'ব্যক্তিত্বহীন বা পার্সোনালিটি লেস' - শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কারো আচরণে ক্ষেপে গিয়ে আমরা এ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি। আসলে কিন্তু কোনো মানুষই ব্যক্তিত্বহীন নয়। সব মানুষেরই ব্যক্তিত্ব আছে। ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকাকেই বোঝায়।
ভাল হোক অথবা মন্দ হোক কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য নিয়েই এক একটি মানুষ গড়ে উঠেছে। সাধারণত যেসব লোক গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারেনা, যখন যেমন তখন তেমন ধরনের কোনো কাঠিন্য বা দৃঢ়তা ও রূঢ় নেই এবং যারা ব্যক্তি স্বাতস্ত্য বজায় রাখতে পারেনা তাদেরকেই ‘ব্যক্তিত্বহীন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এগুলোও ব্যক্তির কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিত্ব। তাই তার একটি ব্যক্তিত্ব (পার্সোনালিটি) রয়েছে। তা যে নামেই নামকরণ করা হোক না কেন।
অনেকের ক্ষেত্রে আবার আমরা ‘ব্যক্তিত্ববান’ মন্তব্য করে থাকি। কিন্তু এটাও একটি যুক্তিসঙ্গত ধারণা নয়। কেননা ব্যক্তিত্ব কোনো ভালমন্দের মাপকাঠি নয় যে এর ব্যক্তিত্ব কম, ওর ব্যক্তিত্ব বেশি এমন ভাবে তুলনা করা যেতে পারে। যারা কথা কম বলে, ভেবে চিস্তে জবাব দেয়, সহজে আবেগ তাড়িত হয়না, সবসময় একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সম্পর্ক নির্ধারণ করে, সে ধরনের লোকদেরকেই ‘ব্যক্তিত্ববান’ বলে ধরা হয়। কিন্তু এটাও একটি বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্ব হতে পারে। তাই বলে কখনই তা অধিক ব্যক্তিত্ববান তা ঠিক নয়। সব রকমের ব্যক্তিত্বেই ভাল মন্দ, উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো বৈশিষ্ট্য কখনো প্রকাশ পায় আবার কোনোটা কখনই প্রকাশ পায় না।
প্রত্যেক মানুষেরই কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকে যা তার নিজের এবং বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে ধ্যান-ধারণা আচার-অনুষ্ঠানকে দৃঢ়ভাবে নির্ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্যকেই ব্যক্তিত্ব বলা হয় এবং ব্যক্তির এই বিশেষত্ব দিয়েই একের সঙ্গে অন্যের ভিন্নতার বিচার করা হয়।
ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি কি?
ইংরেজী অভিধানে ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে - ‘দ্য হুল ন্যাচার অর ক্যারেকটার অব এ পারটিকুলার পারসন।’
অর্থাৎ- কোনো ব্যক্তির পুরো জীবনের প্রকৃতি বা আচার-আচরণই হল তার পার্সোনালিটি। ব্যক্তিত্ব (পার্সোনালিটি) সম্পর্কে রবার্ট জেন্ড একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হল-‘ মানুষের মাঝে একটি বিষয়ই সাধারণ তা হল তারা সকলেই স্বতস্ত বা ভিন্ন প্রকৃতির।’
বিজ্ঞানী আল পোর্টের মতে- ব্যক্তিত্ব হল ব্যক্তির মধ্যে ঐসব মনোদৈহিক প্রক্রিয়ায় গতিময় সংগঠন কার্য পরিবেশের সাথে তার অনুপম অভিযোজন নির্ধারণ করে।
উডওয়ার্থ ও মারকুইস বৈজ্ঞানিকদ্বয় বলেন, ব্যক্তির আচরণের গুণ যা তার চিস্তার ধরন ও প্রকাশ ভঙ্গি। মনোভাব ও আগ্রহ, কাজের প্রক্রিয়া তথা তার সম্পর্ণ জীবন দর্শনে প্রকাশ পায় তাকে ব্যাপক অর্থে পার্সোনালিটি বলা হয়। ব্যক্তিত্ব ব্যক্তির সকল বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ, ব্যক্তির দৈহিক গঠন, চেহারা, চুলের ধরন, শক্তি-সামার্থ্য এবং তার বিশ্বাস- অবিশ্বাস, মনোভাব, মূল্যবোধ, আবেগ, প্রকাশ ভঙ্গি প্রভৃতি মিলে সৃষ্টি হয় পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্ব। তবে এসব বৈশিষ্ট্য কমবেশি সবার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক ব্যক্তিরই ব্যক্তিত্ব আছে, কারো ব্যক্তিত্ব (পার্সোনালিটি) নেই, এমন কথা কোনো ভাবেই বলা যাবে না।
ব্যক্তিত্বের ধরণ
সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ং মানসিক গুণাবলীর ভিত্তিতে ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটিকে দু’ ভাগে ভাগ করেছেন --
অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব (ইনট্রোভার্ট) এবং
বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব (এক্সট্রোভার্ট)।
১. অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব
এরা একা একা ও আলাদা থাকতে পছন্দ করে। এধরনের ব্যক্তিরা খুব চিস্তাশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী হয়। এধরনের লোকেরা তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে বদ্ধপরিকর। এরা সাহিত্য, শিল্পকর্ম এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম।
২. বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব
এ ধরনের লোকেরা বাইরের জগতের নানাবিধ কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। এরা অন্যের কাজকর্ম করে দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলা-ধুলা, সমাজ-সেবা, রাজনীতি, বিদেশ সফর প্রভৃতি কাজ এদের কাছে অতি প্রিয়।
বিকারগ্রস্থ ব্যক্তিত্ব
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যখন এমন কিছু বিশেষত্ব থাকে যা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাকে খর্ব করে এবং তা ঐ ব্যক্তি কিংবা সমাজের অন্যদের পক্ষে পীড়াদায়ক বা ক্ষতিকারক হয়, তখনই ঐ ধরনের ব্যক্তিত্বকে ব্যক্তিত্বের বিকার বলা হয়।
নিম্নোক্ত ব্যক্তিত্বের বিকারগুলো সাধারণতঃ প্রায়ই দেখা যায় :
১। সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তিত্ব : এক ধরনের লোক আছে যারা অহেতুক মনে করে অন্য লোক তাদের পেছনে লাগছে, ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। এরা সন্দেহ করে অন্য লোকে কেবল তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এদের কাজে লাগায়। এরা নিজেদের আত্মীয়, বন্ধু অথবা সহকর্মীদের উপর আস্থা রাখতে পারে না। স্বামী অথবা স্ত্রীর চরিত্রে সন্দেহ করে দাম্পত্য জীবনকে বিষিয়ে তোলে। অতি তুচ্ছ কারণে এরা অপমানিত বোধ করে। এরা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না এবং সবসময় সতর্কভাবে চলা ফেরা করে। এদের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে মনোচিকিৎসা (psychotherapy ) সম্ভব হলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
২। সিজয়েড (চিত্তভ্রংশী) ব্যক্তিত্ব : এদের বৈশিষ্ট্যে হচ্ছে এরা আত্মকেন্দ্রিক, লোকজনের সাথে মেলামেশায় অনাগ্রহ এবং কল্পনাপ্রবণ। অসামাজিক মনোভাব এবং রসবোধের অভাব এদেরকে মানুষের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এদের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে মনোচিকিৎসা (psychotherapy ) সম্ভব হলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
৩। বিষণ্ণতাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব : এরা সর্বদাই বিমর্ষ, নৈরাশ্যবাদী, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং কাজকর্মে তৎপরতাহীন। এরা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। সাধারণতঃ নীতিবোধ এবং কর্তব্যপরায়ণতার দিকে এদের সজাগ দৃষ্টি থাকে।
৪। ফুর্তিবাজ ব্যক্তিত্ব : এরা বেশি আশাবাদী হয়, ফুর্তি আর হই-চই এর মধ্যে থাকতে ভালবাসে এবং জীবনকে উপভোগ্য মনে করে। এদের বিচারবুদ্ধি অনেকসময় দুর্বল হয় এবং বিবেচনা না করেই চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।
৫। আবর্তনশীল ব্যক্তিত্ব : এরা কিছুদিন বিষাদে কাটায়, কিছুদিন ফুর্তিতে চলে, আবার কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে থাকে।
৬। উৎকন্ঠাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব : সব কিছুতেই এদের দুশ্চিন্তা, বিপদের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেখতে এরা অভ্যস্ত। তিলকে তাল করে দেখতে এদের জুড়ি নেই, সব সময়েই এরা ভয়-ভীতি-আতন্কের মধ্যে থাকে এবং আশ্বাস ছাড়া এরা চলতে পারে না।
৭। অহঙ্কারী ব্যক্তিত্ব : এরা নিজেদের অহেতুক অত্যন্ত বড় মনে করে যেটা তাদের চাল-চলনে কথা-বার্তায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এরা সবসময় নিজেদের প্রশংসা চায়, নিজেদের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। অন্যের সাফল্যকে এরা ঈর্ষার চোখে দেখে। যেখানে কিছু পাবার আশা, এরা বন্ধুত্ব পাতায় শুধু সেখানেই।
৮। অবসেসনাল ব্যক্তিত্ব : এরা সব জিনিসই নিখুঁতভাবে করতে চায়। খুঁতেখুঁতে মনোভাবের দরুন ক্ষুদ্র অপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দিতে গিয়ে কোনো জিনিসকে পছন্দ করে উঠতে পারে না। নিয়মানুবর্তিতা, সময় নিষ্ঠতার প্রতি অনমনীয় দৃঢ়তা রাখতে গিয়ে এরা ব্যবহারিক জীবনে সামজ্ঞস্য করে চলতে পারে না। এরা প্রায়ই কৃপণ স্বভাবের হয়। স্নেহ-ভালবাসার আদান-প্রদানে যথেষ্ট সন্কোচ থাকার জন্যে এদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা খুবই সীমিত হয়। নির্দিষ্ট কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করার পক্ষপাতী এরা।
৯। নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব : অন্যের উপর নির্ভরতা এবং পরমুখাপেক্ষিতাই এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরা দুর্বলচিত্ত হয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব, হীনমন্যতা এবং অসহায় ভাবের জন্য অন্যের বাধ্য হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এরা অন্যের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে।
১০। সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব : এরা অল্প বয়স থেকেই অপরাধ প্রবণ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেপরোয়া, কলহপ্রবণ এবং উগ্র স্বভাবের হয়। এরা স্নেহ-ভালবাসা বর্জিত নির্মম-নিষ্ঠুর, আপরাধবোধহীন এবং নিজের স্বার্থের প্রতি খুবই সচেতন। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এরা শিক্ষালাভ করতে পারে না; তাই জেল, জরিমানা সত্বেও বারেবারে নির্বিচারে একই আপরাধ করে বসে।
মানুষের সাথে মানুষের ব্যক্ত্যিত্বের তফাৎ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যক্ত্যিত্বের দোষ-গুন যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, যা নিজের ও আশেপাশের লোকের সমস্যা সৃষ্টি করে তখন একে ব্যক্তিত্বের বিকার বলা যেতে পারে।
প্রত্যেক ব্যক্তিরই ব্যক্তিত্ব আছে, কারো ব্যক্তিত্ব (পার্সোনালিটি) নেই, এমন কথা বলা যাবে না কিছুতেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ২:৪৪