মাত্র ১২ বছর বয়সে ক্ষেতে কাজ করার জন্য স্কুল ছাড়তে হয়েছিল একজন সাহিত্যিককে। এ বছর তিনিই চীনের নাগরিক হিসেবে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো নোবেল জিতলেন। চীনা উপন্যাসিক মো ইয়ান 'কল্প বাস্তবতা' আর চীনের 'লোকজ গল্প'-এর মিশেলে বিশেষ ধরনের উপন্যাস লিখে চীনজুড়েই বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে এই বিশেষ গুণটির জন্য সুইডিশ একাডেমিক কাউন্সিল তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার আগ পর্যন্ত তার এই অনবদ্য সাহিত্যকর্মসমূহ খুব কমই বিশ্ববাসীর নজরে আসতে সক্ষম হয়। এই বিজয় সাহিত্যিক মো ইয়ানকে চীনের ১১১ বছরের ইতিহাসে প্রথম নোবেল বিজয়ী চৈনিক সাহিত্যিকের আসনে বসায়। তবে ২০০০ সালে চীনে জন্মগ্রহণকারী সাহিত্যিক গাও জিনজিয়ান নোবেল জিতলেও, বর্তমানে তিনি ফ্রান্সের নাগরিক। এবং মহাকাব্যের ন্যায় বর্ণনা ধর্মী আত্মচরিতে চীনের অতি সাধারণ চাষীদের দৈনন্দিন জীবনযাপন ফুটিয়ে তোলার বিশেষ দক্ষতার জন্য ১৯৩৮ সালে পার্ল বাক নোবেল জিতলেও নাগরিক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান। বিগত কয়েক মাসজুড়েই চীনের মিডিয়াগুলোতে চৈনিক এই লেখকের নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে শোরগোল শুনতে পাওয়া যায়। এই নিয়ে মতামত প্রদানকারীরাও সমানভাবে চৈনিক সাহিত্যেও বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। বিগত দশকে পর পর সাতবার এই নোবেল গেছে ইউরোপে, এবার এই নোবেল যে ইউরোপের বাইরে কোথাও যাবে এই ব্যাপারে তাই আগেভাগেই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এবং এই তালিকায় প্রথমেই ছিলেন জাপানের উপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি। এই ব্যাপারে ভাষ্যকার অ্যালেক্স ডোনোহিউ বলেন, নির্বাচিত নয় জনের মাঝে মো ইয়ান ছিলেন অনেকটাই রাডারের বাইরে অবস্থিত। অবশেষে পুরস্কার জিতে তিনিই আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন। এই নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্য মোট আশি লাখ ক্রোনার। ১৯৫৫ সালে এক কৃষক পরিবারে জন্ম মো ইয়ানের ডাকনাম গুয়ান ময়ে, তার এই নামের মানে, 'কথা বলোনা'। উল্টর-পূর্ব চীনের শেনডং প্রভিন্সের গাওমিতে তিনি বেড়ে ওঠেন। সেখানকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করে। তার পর থেকে খেতে খামারে কাজে লেগে যান এবং সেনাবাহিনীতে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। কিন্তু সাহিত্যে সাফল্য লাভ করতে টানা আরো ছয়টি বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৮৭ সালে তার সফল উপন্যাস গাওলিয়াং জিয়াজু (লাল জোয়ার) ছাপা হয়। তার এই উপন্যাসটি থেকে ঝাং আইমু'র পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মানে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এতে ১৯৩০ সালে চীনের অভ্যন্তরে জাপানের আগ্রাসনকালীন ভয়ানক ঘটনা প্রবাহ খুব নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। বিজয়ী ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমিক কাউন্সিলের স্থায়ী সচিব পিটার এঙ্গলুন্ড বলেন, 'তিনি গ্রামের অতি সাধারণ মানুষদের নিয়ে লিখেছেন। যারা প্রতি নিয়ত বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করে চলেছেন। নিজেদের সম্মান আর সম্ভ্রম জিইয়ে রাখার জন্য লড়াই করছেন। এই লড়াইয়ে তারা কখনো সখনো জিতলেও বেশির ভাগ সময়ই তাদের হেরে যেতে হয়। শিশুকালে শোনা রূপকথা তার বইগুলোর অন্যতম অনুষঙ্গ। যাদু বাস্তবতার যে বর্ণনার কথা তার সম্পর্কে ব্যবহৃত হচ্ছে, আমি মনে করি সেটার মাধ্যমে তার মর্যাদা অনেক খানি খর্ব করা হচ্ছে, এই জিনিসটা তিনি ঠিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ থেকে ধার করেননি। এটা সবদিক থেকেই একেবারে তার নিজস্ব একটি আঙ্গিক। অতি জাগতিকের সঙ্গে সাধারণের মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে চরম এক সৃজনশীল কাহিনিকার তিনি।' এ সময় লেখকের নব্বই বছরের চৈনিক জীবন কে তিনি আনন্দঘন এবং মহিমান্বিত হিসেবে আখ্যা দেন। চৈনিক অনুবাদক এবং লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রভাষক নিকি হারমেন মো এর এই বিজয়ের সংবাদটিকে বিস্ময়কর অভিহিত করে তাকে একজন মহান লেখক হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এখন থেকে লেখক আরো সুপরিচিত হয়ে উঠবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে একে সব চীনা লেখকের জন্য অনন্য এক সুসংবাদ বলে জানান। কেননা এতে ইংরেজি পাঠকেরা চীনের আরো নিকটে চলে আসবেন বলে তিনি মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, 'আমি নিশ্চিত এতে করে তারা চীন সম্পর্কে জানতে আরো বেশি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তার লেখায় সেই চীনের কথাই স্পষ্ট উঠে এসেছে।' এসওএএস এর চৈনিক অধ্যাপক মাইকেল হোকক্স মো ইয়ানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, তিনি বলেন, জীবিত চৈনিক লেখকদের মধ্যে সবচাইতে বেশি অনূদিত লেখক হলেন মো ইয়ান। চীনাদের কাছে তিনি খুবই সুপরিচিত এবং সম্মানিত একজন লেখক হিসেবে গণ্য, এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংবেদনশীল কোনো কিছু তার লেখাতে ঠাঁই পায়নি এবং হালকা মেজাজের লেখার মাধ্যমে, নিজস্ব আঙ্গিকের কারণে তিনি সেন্সর থেকে রক্ষা পেয়েছেন। হোকক্স বলেন, আমি মনে করি, একজন ভালো লেখক সব সময়ই একজন ভালো লেখক, কেবল সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তাকে ভালো লেখক বলতে হবে এমনটা মোটেও ঠিক নয়। এই বিচারে তিনি চীনজুড়ে চলা বিতর্ক-নোবেল পাওয়ার আশায় তিনি এভাবে লিখেছেন-কে বাতিল করে দেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় তিনি প্রশ্ন ছুড়েদেন, সব শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ লেখকই কি যুদ্ধের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন? তিনি বলেন, 'একজন ভিন্নমতাবলম্বীকে পুরস্কারের জন্য বেছে নেয়া নোবেল কমেটির কাছে খুবই নিরাপদ ও পছন্দনীয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু দৃঢ় সাহিত্য মানসম্পন্ন কোনো লেখককে তার কাজের শক্তিমত্তা এবং ক্ষমতা অনুসারে বাছাই করা খুবই সাহসিকতার সাক্ষর। বছরের গোঁড়ার দিকে চীনের একদল লেখক লন্ডন বই মেলা উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। তখন সেই লেখক দলের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন মো ইয়ান। সেখানে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি বলেন, সেন্সর এড়ানো এক ধরনের সূক্ষ্মতার লক্ষণ। 'সাহিত্যের মাধ্যমে অনেকভাবেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অবতারণা করা যায়, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের বাস্তব জীবনের রয়েছে এমন অনেক সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল বিষয় যা কেউই আপনা থেকে প্রকাশ করতে চান না। এমন পরিস্থিতিতে একজন লেখককে তার নিজস্ব কল্পনা শক্তি ব্যবহার করতে তাকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। অথবা বাস্তবতার ছোঁয়া দিতেই তাকে সেই পরিস্থিতিটিকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরতে হয়। তাই সত্যিকার অর্থেই আমি বিশ্বাস করি এই সীমাবদ্ধতা এবং সেন্সরশিপ সাহিত্যকে নতুন মাত্রা পেতে সহায়তা করে।' হোকক্সের মতে, 'মো ইয়ান জানেন কেমন করে ভালো একটি গল্প লিখতে হয়' গল্পে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বর্ণনা তুলে এনে, 'কোনো ভনিতা ছাড়াই এর সঙ্গে যাদুময় পরিবেশ যোগ করে, কখনো কখনো তার নিজ চোখে দেখা ভয়ঙ্কর বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।' ১৯৬৬-তে তার লেখা উপন্যাস ফেনগ্রু ফেইটুন ২০০৪ সালে বিগ ব্রেস্ট অ্যান্ড ওয়াইড হিপ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ১৯০০ সালের প্রেক্ষাপটে লেখা সেই গল্পের শুরুতেই, ছ'মাস বয়সের জুয়ান নামের এক মেয়েকে পরিত্যক্ত অবস্থায় চৌবাচ্চার মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে দেখতে পাওয়া যায় এবং জাপানের সঙ্গে যুদ্ধকালীন তার পারিবারিক জীবন ও তখনকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব এতে নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। মো ইয়ানের সামপ্রতিক লেখা সর্বশেষ উপন্যাসের নাম ওয়া যার অনুবাদ হয় ব্যাঙ, এতে চীনের চাপিয়ে দেয়া এক সন্তান নীতিমালার কারণে সৃষ্ট ঘটনা প্রবাহ গল্পের আকারে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রাম্য এক ধাত্রী সরকারের সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে কী করছেন সেটাই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। হোকক্স বলেন, 'বিশেষজ্ঞের মত তিনি স্থানীয় ভাষা এবং বাচন ভঙ্গীতে পরীক্ষা মূলক বর্ণনার ঢঙ্গে কাহিনি রচনা করেছেন। এমন কি এ ধরনের একটি উপন্যাসে তিনি নিজেকেই চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাতে রয়েছে তার ছোট বলার ঢঙ, এবং মাও-এর সময়কার গ্রামের লোক মুখে বলে বেড়ানো ভিন্ন কাঠামোর রাজনৈতিক গল্প। তার প্রতিটি উপন্যাসই সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার বাস্তবতার আলোকে লেখা।' চৈনিক সাহিত্যে সুপরিচিত অন্যতম অধ্যাপক গোল্ডবস্নাট, তিনি নিজেই মো ইয়ানের অনেক লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। সম্প্রতি চায়না ডেইলিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মো ইয়ানের লেখাকে ডিকেন্সের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে এই দু'জন লেখকই দৃঢ় নৈতিকতা নিয়ে পাঠককে কল্পনা সমৃদ্ধ দীর্ঘ শক্তিশালী লেখা উপহার দিয়েছেন। গোল্ডবস্নাট বলেন, লেখকের ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস জুইউগুও তথা দি রিপাবলিক অব ওয়াইন আমার পঠিত চৈনিক উপন্যাসগুলোর মাঝে 'কৌশলগতভাবে খুবই দৃষ্টিশীল এবং সংবেদনশীল একটি উপন্যাস', অন্যদিকে তার লেখা শেনঝি পিলাও তথা লাইফ অ্যান্ড ডেথ আর ওয়ারিং মি আউট হলো চৌকশ একটি পৌরাণিক কাহিনি ভিত্তিক উপন্যাস এবং টেনজিআনজিয়াং তথা স্যান্ডেল উড ডেথ লেখকের পরস্পরবিরোধী চিন্তাভাবনার ফসল, সঙ্গীত এই উপন্যাসটির অন্যতম সৌন্দর্য। একই সঙ্গে তার লেখা উপন্যাস সমূহে উঠে এসেছে চীনের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, নারী জীবনের বেদনা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা বোধ, তারুণ্যের উদ্দীপনা, আধুনিক চীনের উন্নয়ন এবং পরিবেশ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের মতন বিষয়। আপন কল্পনার মিশেলে তিনি নতুন ধারার কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করে তুলতে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় ভাষা, কৃষ্টির। যা একজন সত্যিকারের লেখকের জন্য হতে পারে অন্যতম উদাহরণ।
লেখাটি যায়যায়দিনের শুক্রবারের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৩৫