কলেজে পড়ার সমোয়ের কথা... বাসায় ড্রয়িংরুমে বসে আছি, আব্বা বাসায় ঢুকল একগাল হাসি নিয়ে। মাকে কি এক ইশারা করল। আব্বার পেছন পেছন ঢুকল এক কুলি ইয়া বড় এক খাজা কাঠাল কাঁধে। সাইজে আমার অর্ধেক হবে। এর মধ্যে মা তেল আর গামলা নিয়ে আমার সামনে বসে পড়েছে। কাঠাল খোলা হচ্ছে, কচকচে আধা পাকা কোয়া মা আমাকে খুলে খুলে দিচ্ছে আর আমি খাচ্ছি। আমার আশেপাশে কেউ আসছেনা খেতে, আমি একাই খাচ্ছি। আব্বা পাশে বসে পা নাড়াচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে কিন্তু চোখ ভর্তি পানি। আমি একটু অসস্থিতে পড়ে গেলাম, মাকে জিগ্গেস করলাম, "কি হইছে!"
ঘটনার সুত্রপাত আরো এক সপ্তা আগে। দুপুরে প্রচন্ড পেটে ব্যাথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম, ডাক্তার বল্ল ইমার্জেন্সি অপারেশন করতে হবে, এপেন্ডিসাইটিস। নিবেদিতা হসপিটালে বিকেলের মধ্যেই অপারেশন হয়ে গেল, সন্ধ্যার সময় কেবিনে দিয়ে দিল। তখন রোজার মাস। কেবিনে সবাই ইফতার করছে, আমি এনেস্থেশিয়ার ঘোরের মধ্যে কি করছি বা বলছি আমার কিচ্ছু মনে নাই। আব্বা ইফতার শুরু করছিল কাঠাল দিয়ে আর আমি নাকি হা করে তাকিয়ে ছিলাম। আব্বা ইফতার আর মুখে নিতে পারলেন না। আমি খেতে পারছিনা বলে কান্না শুরু করলেন।
-----------------------
এস এস এল এ কাজ করি তখন। দুপুরে অফিসের সিকিউরিটি অফিসার এমদাদ ভাই এসে বল্ল আমার সাথে এক মুরব্বি দেখা করতে চায়। আমি নিচে নেমে দেখি আব্বা! আবার মুখ ভর্তি হাসি!
"আব্বা তুমি এখানে!"
-"সকালে তোমার কথা মনে পড়ছিল, বাস ধরে চলে এলাম"
"আমার অফিস চিনলা কিভাবে!"
-"ঐযে তোমার ভিজিটিং কার্ড দিছিলা, এখান থেকে ঠিকানা বের করে নিছি। খাওয়া দাওয়া করছ? তোমার সাথে একটু খাওয়া দাওয়া করে আবার চলে যাব। তোমার মা কে কিছু বইলনা"।
আমি সাথে সাথে মাকে ফোন করলাম।
"মা, আব্বা কই?"
-"মসজিদে গেছে নামাজ পড়তে, কেন?"
"কখন গেছে?
-"ফজরের নামজের টাইমে যায়। এতিম খানার বচ্চাদের সাথে থাকে দুূপুর পর্যন্ত। এদের গোসল করায়, গল্প করে, খাওয়ায়.. এগুলা করে দুপুরের পরে বাসায় আসে"।
"আব্বা ত এখন ঢাকায়, আমার অফিসের সামনে! আমার সাথে লান্চ করতে আসছে!"
মা হাসে।
আব্বা, ৬-৭ ঘন্টা জার্নি করে চিটাগাং থেকে ঢাকা আসছে শুধু আমার সাথে লান্চ করতে! আব্বাকে থেকে যেতে বল্লাম, কিন্তু আব্বা লান্চ করে আবার চলে গেল!
আমি প্রতি মাসে চিটাগাং যাই। সন্ধ্যার পর বাস ধরি। আব্বা একটু পর পর কল করতে থাকেন... আর কদ্দুর? আর কদ্দুর? বাস ভর্তি মানুষ বিরক্ত হয়, এর এত কল আসে কেন! রাত ১টা, ২ টা, ৩টা বেপার না! পথে জ্যাম পরলে আব্বা খেপে যায়, "এই দুষ্ট লোকজন রাস্তা জ্যাম করে রাখছে! আদের কি কোন বিবেক নাই! কেমন মগের মুল্লক দেশ একটা!"।
-"আব্বা তুমি বাসায় যাও , আমি পৌছায় যাব"
"আরে আস তুমি, আমি আছি এখানে রাস্তার উপর"
আব্বা অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার এমন কোন বার এমন হয়নাই আমি চিটাগাং আসছি আর আব্বা আমাকে গাড়ি থেকে রিসিভ করে নাই। সে রাত, ভোর যাই হউক না কেন!
সকাল ৯ টার পর থেকে শুরু হবে আমার দরজায় ঠুকঠুক। আমি উঠে পড়লে যে আব্বা অনেক কথাবার্তা বলত তা না। জাস্ট তসবিহ গুনবে পাশে বসে, ক্রমাগত পা দোলাতে থাকবে আর তাকায় তাকায় হাসবে। একটু পর রাস্তা থেকে পেয়াজু নিয়ে আসবে। আমি প্রতিবারই বিরক্ত হই, "আব্বা, এগুলা রাস্তার পেয়াজু, ধুলাবালি ভর্তি! এগুলা আমি খাব না!"
-"আরে খাও আল্লাহর নাম ধরে! ফার্সট ক্লাস জিনিস, কিচ্ছু হবে না!"
আব্বার কথা হল, মা আমাকে এত কিছু বানায় খাওয়াচ্ছে এতে আব্বার কন্ট্রিবিউশন কি থাকল!
--------------------------------
আমাকে আব্বা পুরা লাইফে ধমক/বকা দিছে একবার। আমি আর কোন বকার কথা মনে করতে পারছিনা। সাউথ আফ্রিকা হেরে গেল অষ্ট্রেলিয়ার সাথে, আমি কাদছি। আব্বা মাকে জিগ্গেস করল, এর কি হইছে? মা বল্ল এর টিম হেরে গেছে বলে মন খারাপ হইছে! আব্বা বল্ল, "আরে! তোর মত গরু ত আমি আর দেখি নাই!" আব্বা এই বলে নামাজে চলে গেল। আমার গেল মাথা খারাপ হয়ে। আমি গরু! তাইলে আমি বাসাতেই থাকব না! আমি মাঠে থাকব। আব্বা এশার নামাজ পড়ে আসছে, খবর পাইছে আমি রাগ করছি। মঠে টর্চ নিয়ে এসে আমাকে পাইছে।
"এটা কেরে?"
-"আব্বা, আমি এটা, গরু!"
"গরু তুই এখানে কি করিস?"
-"গরু মাঠে কি করে? ঘাস খায়! আমি এখানে ঘাস খেতে আসছি!"
আব্বা হাসি আটকইতে পারলনা। আমিও আর রাগ নিয়ে থাকতে পারলাম না!
আব্বা মা ঝগড়া লাগলে মার রণ কৌশল হলাম আমি। আমি আব্বার সামনে গেলেই ঠান্ডা। আব্বা রাগ করে মসজিদে বসে আছে, আমি ওনার ৩-৪ কাতার পেছনে গিয়ে বসে থাকতাম। ব্যাস, একটু পর হাসি! চল, বাসায় চল!
২০১৯, ডিসেম্বার, আব্বার সাথে শেষবার দেখা হল যখন। আব্বা কাউকে চিনতে পারেন না! আমাকেও না! ভাবি আর মিনু আপা আব্বাকে ছাদে নিয়ে গেছে গোসল করাতে। আব্বা কোন ভাবেই গোসল করবে না! এদের ধাক্কা দিয়ে, ধমক দিয়ে একাকার। আমি ছাদে গেলাম। আব্বাকে বল্লাম, টুলে বসতে। আব্বা হাসি মুখে বসে পড়ল। ভাবি গোসল করাতে লাগল। আব্বা আমাকে বলতে লাগল, "এই দুইটা ভারি দুষ্ট! খালি যন্ত্রনা করে!" ভাবি, আপা বলতে থাকে, হুম আমরা খারাপ আর আপনার ছেলে আসছে আপনি একদম ভদ্র হয়ে গেলেন! গোসল শেষে ছাদে আমার হাত ধরে কিছুক্ষন হাটাহাটি করলেন।
-------------------------------
আব্বা মারা গেলেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, করনার জন্য আমি যেতে পারলাম না। কয়েক মাস পর আব্বাকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি মদুনাঘাট রেষ্টহাউজে যেখানে আমাদের শৈশব কেটেছে, ওখানে এক রুমে বসে আছি, হঠাৎ কেউ তালা খুলে ওই রুমে ডুকল। দেখি আব্বা। আব্বার বয়স ৪০-৪৫ মত হবে। মোচ, দাড়ি ছোট ছোট, কালো, আমার ছেলে বেলায় আব্বা দেখতে যেরকম ছিলেন, ওরকম। আব্বা আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেলেন প্রথমে। কারন আব্বা গোপনে ওখানে এসেছেন, ভাবেন নি আমি ওখানে থাকব। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথা, গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন আর জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন। আমিও আব্বাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম। আব্বা জিগ্যেস করলেন তুমি কেমন আছ? ঠিকঠাক আছে? আমি বল্লাম ভাল আছি, তুমি কেমন আছ? আব্বা হেসে দিয়ে বল্লেন, খুব সুখে আছি, একদম ফার্স্টক্লাস!
ঘুম ভাংল কান্না ভেজা চোখে, কিন্তু কেমন যেন এক তৃপ্তিতে মন ছেয়ে গেল।
এমন নিখাঁদ ভালবাসার মানুষ আমি আর কোথায় পাব?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০২২ সকাল ১০:০৬