চিনুয়া আচেবে, বিরাশি বছর বয়সে গত ২১ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন। তার স্বদেশ ভূমি নাইজেরিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পহেলা অক্টোবর ১৯৬০ এ, সে সময় তিনি ত্রিশ বছরের টগবগে তরুণ। কিন্তু তা স্বত্বেও সেই বয়সেই যুগান্তকারী উপন্যাস “থিংগস ফল এপার্ট” এর জন্য কৃষ্ণ আফ্রিকার অন্যতম উপন্যাসিক চিনুয়া নামটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এর মাত্র বছর দুই আগে আচেবের সেই প্রথম উপন্যাসটি নামকরা ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা হেনিম্যান কর্তৃক প্রকাশিত হয়। মহাদেশের ভেতর বাইরে -তার অনেক ভক্তের কাছে এটিই ছিল আফ্রিকার প্রথম উপন্যাস। ট্রাজেডির ঢঙে এতে আচেবি শক্তিমান আর অভিজাত্যে ভরপুর নায়কোচিত এক ব্যক্তিত্ব, ওকোনকাও এর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। একই সঙ্গে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে দেশটির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তার সেই উপন্যাসের নায়ক ঔপনিবেশীক শক্তির সব ধরনের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাঁর সেই অনন্য প্রকাশ ভঙ্গির জন্য এযাবৎ উপন্যাসটি কোটিরও বেশী বিক্রি হয়েছে। এবং আজো তাঁর “থিংগস ফল এপার্ট” উপন্যাসটিকে আফ্রিকান সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
তার সময়ের অন্যান্য উপন্যাসিকদের চাইতে সেরা এবং যোগ্যতার বিচারে শ্রেষ্ঠ হবার পরও নোবেল ছাড়াই আচেবিকে ইহলোক ত্যাগ করতে হলো। আচেবে ছিলেন এমন এক শক্তিমান লেখক যাকে কখনই একজন অফ্রিকান লেখকের তকমা ধারণ করে লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে হয়নি। কেননা নিজস্ব কাজের প্রকাশ ভঙ্গীর মধ্যদিয়ে তিনি নিজের আফ্রিকান পরিচয়টিকে এমন ভাবে ম্লান করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যেন তাঁর কাছে তা ছিল সভ্য হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত। তিনি এমন ভাবে বেড়ে উঠে ছিলেন, উপনিবেশিকতার বিচারে নিজের ভাষায় সেই বড় হয়ে ওঠাকে তিনি “ব্রিটিশ প্রোটেকটেড চাইল্ড” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সন্ত্রাস ব্যতীত আফ্রিকার আলাদা করে কোন ইতিহাস নেই-একজন তরুণ লেখক হিসেবে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের এমন মেকী দাবীর আবিষ্কার করেন। সেই সময় সাম্রাজ্যবাদীদের এমন ভুল দাবীকে কোন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া বা এর প্রতি নূন্যতম অজ্ঞতা প্রদর্শন তাঁর সমস্ত মহাদেশটির জনগণের ভাগ্যাকাশে মারাত্মক ঝুঁকি এবং বিপর্যয় বয়ে আনতে পারতো।
নানান উপায়ে তিনি আসল সত্যটা সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন প্রবন্ধ, বক্তৃতা, সাক্ষাতকার; এমনকি বাফারিয়া রাজ্যের একজন ইগবো জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ এবং ব্যর্থ বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অবিরাম প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে, আচেবে বিদ্যমান পরিস্থিতির কথা বার বার সবাইকে জানান দিয়েছেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই সব আরো জোরালো ভাবে তুলে ধরেন তাঁর অনন্য সৃষ্টি “থিংগস ফল এপার্ট” উপন্যাসটির পাতায় পাতায়। এবং উপন্যাসের নায়ক ওকোনকাও কে মহা কাব্যিক ভাগ্য বরণের বাধ্য করে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা ও প্রচণ্ড আবেগী বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এর মধ্যদিয়ে লেখক খুবই সোজাসাপ্টা ও দক্ষতার সঙ্গে সমকালীন উপনিবেশী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে সক্ষম হন। সরকার নিজেও একপর্যায়ে ওকোনকাও এর কাহিনীটির বাস্তবতা অনুধাবন করতে সক্ষম হন। আর সম্ভবত সেই বোধ তৈরিতে কোন সম্পূর্ণ অধ্যায়ের প্রয়োজন হয়নি, কেবল একটি যুক্তিসঙ্গত অনুচ্ছেদই ছিল এর জন্য যথেষ্ট। আর সেই অনুচ্ছেদটি –“দ্যা প্যাসিফিকেশন অব দি প্রিমিটিভ ট্রাইবস অব দ্যা লোয়ার নাইজার” শিরোনামে একটি বই রচনার ইচ্ছে নিয়ে লেখা।
আফ্রিকার প্রথম উপন্যাস রচনা করার প্রচেষ্টাতেই তিনি বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে সক্ষম হন। তারপর থেকে আচেবে একজন কল্পনা প্রবণ লেখক হিসেবে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অবিরাম কলম পিষে গেছেন। একে একে এমন সব উপন্যাস আর গল্পের জন্ম দিয়েছেন যেসবের মাঝে নাইজেরিয়ার উপনিবেশ পূর্ব এবং উপনিবেশ পরবর্তী জীবনের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অনুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছেন। এবং একই সঙ্গে “নো লংগার এট ইজ” ও “অ্যা ম্যান অব দ্যা পিপল” এবং ষাটের দশকে লেখা “গার্লস এট ওয়্যার” ও বায়াফ্রান যুদ্ধ পরবর্তীতে লেখা “এন্টহিলস অব দ্যা সাভানা” জাতীয় উপন্যাসের মাধ্যমে স্বাধীনতা পরবর্তী অগ্নিপরীক্ষার মতো বিষয় গুলোও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেন। কিন্তু এধরনের শক্তিমান লেখনী সৃষ্টির অবসরে টানা একটি দশক তিনি হেনিম্যানের হয়ে আফ্রিকান রাইটার সিরিজটি সম্পাদনা করেন। এবং এরই জন্য তিনি আধুনিক আফ্রিকা সাহিত্যের কেবল জনকই নন গডফাদার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অসাধারণ সম্পাদনা গুনের কারণে আচেবে বিশ শতকের শেষার্ধের অসংখ্য আফ্রিকান লেখকের আবিষ্কার কর্তা। এদের বেশীর ভাগের কাছেই তিনি পথ প্রদর্শকের মতো।
কমদামী যে পেপার ব্যাক বইয়ের অরেঞ্জ-স্পিনড সিরিজের কারণে আজকে কেনেথ কুন্ডা, নাওগি ওয়া থিওং’ও, ডেনিস ব্রুটাস, তৈয়ব সালেহ, লিওপ্লড সিডার সেঙ্ঘর, উসমান সেম্বেন, ওলে সোয়েঙ্কা এবং নাদাইন গরডিমার এর মতো আরো অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা সব শ্রেণীর পাঠকের নাগালে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে: সেটাও তারই প্রেরণার এক অভূতপূর্ব ফসল।
একজন গল্প কথক, জাতীর মুখপাত্র, সংস্কৃতির অধিকর্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধা এবং প্ররোচনাকারী হিসেবে আচেবে নাইজেরিয়াকে সারা বিশ্বের সামনে এমন ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন আধুনিক বিশ্বে এধরনের লেখা আসলেই বিরল। এক সড়ক দুর্ঘটনায় ভয়ানক আঘাত প্রাপ্ত হবার পর থেকে, বিগত দশকের বেশীরভাগ সময়ই তিনি আমেরিকাতে কাটান। অবশ্য এর আগে থেকেই তিনি সেখানকার ব্রাড কলেজ এবং ব্রাওন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুবাদে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তারপরও যখনই তিনি আবারও নাইজেরিয়ায় ফিরে গেছেন, প্রতিবার দেশটির আপামর জনসাধারণ তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সাদরে গ্রহণ করেছে। তাকে সম্মান জানাতে হাজার হাজার জনতা জড়ো হয়েছে। তার জন্য স্বদেশবাসীর বুকে এতো গভীর ভালোবাসার রেখাপাত দেখে সেই যুবক বয়সের মতই তিনি উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন।
জীবনের শেষ দিন গুলো এই বিখ্যাত লেখককে আমেরিকার মাটিতে হুইল চেয়ারে বসে কাটাতে হয়েছে। তারপরও আশপাশের সবার প্রতি তার উষ্ণ করতল ছিল সদা উন্মুক্ত। শত হতাশার মাঝেও বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় সদা হাস্যজ্জ্বল এই লেখকের ভদ্রোচিত উপস্থিতি আশপাশের পরিবেশকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলত। কিন্তু তারপরও তাঁর আচরণে কি যেন এক করুণ বিষাদের রেখাপাত সবার নজর কাড়তো। এসময় নিচু স্বরে দৃঢ় সঙ্কল্প ভাবে নিজস্ব পরিচিত বাচন ভঙ্গীতে তিনি সমৃদ্ধ কথার ফুলঝুরি ফোটাতেন। শ্রোতাদের ভাষায়, তিনি যখন কথা বলতেন তখন যেন আদেশের সুরে ভ্রমাতীত অনন্য কোন সুর তুলতেন। ১৯৯৯ সালে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্মদিন উদযাপন কালে, বোস্টনের এক সাহিত্য সভায় বক্তৃতার সময় উপস্থিত অভ্যাগতদের সামনে তিনি আফ্রিকা নিয়ে লেখালেখির বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেন। হেমিংওয়ের আফ্রিকাকে কেমন করে অকাট্যভাবে বিদায় নিতে হয়েছে সে ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তার মতো করে বলার জন্য আর কোন অফ্রিকান লেখকের উপস্থিতি ছিল না বলেই তিনি স্বদেশে তেমন করে আজো আলোচিত হননি-যেমন করে তিনি আলোচিত হয়েছেন, জোসেফ কনরার্ড এর বিখ্যাত সব প্রবন্ধের মাঝে। অনুষ্ঠানের শেষে উন্মুক্ত প্রশ্নপর্বে, একজন মহিলা প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে বিভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করে বসেন “আপনি কেন আফ্রিকা নিয়ে লিখেছেন ?” এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নওমি গরডিমার এবং কাওমি এন্থনি এপ্পিহা যতটা তটস্থ ছিলেন, বিপরীতে ঠিক ততটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন আচেবে। মাইক্রোফোনের দিকে ঝুঁকে তিনি খুবই নরম থেকে তীব্র স্বরে সুরেলা ভঙ্গীতে বলেন, “আমাদের। বই। পড়বেন।” কিন্তু মহিলা তখন বলেন, “কিন্তু আমি তো আপনার কাছেই জানতে চেয়েছি।” জবাবে আবারও সেই একই বাচন ভঙ্গীতে আচেবে বলে ওঠেন, “আমি তো আপনাকে বললামই: আমাদের। বইগুলো। পড়ে দেখবেন।”
“আমাদের। বই। পড়বেন।”:একজন লেখকের জন্য এর চাইতে শ্রেষ্ঠ সমাধিলিপি আর কী হতে পারে। লেখককে তো তার লেখার মাঝ দিয়েই পাঠকের মনে আজীবন বেঁচে থাকতে হয়। এবং মরণের পরও সেসব লেখার মাঝ দিয়েই তাকে সবার মনে বিরাজ করতে হয়। কেবল এভাবেই একজন লেখক চিরজীবী হতে পারেন। আর ঠিক এভাবেই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়ে আচেবেও চিরকাল বেঁচে থাকবেন তার অনন্য সব সৃষ্টিকর্মের মাঝে।
নাইজেরিয়ার ইগবো লোকেদের মুখে মুখে চিরজীবী হবার এমনই একটি পৌরাণিক কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। একবার সেখানকার লোকেরা তাদের পরম স্রষ্টা চুকু’র কাছে একথা জানতে এক বার্তা বাহক পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়-যে মৃত্যুর পর মৃতদের জীবিত হয়ে ফিরে আসার অনুমতি মিলতে পারে কিনা। বার্তা বাহক হিসেবে, তারা একটি কুকুরকে বেছে নেয়। কুকুরটি স্রষ্টার কাছে পৌঁছাতে দেরি করে। এই ফাঁকে একটি ব্যাঙ যে কিনা তাদের সব কথা আড়ি পেতে নিয়েছে, আগেভাগেই সে স্রষ্টার কাছে পৌঁছে যায়। ব্যাঙটা পরমধামে গিয়ে পরম স্রষ্টা চুকুকে জানায় মরণের পর মনুষ্য সন্তানেরা আর জীবিত অবস্থায় ফেরত যেতে চায় না। এবং পরকালের তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে সে। তখন স্রষ্টা তাকে জানায়, তাদের মনোবাঞ্ছা অচিরেই তিনি পূরণ করবেন। তারপর মানুষদের পাঠানো কুকুরটাও একসময় স্রষ্টার কাছে গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু মানুষের সত্যিকার ইচ্ছের কথা কুকুরের মুখে শুনবার পরও, স্রষ্টা আর তাঁর মত পরিবর্তন করবেন না বলে জানান। তবে তিনি এমন সিদ্ধান্তের কথাও জানান যে, মৃত্যুর পর মানুষ পুনরায় ঠিকই জন্ম নিতে পারবে তবে সেই জন্ম হবে ভিন্ন ধরনের।
নাইজেরিয়ার উপন্যাসিক চিনুয়া আচেবে তাঁর এক লেখায় এই মিথের সম্পর্কে বলেছেন, সমস্ত আফ্রিকা জুড়ে এই মিথ কাহিনীটি কয়েকশত ভাবে বিরাজ করছে। তিনি নিজেও বিভিন্ন ভাবে মিথটিকে তার বিভিন্ন লেখাতে ব্যবহার করেছেন। সেখানে কখনও বার্তা বাহক হিসেবে তিনি উপস্থাপন করেছেন একটি ক্যামেলিওন অথবা অন্য কোন প্রাণীকে; কখনও কখনও বার্তা বাহকের বিদ্বেষের কারণে সেটা ঈশ্বরের কাছে পুরোপুরি বদলে গিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু গল্পের কাঠামো সব সময় অপরিবর্তীত থেকেছে: প্রতিটি গল্পেই মানুষ স্রষ্টার কাছে তার জন্য অমরত্ব চেয়ে পাঠিয়েছে। আর ঈশ্বর তাদের সেই আশা পুরা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মানুষের অসতর্কতা বা তাদের কোন ভুলের কারণে বার বার সেই চাওয়া আর অমরত্ব নামের স্রষ্টার দেয়া উপহার প্রতিবার চির দিনের মত তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আচেবে লিখেছেন, “এটা হয়েছে সেই সব পূর্ব পুরুষদের কারণে যারা ভাষা তৈরি করেছেন এবং আমাদের একথা বলা থেকে নিজেদের পাশব ভাবে রক্ষা করেছেন: এর উদ্দেশ্য ব্যাহত করা থেকে সতর্ক থেকো !” তিনি আরও লিখেছেন, “যখনই ভাষাকে প্রচণ্ড ভাবে ব্যাহত করা হয়, সেটা তখন সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ..... মানব সভ্যতা তখন ভীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়।”
এই মিথের মাঝে আমাদের জন্য আরো একটি উদাহরণ লুকিয়ে আছে-আফ্রিকান উপন্যাসের জনক হিসেবে খ্যাত আচেবের আবির্ভাবের মৌলিক রহস্যও এরই মাঝে নিহিত। নিজের কথা অন্যকে দিয়ে বলাতে কাউকে বেছে নেয়ার মাঝে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে: নিজের কথা কেবল নিজে বলার মধ্য দিয়েই কোন বার্তার ওপর পুরোমাত্রায় বিশ্বাস স্থাপন করা চলতে পারে। তাঁর সেরা গ্রন্থ “থিংগস ফল এপার্ট” এর মধ্যদিয়ে প্রথম বারের মতো আজকের আফ্রিকার গ্রাম্য জীবন প্রবাহ হুবহু আফ্রিকান দৃষ্টিভঙ্গিতে উঠে এসেছে, ঔপনিবেশিক লেখকদের কাছ থেকে নিজ দেশের সাহিত্য ধারাটির পুনরুদ্ধারের মধ্যদিয়ে আচেবে সেই কাজের সূত্রপাত ঘটান। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত তার সেই শ্রেষ্ঠ কর্মটি এযাবৎ পঞ্চাশেরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এপর্যন্ত এটির কোটিরও ওপর কপি বিক্রি হয়েছে।
লেখক জীবনে তাঁর পাঁচ পাঁচটি উপন্যাস, ছোট গল্প এবং কবিতার বেশ কয়েকটি সংগ্রহ, অসংখ্য প্রবন্ধ এবং বক্তৃতায়, আচেবে অবিরাম আফ্রিকানদের তাদের নিজেদের গল্প সমূহ নিজদেরই বলার ক্ষেত্রে যুক্তি তুলে ধরতে চেষ্টা করে গেছেন। এবং একই সঙ্গে তিনি ইউরোপিয়ান লেখকদের দায় দায়িত্বেও আঘাত হেনেছেন। কিন্তু তারপরও তিনি ইউরোপের প্রভাবকে পুরোমাত্রায় অস্বীকার করেননি। স্থানীয় ইগবো ভাষাতে না লিখে, লেখার মাধ্যম হিসেবে তিনি এমন এক ভাষা বেছে নিয়েছেন, যে ভাষা তথা ইংরেজি সম্পর্কে তিনি এক সময় বলেছিলেন, “ইতিহাস আমাদের গলা চেপে ধরেছে।” তার দেশে বেশ কিছু মূলভাষার পাশাপাশি পাঁচশয়ের অধিক ছোট ছোট ভাষা প্রচলিত, সেখানকার রাজনৈতিক এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনেই ইংরেজি আজ লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আচেবের জন্য ভাষাটি এর শৈল্পিক প্রয়োজনেই আরো বেশী অনিবার্য হয়ে পড়ে-যেখানে সভ্যতার সঙ্কট তুলে ধরাই ছিল মূল বিবেচ্য।
নাইজেরিয়ার উত্তরপূর্ব ভাগে ইগবো ল্যান্ড নামে পরিচিত অঞ্চলে ১৯৩০ এ আলবার্ট চিনুয়ালুমগু আচেবে’র জন্ম। কলেজে ওঠার পর তিনি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডকে স্মরণ করিয়ে দেয়, নামের এমন প্রথম অংশ ত্যাগ করেন। চিনুয়ার প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনিকার ইজেনওয়া-ওহেইটো, এপ্রসঙ্গে লিখেছেন তরুণ চিনুয়া যথাসময়ে দেশটির সাংস্কৃতিক “বাকবদল” এর বাস্তবতা বুঝতে পারেন: তার পিতামাতা খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত হলেও, অন্যান্য আত্মীয়েরা তখনও ছিলেন সনাতন ইগবো ধর্মের অনুসারী, এই ধর্মের লোকেরা বর্ম পরিহিত একজন দেবতার পূজা অর্চনা এবং নিজেদের পথ প্রদর্শক আত্মা চাই তে বিশ্বাস করতো। প্রতিবেশীদের সেই বর্বর পৌত্তলিক ধর্ম তাকে মুগ্ধ করে। “সেই দূরত্ব কখনই আমাদের দূরে ঠেলে দেয়নি, বরং আরো কাছে টেনে নিয়েছে, বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দিই দিন গুলোর পানে তাকালে যে কেউ এমন পূর্ণাঙ্গ একটি ক্যানভাসের খোঁজ পাবেন,” পরবর্তীতে নিজের লেখাতেই তিনি এভাবে সে সম্পর্কের আলোকপাত করে গেছেন।
লেখক স্মরণে যায়যায়দিন সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত।