
বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা পরিচিতি (১ম কিস্তি)
বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা পরিচিতি (২য় কিস্তি)
পাংখোয়া: বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে বলা যায় বিপন্ন রয়েছে যে কটি আদিবাসী তাদের মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি মতে এদের সংখ্যা ৩২২৭ জন। ভারতের মিজোরামেও কিছু সংখ্যক পাংখোয়া বাস করে। পাংখোয়ারা মূলত রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি এলাকায় বসবাস করে। হাচিসন এদের ২টি গোত্রের কথা উলেখ করেছেন ১) পাংখোয়া ও ২) ডনজাঙ। অতীতের কোন এক সময় তারা মিজোরামের পাংখোয়া (পাং=শিমুলফুল, খোয়া=গ্রাম) নামক গ্রাম থেকে এ পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল। লুসাইদের সঙ্গে এদের নানা বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। চীনা-তিববতী ভাষা পরিবারের কুকি-চীন-নাগা শাখা ভূক্ত পাংখোয়া ভাষায় নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। রোমান হরফ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে। এক সময়ে প্রকৃতির পুজারী হলে ও বর্তমানে এরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত শুধু ভাষাটি বলা যায় টিকে আছে বিপন্ন অবস্থায়।
লুসাই: লুসাই মূলত চীন-তিববতি ভাষা পরিবার ভূক্ত একটি ভাষা পার্বত্য চট্রগ্রামের উত্তরের লুসাই পাহাড় থেকে তারা এ অঞ্চলে আসে। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লুসাইরা বাংলাদেশে সংখ্যায় খুবই কম। ১৯৯১ সালের হিসাবে দেখা যায় এদের সংখ্যা ৬৬২ জন। লুসাইদের অন্য নাম হচ্ছে মিজো, লুসেই, হুয়ালাংগো ইত্যাদি। মায়ানমার এবং ভারতে এদের সংখ্যা যথাক্রমে ১২৫০০ এবং ৫,৩৮,৮৪২ জন। এরা রাঙ্গামাটির বাঘাই ছড়ি বরকল সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করে। এখানে লুসাইরা সংখ্যায় কম হলেও অন্যান্য কুকি-চীনভাষী লোকদের মধ্যে বম এবং পাংখোয়ারা লুসাইদের ভাষা বুঝতে পারে। এরা প্রত্যেকই রোমান ২৫টি হরফ নির্ধারণ করেছে তাদের ভাষায় ব্যবহারের জন্য।
বম: পার্বত্য চট্টগ্রমের বান্দরবান জেলাই প্রধানত বমরা বাস করে। এছাড়া রাঙ্গামাটির বিলাই ছড়িতেও এদের কিছু পরিবার আছে। ১৯৯১ সালের আদম শুমারিতে এদের জনসংখ্যা ৬৯৭৮ জন। প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে এদের জনসংখ্যা ৩৫৮১ জন (২০০০)। সেখানে ফালাম এলাকা ও চীনা পাহাড়ে এদের বাস। বমদেরকে বম, বন, বাউন, বোনজোগি, বঙ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। এদের ভাষা মূলত চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের কুকি-চিন-নাগা শাখা ভুক্ত। ধারণা করা হয় যে, এক সময় চীনের মূল ভূ-খণ্ডের ‘চিনলুং’ পতিমালা এলাকায় এই উপজাতি বসবাস করতেন। পরবর্তী কালে বার্মার চেনদুইন ও ইবাবতী নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করেছিলেন। শানদের ইতিহাসে এর উলেখ পাওয়া যায়। বোমরা ‘লাই’ শ্রেণীভুক্ত জনগোষ্ঠী। বমরা নিজেদেরকে ‘লাই’ বা ‘লাইমি’ বলে যার অর্থ হচ্ছে- মানুষ। এদের প্রধান দুটি গোত্র হচ্ছে- শুনথলা ও পাংহয়। কৃষিজীবি বমরা অধিকাংশই বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহন করেছে। বর্তমানে বমরা ২৫টি রোমান হরফ ব্যবহার করছে তাদের ভাষায়। চাক ভাষা : চাকরা বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় বাস করে। এছাড়াও মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও তারা বাস করে। সেখানে তাদের আরেক নাম হচ্ছে সাক বা থাক। মায়ানমারে তাদের সংখ্যা ২০ হাজার (এথনোলগ; ২০০৫) আর বাংলাদেশে চাকদের সংখ্যা ২০০০। পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে বাস করে। নামগত সাদৃশ্য ছাড়া চাকমাদের সঙ্গে এদের কোন মিল নেই। চাকদের ভাষা চীনা-তিব্বতি পরিবারের। চাক বা আসাক (অংধশ) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার মিটকিনা, কাথা এবং চেনদুইন অঞ্চলের কাডু, গানান জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। জর্জ গ্রিয়ারসনের মতে মনিপুরের আন্দো, সেংমাই এবং বাইরেল উপভাষার সঙ্গে চাক ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি, লোকগাঁথা, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। লোফলার (১৯৬৩), বারনট (১৯৬৬), লুচি (১৯৮৫) প্রমুখ গবেষক চাক জাতি ও ভাষা নিয়ে ইতেপূর্বে কাজ করেছেন। চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের লুইশ গোত্রভুক্ত চাক ভাষা। যদিও কেউ কেউ এটিকে অসনাক্তকৃত ভাষারূপে চিহ্নিত করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে চাক ভাষায় স্বর বা ঃড়হব বৈচিত্র্য রয়েছে। যে কারণে অন্যদের পক্ষে এটি উচ্চারণ করা বেশ কঠিন।
ঠার/থেক বা ঠেট ভাষা: বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ সালে শরণার্থী আরাকানরাজ বলালরাজার সাথে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা পেশার সাথে সম্পৃক্ততার ফলে কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদের নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও মৌখিক সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের চাক ভাষার সঙ্গে এই ভাষায় মিল বা ঘনিষ্ঠতাও গবেষণার বিষয়। উত্তর বার্মায় প্রচলিত থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়। সেখানে এই ভাষাভাষী লোক সংখ্যা ১,২৮,৫০০ বা তারও বেশি। এটি চীনা-তিব্বতি গোত্রভুক্ত ভাষা ।
রাখাইন ভাষা: পটুয়াখালী, কক্সবাজার, বরগুনা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সতের হাজার লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। পটুয়াখালী কক্সবাজার ছাড়াও মহেশখালিসহ কিছু কিছু পার্বত্য অঞ্চলে (বান্দরবান, রাঙামাটি) ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাখাইনরা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে রক্ষণশীল জাতি। তারা নিজেদেরকে রাখ্যাইন>রাখাইন বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা এটি মুলত মারমা ভাষার উপভাষা। জানা যায় খ্রিষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। আদম শুমারি রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশে রাখাইনদের সংখ্যা ১৬৯৩২ জন। মারমা, রাখাইন এবং ম্যা মূলত একই ভাষিক গোত্রের বিভিন্ন উপ-ভাষাভাষী আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যাদের আদি নিবাস ছিল বার্মার পেগু শহরে। দীর্ঘদিন ধরে জীবনাচরণ এবং অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে মারমা এবং রাখাইনদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হলেও তারা যে মূলত একই জাতি এ বিষয়ে অধিকাংশ গবেষকগণই একমত। বাংলাদেশে রাখাইনদের ভাষা নিয়ে উলেখযোগ্য কোন গবেষণা দৃষ্টিগোচর হয় না। একমাত্র গবেষক হলেন ভাষাবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান (১৯৯৪)। তিনি রাখাইনদের দুটি প্রধান উপভাষা বা ভাষিক বৈচিত্র্যের সন্ধান জানাচ্ছেন। যার একটি হচ্ছে র্যামর্য এবং অন্যটি মারৌও। মারমা এবং রাখাইন উভয় গোত্র একই বর্মী লিপি ব্যবহার করে। দ্রাবিড় ভাষাসমূহ দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার হচ্ছে দ্রাবিড় পরিবার। আর্যদের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষাসমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষাসমূহের মধ্যে ওঁরাওদের কুঁড়ুঁখ উলেখযোগ্য। যদিও পাহাড়িয়া, মালতো প্রভৃতি জাতির মধ্যে এক সময়ে দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত ছিল কিন্তু বর্তমানে তারা সাদরি ব্যবহার করে।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:১৮