত্তেজনা নিয়ে হাবিজাবি কী সব যেন বলে যাচ্ছে সে।

লম্বা জুব্বা পরা সৌম্য চেহারার এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে রাগি চেহারা নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখল মিয়ি। যা আশঙ্কা করছিল, ঠিক তাইই ঘটছে। মিয়িকে সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে চোখ ফিরিয়ে সেদিকে তাকালো চন্দ্র। সাথে সাথে জমে গেল সে।

ছয়

দুই সপ্তাহ পূর্বে …

ঘুম থেকে উঠে রোকেয়া বানু অজু করতে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন। বড় মেয়ের ঘরের বাতি জ্বলছে। অবাক হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

এলোমেলো ঘর আর খোলা আলমারি দেখেই বুক চেপে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। তখনই টেবিলে রাখা খামটা নজরে এল তাঁর। খাম খুলে ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে নিলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, চিঠির লেখাগুলি তাঁর মেয়ের নয়।

হাজি আবু তাহের পাটোয়ারি ফজর পড়ে ঘরে ফিরেছেন। তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বানু কিছু না বলে চিঠিখানি এগিয়ে দিলেন।

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

"বাবা,
আসসালামু আলাইকুম।
আমি জানি এই মুহূর্তে আপনি প্রচন্ড টেনশন নিয়ে এই চিঠি পড়ছেন। তাই আপনি কেমন আছেন, তা জিজ্ঞেস করা অবান্তর।

প্রথমে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি চন্দ্রের বোন। পাতানো শব্দটা লিখলাম না। কেবল রক্তের সম্পর্কই যে খাঁটি, বাকি সব ভুয়া - এটা আমি মানি না। যেহেতু ও আমার বোন, আমি তো আপনাকে বাবা ডাকতেই পারি। পারি না?

চন্দ্রের মত আমিও রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি। ক্লাস টেইনে থাকতে হুট করে আমার মা মারা গেলেন। তখনো আমি বুঝতাম না আমাদের দুই ভাই বোনের সমস্ত পরিচালনা আমার মা-ই করতো। মা মারা যাওয়ায় আমরা অকূল পাথারে পড়লাম।

তারপর আস্তে আস্তে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আমার পড়াশোনা, আমার ভাইয়ের পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলাম। দুই বছরের মাথায় স্বাবলম্বীও হয়ে গেলাম। কষ্ট আর আত্মসম্মানবোধ আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখালো। এইবছর আমি আমার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করলাম।

বাবা, আমার বাবা হয়তো একসময় আমাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু বাবা হিসেবে তিনি কখনো তাঁর দায়িত্ব পালন করেননি। চেষ্টা করেও আমি তাকে সম্মান করতে পারিনি। তাঁর জন্য আমার মনে কোন শ্রদ্ধা নেই। কিন্তু একবুক ভালোবাসা আছে। সেই ভালোবাসার জায়গা থেকে আমি কখনো এমন কোন কাজ করিনি, যেটা তাঁকে ছোট করবে। কখনো তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি।

আমার খুব শখ পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখার। তাই আমি ঘর পালিয়েছি। আমি জানি চন্দ্রও দেশটাকে ঘুরে দেখতে চায়। ওর আজন্মকালের সাধটা আমার হাত ধরে মিটিয়ে দিতে চাই।

এতক্ষণ ধরে আমি নিজের সম্পর্কে এত বিশদ বর্ণনা দিয়েছি এই জন্য যে খানিকটা ভরসা যেন আপনি আমার উপর করতে পারেন। হয়তো তাতে লাভ কিছু হয়নি। এত অল্পতে কারোর উপর ভরসা করা সম্ভব না।

আমি জানি, আপনি আমার মত পুচকে এক মেয়ের বেয়াদবী দেখে আপনি খুব রেগে গেছেন। ভাবছেন হাতের কাছে পেলে ইচ্ছেমত শায়েস্তা করে দেবেন। তাই না?
আমি আপনার জন্য আমার সমস্ত তথ্য দিয়ে গেলাম। আপনি যাচাই বাছাই করুন, আমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিন। চাইকি আমার বাবার কাছে গিয়ে তাঁর মেয়ের আস্পর্ধার বয়ান করতে পারেন। কিংবা পুলিশ কেস? কিন্তু যতযাইই করুন দুই সপ্তাহের আগে আমাদের খুঁজতে বের হবেন না। লাভ নেই। আমাদের বের করতে পারবেন না। ঠিক দুই সপ্তাহ পর আমরা বরিশাল বাসস্ট্যান্ডে থাকব। ওখান থেকে সুন্দরবন যাব। যদি মনে করেন, মেয়েটা আমার সাথে নিরাপদ নয় তবে গিয়ে নিয়ে আসবেন ওকে। চাইলে আমাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। আমার কোন আপত্তি থাকবে না। তবে এটুকু জেনে নিবেন এই অন্তর্ধানে চন্দ্রের কোন দোষ নেই।

এই সমস্তই আমার পরিকল্পনা। ঘরপালানো মেয়ে মানেই খারাপ মেয়ে নয়, এটা প্রমাণ করতে আমার এই দুই সপ্তাহের খুব প্রয়োজন।"


শেষ পৃষ্ঠায় মেয়েটার পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা রয়েছে। সেই সাথে ওর বাবার মোবাইল নাম্বারটাও।

শুরুর দিকে প্রচন্ড রাগ হলেও এখন কেন যেন এই অপরিচিত মেয়েটার উপর রাগ করতে পারছেন না আবু তাহের পাটোয়ারী। অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করছেন। তিনি ঠিক করলেন, মেয়েটার ব্যাপারে কোন ইনকোয়ারি করবেন না। দুই সপ্তাহ পর গিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে আসবেন।

সাত

বাসস্ট্যান্ডে কোন ধরনের সিনক্রিয়েট হল না। হাজি সাহেব এসে তাঁর মেয়েকে বললেন, "বাড়ি চল।"
মিয়ি সাথে সাথে চন্দ্রের হাত ছেড়ে দিল।
চন্দ্র নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবার সাথে চলে গেল। পুরোটা সময় মিয়ি নির্বিকার চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুলনা বাস এসে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই তাতে চড়ে বসল।

বরিশাল থেকে কুমিল্লা যেতে হলে চাঁদপুর হয়ে যেতে হবে। চাঁদপুরগামী একটা লঞ্চে চন্দ্রকে নিয়ে উঠে বসলেন। লঞ্চ ছাড়ার আগে তিনি তাঁর সাথে আসা লোকটাকে ডেকে কিছু বললেন। লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল।

আরো মাসখানেক পর এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় চন্দ্রর ঘরের দরজার টোকা পড়ল। এই এক সপ্তাহ খুব উৎকন্ঠায় কেটেছে মেয়েটার। ও ভেবেছিল বাবা খুব বকাঝকা করবেন। কিন্তু কিছুই বলেননি বাবা। কী শাস্তি জমিয়ে রেখেছেন তিনি, তাইই ভেবে আধমরা হয়ে আছে মেয়েটা। ওদিকে আপুন একা একা কোথায় কীভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিয়েও খুব চিন্তা হচ্ছে। ফোনে কিছুতেই ট্র‍্যাক পাওয়া যাচ্ছে না ওর।

দরজার টোকার শব্দে আঁতকে উঠলো চন্দ্র। বাবা! বাবা ছাড়া তো আর কেউ এভাবে নক করে না! শাস্তিটা কি তবে আজই দেওয়া হবে?

দরজা খুলতেই বাবা বললেন, 'রেডি হয়ে নাও।'
কোথায় যাবার জন্য রেডি হতে বলেছেন, সেটা জিজ্ঞেস করার সাহসটাও হল না।
লম্বা জার্নি করে খুলনার একটা হসপিটালে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল। বাবা ওকে একটা ম্যাগাজিন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
'তোমার বোন ম্যালেরিয়ায় ভুগছে। আজ ওকে হসপিটালাইজড করা হয়েছে। বইটা দিয়ে বোলো, ওকে আমি বিশ্বাস করেছি। ঘরপালানো মেয়ে মানেই খারাপ মেয়ে নয়, সেটা ও প্রমাণ করেছে। কিন্তু ওকে বোলো একা একা ভ্রমণে কোন আনন্দ নেই। তাতে বিপদও হয় অনেক।'

ম্যাগাজিনটার দিকে একবার চোখ বুলিয়েই চন্দ্র পড়িমরি করে বাবার দেখিয়ে দেওয়া কেবিনের দিকে ছুটল।

পরিশিষ্ট

ঘুম ভেঙ্গেই চন্দ্রকে ওর উপর ঝুঁকে থাকতে দেখেই সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল মিয়ি। প্রচন্ড জ্বরে পড়ে প্রায়ই এমন আবোলতাবোল দেখছে সে। সুন্দরবনে যে দলটার সাথে গিয়েছিল, ওদের হারিয়ে ফেলেছিল সে। পুরো একদিন পর ওখান থেকে এক লোক উদ্ধার করেছে। সেই লোকটাকে নাকি আবার চন্দ্রর বাবা বহাল রেখেছিল মিয়ির দেখভাল করার জন্য।

জ্বরের ঘোরে সবকিছু এলোমেলো লেগেছে মিয়ির কাছে। এইযে এখন যেমনটা লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, চন্দ্র তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছে, 'আপুন! বাবা বলেছে এরপর থেকে তোমাকে আর একা একা দেশ ঘুরতে হবে না! আমিও তোমার সাথে ঘুরব! বাবা তোমার লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন! এখন থেকে রহস্যপত্রিকায় তোমার ভ্রমণকাহিনি নিয়মিত ছাপা হবে! তুমি পেরেছ, আপুন! তুমি পেরেছ!'

মিয়ি জানে, সবই ভ্রম। তবুও একবার চন্দ্রের হাতে হাত রাখে সে। ঘোরে দেখা কাওকে কি স্পর্শ করা যায়? যায় না তো! কিন্তু অবাক ব্যাপার হল মিয়ি চন্দ্রের স্পর্শ অনুভব করতে পারছে।
খুব করে পারছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৬ রাত ১:৩৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×