
বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা পরিচিতি (র্পব-১)
ড. রতনলাল চক্রবর্তী ‘সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র’ গ্রন্থে আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হিসেবে সিলেট শহর হতে ১০-১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব সীমানাকে চিহ্নিত করেছেন। সিলেট জেলার সদর উপজেলা ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৬ থেকে ১৭টি গ্রামে প্রায় ৯০% পাত্রের বসবাস। এছাড়া সিলেট শহরের পাঠানটুলী নামক পাড়ায় এবং কিছু সংখ্যক পাত্র দেশ ত্যাগ করে ভারতে বসবাস করে । পাত্রদের বসবাস সিলেট অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্য কোথাও যে নেই। পাত্র সমাজে সর্বমোট ১২টি গোত্র রয়েছে। আদিবাসী পাত্র কারা এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এরা কখনো পাত্র, কখনও পাত্তর, আবার কখনও পাথর ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছে। কাঠ পুড়িয়ে অঙ্গারিক কয়লা বিক্রির মাধ্যমে জীবন-যাপন করতো বলেই তাদেরকে বলা হত পাথর। কালের বিবর্তনের ধারায় ও ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনে এ পাথরই হয়েছে পাত্র (পাথর>পাতর>পাত্র)।
সিলেটে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পাত্রদের আলাদা সমাজ সংস্কৃতি ও ভাষা থাকলেও সে ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। জাতিগত ভাবে পাত্ররা “বোড়া” জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে পণ্ডিতরা অনুমান করে থাকেন। গ্রিয়ারসন সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত মনিপুরী, খাসি প্রভৃতি ভাষা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট তথা তৎকালীন আসাম অঞ্চলের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতি উপভাষা সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন সেখানে পাত্রদের ভাষার উল্লেখ নেই। পাত্রদের ভাষার কোনো লিপি নেই। এমনকী লিখিত কোন নিদর্শনও নেই তাদের ভাষায়। নিজেদেরকে তারা লালং জাতি হিসেবেই গণ্য করে।
রাজবংশী: ভারতের কোচবিহার অঞ্চল থেকে আগত কোচ এবং পলিয়া জাতির মিশ্রণজাত সম্প্রদায় হচ্ছে রাজবংশী। হাচিসন ও ডালটনের লেখা থেকে জানা যায় ষোল শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোচ রাজা হাজোরের বংশধরগণ ‘কোচ’ ত্যাগ করে ‘রাজবংশী’ গ্রহন করে। দৈহিক গঠনে এরা মঙ্গোলীয় হলেও এদের মধ্যে অস্টো-এশিয়াটিকের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। ভাষা বিচারে এরা বৃহত্তর বোড়ো ভাষা গোত্রভুক্ত হলেও বর্তমানে তা লুপ্ত হয়ে সেখানে বঙ্গকামরূপি> কামরূপি মিশ্রণ ঘটেছে ব্যাপক ভাবে। ফলে এ ভাষার আদিরূপ সম্পর্কে এখন জানা যায় না। যেহেতু তাদের ভাষায় কোন লিপি ছিল না সে কারণে সাহিত্য-নিদর্শন বা কোন প্রমানাদি নেই। ‘বোড়ো ভাষার উৎস জাত শব্দাবলী ও বোড়ো ভাষার অপভ্রংশ শব্দ পরিলক্ষিত হয়। এখনো তাদের ভাষায় বাংলা ক্রিয়া পদে ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ‘ঙ’, ‘ং’ এবং ‘ম’-এর উচ্চারণ ও ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব শব্দ রাজবংশীদের কথ্য ভাষায় বহুল প্রচলন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ-পন্ডিতগণ-তাদের আদি ভাষাকে বোডো ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন। সুনীতিকুমার এবং ড. রফিকুল ইসলাম বাংলা ভাষায় বোড়ো প্রভাবের কথা উলেখ করেছেন। রাজবংশীরা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রংপুর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, যশোর, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় বাস করে। ধর্র্মীয় দিক থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এদেরকে আদিবাসী রূপে পৃথক করে গণনা করা হয় না। তাই বাংলাদেশে এদের সঠিক জনসংখ্যা বিষয়ে কোন ধারণা নেই। সবমিলিয়ে ২০ হাজার বা তার বেশি হবে।
কুকি-চীন শাখা: এই শাখার ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতেয় মণিপুরী, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো ইত্যাদি।
মৈতেয় বা মণিপুরী: মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের তিব্বত-বর্মি শাখার কুকি-চীন গোত্রভুক্ত জাতি হচ্ছে মনিপুরী। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ময়মনসিংহ, কুমিলা এবং ঢাকায় এক সময় তাদের বসতি থাকলেও বর্তমানে নেই বললেই চলে।১৯৯১ সালের গণনায় দেখা যায় বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ২৪,৯০২ এবং ভারতে ১২৭,০২১৬ জন। বার্মাতেও এদের বসবাস রয়েছে। ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত। মৈতেয় মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতেয় মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতেয় পুরনো একটি ভাষা। অন্য দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। এই ভাষাভাষীরা তাদের ভাষা প্রাচীন দাবী করলেও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই । পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতেয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র ৩৩-১৫৪ খ্রিঃ। তখন মৈতেয় ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বা-র ১৫৯৬-১৬৫১ খ্রিঃ শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু সপ্তম শতকে এক ব্রোঞ্জ মুদ্রার উপর মৈতেয় বর্ণমালার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতেয় বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।
মৈতেয় বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় হাতে লেখা যে পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতেয় ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুনথক এবং নুমিত কাপ্পা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতেয় মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী। যেমন: বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা, আবার বাংলা ‘স’-এর মনিপুর প্রতিবর্ণ হচ্ছে ‘সম’ যার অর্থ চুল। ভারতের মনিপুর রাজ্যের বাক-ভাষা হিসেবে মনিপুরী সরকারি ভাবে স্বীকৃত।
খুমি ভাষা: খুমিরা প্রধানত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রামের বান্দরবান জেলায় এবং মায়ানমারের আরাকান পার্বত্য অঞ্চল, চিন রাজ্য ওঞ্জ পশ্চিম মায়ানমারে বসবাস করে। বেশ কতগুলি বিশেষ পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় হতে খুমিদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নৃতাত্ত্বিকভাবে খুমিরা আদি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করা হয়। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্যান্য জাতিসমূহের মত খুমিদেরও রয়েছে ফর্সা ত্বক, লম্বা-সরু কালো চুল, চওড়া ও চ্যাপ্টা নাক এবং মুখোমন্ডল, ছোট চোখ সর্বপরি খুব মোটা ও শক্ত পায়ের গোড়ালি। খুমি তিব্বত-বর্মি ভাষা পরিবারভূক্ত একটি ভাষা এবং তাদের ভাষায় নিজস্ব কোন লিপি নেই। আধুনিক সভ্যতার প্রভাবে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এলেও বলা যায়, খুমিরা তাদের আদি ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি, পার্থক্যসূচক ভাষিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ক্রম হ্রাসমান জনগোষ্ঠীর কারণে বর্তমানে খুমি ভাষা বিলুপ্তির পথে। গত দেড়শত বছরে বাংলাদেশে খুমি জনসংখ্যাঞ্জ অনেক কমে গেছে। এর ফলে খুমি ভাষা বিপন্ন প্রায় ঋভঢটভথণরণঢ। ১৯৯১ সালের বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত জনগণনায় দেখা যায় এদের সংখ্যা ১২৮১ জন।
ম্রো ভাষা: বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্রো আদিবাসী দীর্ঘ দিন যাবত বসবাস করে আসছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি মতে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ২২১৭৮ জন। যদিও কারো কারো মতে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার মত। ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শুধুমাত্র বান্দরবান জেলাতেই বসবাস করে। বান্দরবানের লামা, আলিকদম, থানছি, নাইখ্যাংছড়ি ও রুমা এলাকার প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে এদের বাস। বাংলাদেশের বাইরে মায়ানমারের আকিয়াব জেলায়ও (সিত্তুই) এরা বসবাস করে। এথনোলগ রিপোর্টে দেখা যায় সেখানে তাদের সংখ্যা ২০,০০০ মতো। সব মিলিয়ে বার্মাও বাংলাদেশে ৪০ হাজার ম্রো বাস করে। ধর্ম বিশ্বাসে প্রকৃতি পূজারী হলেও এদের কেউ কেউ খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও রয়েছ্।ে ‘তবে বর্তমানে নতুন ধর্ম “ক্রার্মা ধর্মে বিশ্বাসী অনেকেই। মেনলে ম্রো ক্রামা ধর্ম এবং ম্রো বর্ণমালার প্রবর্তক। ম্রোরা নিজেদেরকে বলে ‘মারুসা’। যদিও পার্বত্য অঞ্চলে তারা মুরং নামে পরিচিত। অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে। আরাকানী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা ত্রিপুরাদেরকেই ম্রং বলে। জনসংখ্যা এবং ভাষা বিচারে ম্রোরা সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যা লঘু হওয়ায় এদের অধিকাংশই বহুভাষী। মাতৃভাষা ছাড়াও তারা বাংলা এবং মারমা জানে। জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর ীওঅ-এ- ম্রো ভাষাকে বর্মী দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এবং এ ভাষাকে একটি জটিল ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ভাষা গবেষক সুগত চাকমা জানাচ্ছেন ‘ম্রোদের ভাষা আমি ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। তাদের ক্রিয়াপদ ও বহুবচন গঠনে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ভাষার সাথে বর্মী ভাষার চেয়ে কুকি-চিন ভাষাগুলির অধিক মিল রয়েছে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:২৩