মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে সব রকমের সাহায্য করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দলীয় নেতাকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। আর আলী আহসান মো: মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে আলবদর বাহিনী গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন দলীয় কর্মীদের। তাদের সেই অপকীর্তির বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গোপন প্রতিবেদনে।
পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এই গোপন প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা ও সাধারন কর্মীদের ভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ১৯৭১ সালে এই প্রদেশের তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ইয়াহিয়া সরকারকে মাসে দুইবার গোপন প্রতিবেদন পাঠাতো। প্রতিবেদনের অফিসিয়াল শিরোনাম ‘ফর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান’।
ওই প্রতিবেদনে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের তৎকালীন সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী, ছাত্র সংঘ নেতা আলী আহসান মো: মুজাহিদ, এ টি এম আজহারুল ইসলাম কিভাবে তখন পাকিস্তানকে রার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করতে তৎপর ছিলেন এসবের বিস্তারিত উল্লেখ আছে। বর্তমানে এই তিনজন যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর, সেক্রেটারি জেনারেল ও সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল।
ওই গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, একাত্তরের ১৪ জুন ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায়। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেনাবাহিনী যেভাবে কাজ করছে তাতে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা সম্ভব। তিনি বলেন, ইসলাম রায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এজন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন তিনি। প্রসঙ্গত. ইসলামী ছাত্রসংঘ ছিল ওই সময়ে পাকিস্তানি জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন।
প্রতিবেদনের মে মাসের প্রথম ভাগ পর্যলোচনায় দেখা যায়, ৫ মে ঢাকা নগর জামায়াতের এক সভায় গোলাম আযম পাকিস্তান রার্থে কি কি করণীয় সে বিষয়ে দলের নেতাদের নির্দেশ দেন এবং সব কলকারখানা চালু রেখে দেশে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ব্যাপারেও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করতে বলেন। ১১ মে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী রহমত আলী ও মেজর জেনারেল (অব ওমরাহ খান ঢাকায় আসেন। গোলাম আযমসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করে তারা জামায়াত কর্মীদের পাকিস্তান সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার আহ্বান জানান। পাকিস্তানের বিভক্তি যেকোনোভাবে রুখতে হবে এই নির্দেশ দেন তারা।
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এই দলিলে দেখা যায় [নম্বর ৪৮২/১৫৮-পল./এস(আই)], ৪ আগস্ট খুলনা জেলা জামায়াতের এক সভায় আমীর গোলাম আযম তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আখ্যা দেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। তিনি বলেন, মুজিব দেশের মানুষকে ভুল পথে পচিালিত করছে। গোলাম আযম তার ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ ধ্বংস করতে জামায়াতের নেতৃত্বে অন্যান্যদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ওই সভাতে আরো বলেন, পাকিস্তানে ইসলামী শাসন কায়েম করতে হবে, দেশ পরিচালনা হবে কুরআন, সুন্নাহর ভিত্তিতে। স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আবদুস সাত্তার। এই সাত্তার বাগেরহাট-৪ আসন থেকে নির্বাচিত জামায়াত দলীয় সাবেক সাংসদ।
২৮ আগস্ট ১৯৭১ এ দেওয়া উপরিউক্ত প্রতিবেদনে স্বার করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব এম এম কাজিম।
প্রতিবেদনে [নম্বর ৫৪৯(১৫৯)-পল.এস (আই)] দেখা যায়, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, ‘হিন্দুরা মুসলমানদের অন্যতম শক্র। তারা সব সময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে’। সম্মেলনে গোলাম আযম প্রতি গ্রামে শান্তি (পিস) কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে তাদের দমনের কার্যক্রম নেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি। তিনি বলেন, খুব শিগরির রাজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ মিলিতভাবে দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবিলায় সম হবে। ১৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্র সচিব এই প্রতিবেদনে স্বার করেন।
অক্টোবরে দ্বিতীয় ভাগের সরকারি এই গোপন প্রতিবেদনে (১৩ নভেম্বর ১৯৭১ স্বরাষ্ট্র সচিব সারিত) বলা হয়েছে, ১৭ অক্টোবর রংপুরে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সভায় আলী আহসান মো: মুজাহিদ আল বদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ইসলামবিরোধী শক্তিদের প্রতিহত করতে হবে। এজন্য যুবকদের সংগঠিত করে আল-বদর বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ওপরে তিনি গুরুত্ব দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ৭ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামী আল-বদর দিবস পালন করে। দলের নেতারা দিবস পালনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আল-বদর বাহিনীতে জনগণকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয় ‘যারা পকিস্তান চায়না তারা আমাদের শক্র। পাকিস্তানের অখন্ডতা রুখতে হবে ও শক্রদের প্রতিহত করতে হবে।’ এদিকে ১৪ নভেম্বর ঢাকা নগর জামায়াতের ২০ সদস্যবিশিষ্ট মজলিসে শূরার বৈঠকে আবারো পাকিস্তান রায় জেহাদের ডাক দেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় ভাগের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ সেপ্টেম্বর সিলেটে এক সভায় ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী আওয়ামী লীগ নেতাদের তীব্র বিষেদাগার করে বলেন, তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী মুসলমানদের িেপয়ে তুলেছে। হাত মিলিয়েছে ভারতের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে রা করতে হবে। ইসলামী ছাত্র সংঘ ও জালালাবাদ ছাত্র সমিতি যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। ইসলামী ছাত্র সংঘ ও জালাবাদাবাদ ছাত্র সমিতি যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। এই প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্রসচিব এম এম কাজিম স্বার করেন ১৫ অক্টোবর ১৯৭১।
২৫ সেপ্টেম্বর লালবাগের ১/১ আব্দুল মতিন চৌধুরী রোডে জামায়াতে উলেমা ইসলাম ও নেজামে ইসলামী দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়। এতে ছিলেন মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, মৌলভী আশরাফ আলী, মৌলভী মো: ইব্রাহিম, মুফতি মো: ইউসুফ, মাওলানা মো: ইসহাক (পূর্ব পাকিস্থান সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী)। বৈঠকে দলটি উপ-নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে ৬ সেপ্টেম্বর ইসলামী ছাত্র সংঘ ঢাকা মাদ্রাসয়ে আলিয়ায় ‘পাকিস্তান প্রতিরা দিবস’ পালন করে। সভায় পাকিস্তানের অখন্ডতা রায় সর্বাÍক কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র সচিব স্বারিত সেপ্টেম্বর প্রথম ভাগের এই প্রতিবেদনে এ বিষয়টির উল্লেখ আছে।
এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনে অধ্যাপক গোলাম আযম, পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রায় সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দেন দলের নেতা-কর্মীদের। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিহত করার নির্দেশও দেন। সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে ডা. এম এ মালেকের নিয়োগকে স্বাগত জানান।
প্রসঙ্গত. ১৭ সেপ্টেম্বর গভর্ণর মালেক ৯ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ করান। এতে জামায়াতের দুইজন ছিল। এরা হলেন আব্বাস আলী খান ও মাওলানা এ কে এম ইউসুফ। আব্বাস আলী খান ছিলেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির, মাওলানা ইউসুফ এখন দলের নায়েবে আমির।