বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন মোড় এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষত, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পুনরুজ্জীবিত সম্পর্ক ভারতীয় কূটনৈতিক মহলে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
গত কয়েক দশক ধরে ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল ঠান্ডা, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্ষত, ভারতের প্রতি হাসিনার ঝোঁক এবং পাকিস্তানের প্রতি শীতল মনোভাবের কারণে দুই দেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোর ফলে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। গত মাসে সরাসরি বাণিজ্যের সূচনা, পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতা প্রমাণ করে যে দুই দেশ একটি নতুন পথ ধরেছে।
ভারতের জন্য বাংলাদেশ কেবল একটি কৌশলগত অংশীদার নয়, বরং ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দীর্ঘ সীমান্ত এবং ঐতিহাসিক সংযোগের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। শেখ হাসিনার আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সুসংহত ছিল, বিশেষ করে নিরাপত্তা সহযোগিতা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কারণে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাকিস্তানঘেঁষা নীতিতে ভারত সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক উষ্ণ ছিল, যা ভারত সন্দেহের চোখে দেখেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিও সেই স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের গুঞ্জন এবং সামরিক মহড়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ এই মুহূর্তে একটি বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে চাচ্ছে বলে মনে হয়। অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারিত করতে চাইছে। পাকিস্তানের ২৫ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাজার বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে।
তবে এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো দুই দেশের সম্পর্ককে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশ এখনও পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি, বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি এই ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর সুরাহাও গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নতুন রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইলে কৌশলগতভাবে সতর্ক থাকতে হবে। দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যেমন জরুরি, তেমনি ইসলামাবাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও লাভজনক হতে পারে। তবে সামরিক সম্পর্কের প্রসার ঘটলে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
অতএব, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই বিচক্ষণতা ও কৌশলী কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক বিঘ্নিত না হয়, একইসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২৫ ভোর ৪:৫৫