ঈশান সবার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
- আই’ম সরি ফর বিহেভিং দিস ওয়ে ইন ফ্রন্ট অফ এভরিওয়ান। বাট ওলি ডিজার্ভড ইট। হি মাস্ট অ্যাপলজাইজ টু অহনা রাইট নাউ, ইন ফ্রন্ট অফ এভরিওয়ান। এন্ড উই নিড অ্যা স্ট্রিক্ট রুল ইন দিস অফিস নো ওয়ান শুড এভার ডিসরিসপেক্ট উইমেন হিয়ার এগেইন। স্যার, ম্যাডাম, হোয়াট ডু ইউ সে?"
কিছু সময় চুপ থাকার পর সবাই এক সময় ঈশানের কথায় সম্মতি জানালো, গুলশান আরা ম্যাডাম কালো মুখ করে ছটফট করতে করতে সম্মতি জানিয়ে আরেকটি ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো তার পি,এস জসীম উদ্দিন কে নিয়ে।
তারপর ওলি বার দুয়েক খুক খুক করে কেশে নিয়ে গলা পরিস্কার করে অহনাকে বললো যে তার ভুল হয়ে গেছে সে যেন তাকে মাফ করে দেয়। সবশেষে বললো স্যরি, বলেই উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আরেকবার স্যরি বলে উপস্থিত স্যারদের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে, তার পুরো জীবনে এই পর্যায়ের অপমান বুঝি আর হয় নাই।
মিটিং শেষ; ঘোষনা দিয়ে স্যাররাও যে যার মত চলে গেল। অহনা করিডোর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ভাবছে এই চাকরি এই যুদ্ধ এসব করে কী হবে!! অর্থহীন একদম, এর থেকে তো ভালো আসমা আপার দেবরকে বিয়ে করে ফেলা। মাঝেমধ্যে আসমা আপাও বড় জা হিসেবে খোঁচা টোচা দিয়ে কথা বলবে অবশ্য, কি আর করা, মেনে নিতেই হবে, জীবন মানেই তো যুদ্ধ।
যুদ্ধ তো সবখানেই থাকবে, এইসব কনফ্রন্টেশন ও থাকবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলে হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হবে, জাস্টিস-এর আশায় ডিসআপয়েন্টমেন্ট হতে হবে। তবে একটা ম্যারেজ সেটলমেন্ট হয়ে গেলে মা-বাবাও খুশি থাকবে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীরও মুখ বন্ধ হবে। সব লাইফই এক্সহস্টিং।
***
অফিসের বিলাসবহুল ভবনের উনিশ তলায়, বিশাল জানালার ভেতর দিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরজুড়ে। মনোক্রোম মার্বেল ফ্লোরস, আধুনিক ডিজাইনের সিলিং লাইটস, আর দেয়ালজুড়ে দামি আর্ট পিসেস, কফির মগে চুমুক দিয়ে আয়েশ করে কফি পান শেষে ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুমি শিওর? হালকা হাসির রেখা ঠোঁট জুড়ে তার, চেয়ারের হাতলে কয়েকবার আঙুল দিয়ে টোকা দিলেন এই অফিসের ওনার এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর আশরাফ চৌধুরী। তাঁর চোখদুটো ঈশানের দিকে নিবদ্ধ, ছেলেটাকে বিয়ের জন্য রাজিই করানো যাচ্ছিল না, ওর বাবা মা অর্থাৎ আশরাফ চৌধুরীর ছোট ভাই আর ভাইয়ের বউ সারাক্ষন উনিকে এই বলে টায়ার্ড করে দিচ্ছে যে ঈশানকে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে, আশরাফ চৌধুরীর কোন সন্তান না থাকায় ঈশানের সেই মেইন গার্ডিয়ান, ওর বাবা মাও এতে কোনদিন আপত্তি করেননি, ঈশানের জীবনের বড় বড় সব সিদ্ধান্ত আশরাফ চৌধুরীর কথায়ই হয়েছে, ঈশান ও ব্যাপারটা জানে তাইতো ওর চাচার কাছেই এসেছে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা জানাতে।
আশরাফ চৌধুরী মনে মনে খুব করে চাইছিল ঈশান বিয়ে করে এদেশেই সেটেল হোক, আর অফিসের সমস্ত দায়িত্ব বুঝে নিয়ে তাকে নিশ্চিন্ত করুক। আজ যেন না চাইতেই বৃষ্টি এসে গিয়েছে তার জীবনে! ঈশান অফিসেরই একটি মেয়ে পছন্দ করেছে! কি আশ্চর্য!! তিনি একটু হালকা গলায় বললেন
- তোমার মা বাবাকে বলেছো?
- না চাচ্চু তোমাকেই আগে বলতে এলাম,
- নো প্রবলেম, আমি ওদের সাথে কথা বলছি, বাট ইউ নো দ্য রুল,কলিগদের মধ্যে বিয়ের অনুমতি নেই এই অফিসে, তুমি মালিক হয়ে সেই রুলস যদি ব্রেক করো!! ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ম্যারি অ্যা কলিগ, ইউ নো হোয়াট ইউ হ্যাভ টু ডু?
ঈশান একটু হাসল। তার চোখে মুখে একটুও দ্বিধা নেই এখন আর, সে সব চিন্তা করেই এখানে এসেছে।
আশরাফ চৌধুরী ঘুরে তাকালেন ঈশানের দিকে। কিছুক্ষণ ওর চোখের গভীরে তাকিয়ে রইলেন, বুঝতে চাইছেন—এটা কেবল আবেগ না তো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন।
- বেস্ট অফ লাক!" তার ঠোঁটের কোণে হাসি থামতেই চাইছেনা।
***
অফিসের ব্যস্ততায়, কাজের চাপে, ফাইলের স্তুপ নিয়ে কম্পিউটারের কীবোর্ডের ক্লিক ক্লিক শব্দে কাজ করে যাচ্ছে একমনে অহনা তার মাঝেই ওর ডেস্কের ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ঈশানের কণ্ঠ
- অহনা ম্যাডাম
- জী ভাইয়া
- আমাকে ভাইয়া বলার দরকার নেই
- কেন ভাইয়া
- এমনি বলছি ভাইয়া
খিলখিল করে হেসে উঠলো অহনা, ওপাশ থেকে শুনতে ভালো লাগছে ঈশানের, অনেকদিন পর অহনার হাসি শুনতে পেল, এই হাসি শোনার জন্য কত দিন যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছে সে কি অহনা জানে! নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললো
- অহনা আমি ভেবে দেখলাম আপনার এই অফিসে চাকরিটা কন্টিনিউ করা ঠিক হবে না।
- হুম ঈশান ভাই আমিও ভেবেছি সেই কথা, এই চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে ঘর সংসার করি তাই ভালো।
- ভালো ভেবেছেন, তাহলে আমার অনুরোধ থাকবে আপনি আজকেই আপনার রিজাইন লেটার মেইল করে দিন, এইচ আর হেড রবিউল স্যার, এইচ আর অল, আর অ্যাডমিন হেডকে মেইল করুন ও হ্যাঁ আমাকে সিসিতে রাখবেন। এই বলেই রেখে দিল ও ফোন।
ঈশান কিছু বলার সুযোগই দিল না অহনা কে, এভাবে হঠাৎ রিজাইন দিতে বলার মানে কি, রিজাইন দেওয়া ওর ব্যক্তিগত, নাকি অফিস ম্যানেজমেন্টই চাইছে না ওকে রাখতে!! কিছুটা মন খারাপ ভাব নিয়ে রিসিভারটা রেখে দেওয়ার সাথে সাথেই আবার ল্যান্ডফোনটি বেজে উঠল অহনার, রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বর্ষা আপু সব সময়ের মতন ঢং করতে করতে বললো
- ডিয়ার অহনা ম্যাডাম আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, দয়া করে কি আপনি একটু নিচে আসবেন? আপনার গেস্ট কে গেস্ট রুমে বসিয়ে রেখেছি, উনাকে উইদাউট সুগার লেমন টি দেয়া হয়েছে কারণ উনি দুধ চা খান না, উনি বুর্জ খলিফার গোল্ড টি পান করেন। এ ধরনের হালকা রসিকতায় অভ্যস্ত অহনা বললো
-আপু অফিসে তো আমার সাথে কেউ দেখা করতে আসে না কে বলুন তো?
- যে এসেছে সে হচ্ছে গিয়ে সৌদি আরবের আমির। উনি উনার ল্যাম্বরগিনিতে করে সৌদি থেকে দুবাই বাই রোডে বুর্জ খলিফায় গিয়ে রোজ গোল্ড টি পান করেন, হাহাহাহা হিহিহিহিহি ফোনের ওপাশ থেকে লম্বা হাসির শব্দ।
অস্বস্তিতে ভরে গেছে অহনার মন, তবে কি আসমা আপার দেবর এসেছে দেখা করতে! হে আল্লাহ একি একের পর এক পরীক্ষা!!
হাসতে হাসতে বর্ষা আপু আবারো বললেন
- শোনো অহনা তোমার জন্য আরেকজন আশিক দিওয়ানা হয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে অফিসে ঘোরাঘুরি করছে।
- ওহ কাম অন আপু ওলি ভাইকে নিয়ে নো মোর ফান। আর কত!!
- আরে ওলি ভাই না ওলি ভাই না,
- তাহলে কে?
- তাহলে কে সেটা আমাকে বলে দিতে হবে!
- বলো আপু আমার অত বুদ্ধি নেই, আমি তো মানুষটা অনেক বোকা জানোই তো তোমরা!
- তার প্রথম অক্ষর হচ্ছে "ই"
- এসব সিম্বলিক কথা আমি বুঝিনা, আমি নিচে আসছি। আগে গেস্ট কে তো বিদায় করি, এই বলে ফোন রেখে জড়োসড়ো অহনা অফিসে জানাজানির আগেই পরিমরি করতে করতে দ্রুত নিচে আসলো গেস্ট তাড়াতাড়ি বিদায় করতে। অফিস থেকে তার চাকরি গেছে মানে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আদেশ এসেছে , আদেশ পালন শেষ হলেই চাকরি শেষ। সৌদির বাদশা আপনি একটু বাসায় অপেক্ষা করতে পারলেন না এইখানে চলে আসলেন এমনিতেই আমার নৌকাডুবি চলছে।
লিফট দিয়ে একের পর এক ফ্লোর ক্রস করে অবশেষে গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছালো অহনা। দূর থেকে গেস্ট রুমের ভেতরে দেখা যাচ্ছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা জুব্বা পড়া একজনকে,
অহনা গেস্ট রুমে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়াতেই বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে এসে দীর্ঘ সালাম দিলেন অতিথি।
— আমি আমির। হয়তো আমার কথা শুনেছেন, আজকে আপনাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত এবং আমি সেই ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি,
- আচ্ছা
- সত্যি বলতে আপনাকে দেখে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
অহনা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
— আপনি তো আমাকে কেবলই দেখলেন, চেনেনই না!
— চেনার জন্য দীর্ঘদিন দেখা বা কথা বলার প্রয়োজন হয় না। আপনি আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর, যদিও ছবিতে আগেই দেখেছি। আমি আপনাকে কিছু লুকাবো না, আমার ভাই হয়তো বলেছি আমি সেখানে চাকরি করি, কি চাকরি করি সেটা হয়তো বলে নাই, সৌদি আরবের আভা নামের একটা শহরে মসজিদে ইমামতি করি, জায়গাটা বড় বড় পাথর আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা, আমাদের দেশে যেমন উপজাতি আছে না ওখানকার মানুষ অনেকটা সেরকম তবে আমি সেই জায়গাটার সেখানকার মানুষ কে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। আমার জীবন খুব সাধারণ, বড় কোন চাওয়া পাওয়া নাই,
আমি চাই আমার ছোট জীবনটা সেখানেই পার করে দিতে আমার সঙ্গীনির সাথে, আজ আপনাকে বাসায় যেয়ে আংটি পড়ানোর কথা, ভাবলাম তার আগে আপনার সাথে ডিসকাস করা দরকার অথবা আমার সম্পর্কে হয়তো ভালো করে কিছু জানেন না তাই অফিসে এসেছিলাম আপনাকে সবকিছু বলতে, আপনি কি আমার সাথে এরকম সাদাসিধা একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন?
অহনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি একের পর এক জটিল হয়ে উঠছে ওর, কি জবাব দিবে, কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না, বাবা-মা ছেড়ে তাই বলে এতদূর গিয়ে থাকা, ও তো কখনো এরকম ভাবেনি! ভনভন করে কানের কাছে মৌমাছি ঘোরার মতন শব্দ হচ্ছে।
আমির আবারো বলে উঠলো-
- আমি জানি, আপনি শিক্ষায়, দীক্ষায়, সৌন্দর্যে আমার চেয়ে অনেক ওপরে। কিন্তু একজন পুরুষের জীবনে যদি এমন একজন নারী আসে, যাকে সে সত্যিকারের জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়, তবে সে অপেক্ষা করবে না। আমি শুধু আমার মনের কথা জানাতে এসেছি আপনাকে।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন ঈশান এসে হাজির হয় সেখানে। অহনাকে কোন কিছু না বলেই হাত বাড়িয়ে দেয় আমিরের দিকে, এরপর হাত না ছেড়েই তার কাঁধে আর একটা হাত রেখে কথা বলতে বলতে একদম অফিসের মেইনগেট পেরিয়ে বাইরে চলে যায়, কাঁচের দেয়ালের পাশে সেদিকে তাকিয়ে অহনার বুক কাঁপছে ওর কাছে মনে হচ্ছে সামথিং ইজ রং টু ঈশান ভাই।
অহনা নিজের ডেস্কে ফিরে এলো, সাত মাস ধরে এই জায়গাটা তার নিজের একটা ছোট্ট জগৎ ছিল। ডেস্কটপের স্ক্রিনে কার্সরটা অনবরত ব্লিঙ্ক করছে, অথচ তার আঙুলগুলো কি-বোর্ডে স্থির, ডানদিকে রাখা ছোট্ট মানিপ্ল্যান্টটা, এই ডেস্ক, এই চেয়ার, এই নোটপ্যাড, সবকিছু ও মিস করবে।
তারপর ও এখান থেকে যাওয়া জরুরী, বর্ষা আপু ইশান ভাইকে ইঙ্গিত করেছে বোঝাই যাচ্ছে, কোম্পানির মালিকের ভাইয়ের ছেলে সে, তার মত একটা মিডল ক্লাস মেয়ের সাথে কিছুতেই যায় না, এতদিন যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু সেটার সমাপ্তি এখান থেকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে কেটে পড়াই উত্তম, বাসায় যেয়ে সেই আসমা আপার দেবরের সাথে তিন কবুল বলে এই সব কিছুর মায়া কাটিয়ে চিরতরের জন্য সৌদির আভায় গিয়ে বসবাস করলেই ব্যাস সব খেইল খতম।
শ্বাস গভীর করে টেনে নিয়ে মন শক্ত করে টেনশন থেকে বের হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায় টাইপ করতে শুরু করে
"Dear Sir,
I hereby submit my resignation..." পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি তখন সে মেইলটা সেন্ড করে ভেতরে ভেতরে কাঁপছে ও, ভাবছে আর যাই হোক ঈশান ভাইয়ের আর মুখোমুখি হওয়া যাবে না।
বেসমেন্টের যে শর্টকাট রাস্তাটা দেখিয়েছে ওকে ঈশান সেখান থেকে গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় সহজেই পৌঁছানো যাবে, সেখানে গিয়ে অফিসের গাড়িতে ঢুকে বসে থাকলেই হলো,এইসব অফিস! চাকরি বাকরি! ঈশান! না কিছুতেই মুখোমুখি হওয়া যাবেনা ঈশানের সাথে, এগুলোতে তার কাজ কি বাবা! ।
সেই বেসমেন্ট, যেখান থেকে এত ঘটনার শুরু, আজ বিদায়ের দিন সেই বিখ্যাত বেসমেন্টের করিডোর পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে কার পার্কিং এরিয়ার ডোরের সামনে আসলো অহনা, মনটা সত্যিই খারাপ লাগছে।
অহনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ গ্লাসের এপাশে, অহনাকে দেখতে পেয়ে এক সিকিউরিটি গার্ড দরজা খুলে দিল, কোন জরুরী প্রয়োজনে হয়তো এ দিক দিয়ে এসেছে ভাবলেন সিকিউরিটি গার্ড, গাড়িগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পার্কিং এরিয়ায় এক কোণে অফিসের সাদা হায়েস গাড়িটা রাখা অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে দ্রুত দরজা খুলে সেটায় উঠে বসে অহনা।
এইদিকে অফিসের গাড়িটা গেটে আসতেই অন্যান্য সব কলিগরা গাড়িতে উঠে বসার পর গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে ঈশান হন্তদন্ত হয়ে অফিসের গেটে দৌড়ে আসা ঈশানকে পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলে এলো অনেকটা। ঈশান দ্রুত ফোন করলো ড্রাইভার আবুল ভাইকে।
আজ অহনার পাশের সিটে বুলবুল ভাই বসেছে, সব সময় কমেডি মুডে থাকা বুলবুল ভাইয়ের অহনার চেহারায় বিষন্নতা এড়ালো না, বললেন
- কি ব্যাপার আমাদের অহনা ম্যাডামের আজ মন খারাপ বুঝি? অহনা বললো
- হুম ভাইয়া, এই মুহূর্তে আমার কি করতে ইচ্ছে করছে জানেন?
- কি ইচ্ছে করছে?
- ইচ্ছে করছে ঝেড়ে একটা দৌড় দেই,
-তারপর?
- তারপর দৌড়াতে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা উঁচু পাহাড় থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
- আত্মহত্যার জন্য?
- কিছুটা সেরকমই
- আচ্ছা
ধরেন, সেই ঝাঁপ দেয়ার মুহূর্তে দেখলেন আপনার সামনে একজন অতি হ্যান্ডসাম যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে যে আপনাকে প্রচুর ভালোবাসে, তখন আপনি কি করবেন? সাগরে ঝাঁপ দিবেন না ঐ যুবককে জড়িয়ে ধরে নতুন একটা সুখী জীবন শুরু করবেন?
- বুলবুল ভাই আপনি ফান করছেন কেনো
- বলুন না ম্যাডাম
- এরকম কোন যুবকের অস্তিত্ব নাই
- যদি বলি আছে
- নাই নাই
কথাটা বলে অহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে গাড়ি অফিসের গেটের সামনে থেমে আছে, গাড়ি ঘুরিয়ে আবার অফিসের সামনে নিয়ে আসার মানে কি! সবার জোরাজুরিতে গাড়ির দরজা খুলে নামতে বাধ্য হল অহনা একরাশ বিস্ময় নিয়ে গেটে দাঁড়ানো ঈশানের দিকে তাকালো সে।
ঈশান এগিয়ে এল, একটু হাসলো, তারপর গভীর মুগ্ধতা নিয়ে বললো
- অহনা, আমার সম্পর্কে তুমি প্রায় সবই জানো। এই জীবনে আমার তেমন কোনো চাওয়া নেই, শুধু একটা মানুষ চাই, যে আমার পাশে থাকবে, আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে। যখন তুমি হাসো, মনে হয়, চারপাশের সব কিছু ঝলমলে হয়ে ওঠে আমার সবকিছু ঠিক মনহয়, তোমার এই হাসি ছাড়া জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দেয়া আমার জন্য অসম্ভব। আমার তোমাকে ছাড়া এই জীবনে আর শান্তি নেই, যদি আমার শান্তি নষ্ট করতে না চাও তবে,
-তবে?
-তবে তোমার হাতটা বাড়িয়ে দাও, আর যদি চাও তোমার সেই সৌদির পাত্রকেই বিয়ে করতে তবে গাড়িতে উঠে চলে যাও আমি বাধা দেব না,
তোমাকে ভাবার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।
অহনার বুক ধক করে উঠল। মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, ও কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, বাসের দিকে তাকালো, বাস থেকে বুলবুল ভাই, সাফায়েত ভাই, রুনু আপু, সেলিনা আপু, বর্ষা আপু সবাই অহনা অহনা করে চেঁচিয়ে বলছে, রাজি হয়ে যাও অহনা ঈশান ভাই ভালো।
কি যে ভালো!! অহনা ভাবে, ঈশানকে দেখলেই অহনার ভয় লাগে।
বেশিক্ষণ এভাবে থাকা যাবে না। অহনার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, দূরে গেটের দিকে তাকালো সেদিকে দৌড় দেবে কিনা।
দুইটার একটা অপশন ও ওর পছন্দ হচ্ছে না। দেখুন ঈশান ভাই আমি একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে... অহনার কথাগুলো চিৎকার চেঁচামেচিতে শোনা গেলো না, সবাই বুঝে নিলো অহনা রাজি, তখনই ঈশান অহনার হাতটা ধরে ওর নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো, আগে থেকেই কিনে রাখা আংটি পড়িয়ে দিল দ্রুত, চারদিকে করতালি।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ড্রাইভার আবুল ভাই ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিল।
তার দেড় মিনিটের মাথায় সেটা বন্ধ করে দিয়ে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কারণ সেখানে স্বয়ং আশরাফ চৌধুরী উপস্থিত।
আশরাফ চৌধুরীর গম্ভীর কিন্তু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ
— অহনার বাবা-মার সাথে আমার কথা বলিয়ে দাও, বিয়ে আজকেই হবে!"
আজকেই বিয়ে?!"
বুলবুল ভাই প্রথমেই লাফিয়ে উঠলেন। তারপর একে একে সবাই, উচ্ছ্বাসে, অবিশ্বাসে, আনন্দে চিৎকার করে উঠল। কেউ খুশিতে হাততালি দিচ্ছে, কেউ মোবাইল বের করে আত্মীয়দের ফোন করছে, কেউ আশরাফ চৌধুরীকে ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পরামর্শ নিচ্ছে কীভাবে এত দ্রুত সব আয়োজন করবে তা নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:১১