বিকেল থেকে জ্বর ক্রমশ বাড়ছে।দিদি আমাকে জোড় করে দু লোকমা ভাত খাইয়ে দিলো।ব্যস! ওমনি বমি করে সব ফেলে দিলাম।শরীরটা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে।মায়ের সাথে দুপুরে কথা হয়েছে।আর কথা বলার মতো শক্তি নেই।বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর দিদি ফোন ধরতেই মা বুঝতে পেরে ফোন কেটে দেয়।দিদি 'হু হু' করে কান্না জুড়ে দেয়।আমি জ্বরের ঘোরেই বলে উঠি,
কাঁদবি না দিদি।একদম কাঁদবি না।তুই এতো বাজে ভাবে কাঁদিস আমার জ্বর তাতে আরো বাড়ে।জাহিদ ৩ বার আমার কাছে এসে বলে,
বেয়াইনসাব,সামনে রিকশা নিয়ে এসেছি।চলেন ডাক্তার এর কাছে যাই।কথা দিচ্ছি,গায়ে হাত দিবো না।প্রয়োজন হলে রিকশার মাঝখানে কোলবালিশ রেখে দেবো। আমি বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলি,চুপ থাকুন তো।কোন দরকার নেই।আমার লাশ শশানে চলে যাক,তবু আপনার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবো না।
দিদিঃ জিদ করিস না পূজা।আমার বড্ড ভয় করছে।জ্বর তো বেড়েই যাচ্ছে।
আমার নিশ্বাসেই গরম শ্বাস-প্রশ্বাস আমি অনুভব করছি।মনে মনে ভাবছি সৃষ্টিকর্তা এতো ধর্মের মানুষ কেনো সৃষ্টি করলো।দিদির সাথে যখন-তখন দেখা করতে পারিনা,মনটা বড় কাঁদে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। ৭ নং বিপদ সংকেত। চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাজপথ বন্ধ।আমার শরীর খারাপের চেয়ে ও খারাপ লাগছে।উঠে দাঁড়াতে পারছিনা।দিদি বারান্দায় যেয়ে খানিককাল পরে বৃষ্টির তেজ দেখছে আর বলছে,
হে ইশ্বর!রক্ষা করো।আমার বোনটা বোধহয় মরে যাচ্ছে। আমি শুধু একবার ছোট নিশ্বাস নিয়ে বললাম,এই মিশু,দিদিকে বলতো লেবু কেটে আনতে আমার আবার বমি আসছে।দিদি লেবু এনেছিলো কিনা আমার মনে নেই।তবে জাহিদ যে বাইরে বেবিট্যাক্সি নিয়ে এসেছে,তার আওয়াজ আমার কানে এসেছে।বেবিট্যাক্সিতে বসে ছিলাম ঝিম মেরে।দু হাত দিয়ে দিদি আমাকে ধরে রেখেছে।আরো দুবার বমি করে দিয়েছি জাহিদের গায়ে।খেয়াল করলাম বমি করার সময় জাহিদ বুকের উপর মালিশ করছে।বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে জাহিদের দিকে তাকিয়ে আবার একবার বললাম,তুই আবার আমার গায়ে হাত দিয়েছিস? দিদি তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ছিঃ পূজা।জাহিদকে 'তুই-তোকারি'করছিস কেনো? জাহিদ বললো,বাদ দেন ভাবী।জ্বরের ঘোড়ে আছে।আমি কিছু মনে করিনি। বেবিট্যাক্সি রাস্তায় জ্যামে পড়েছে।আমি দিদির কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।এই ঘুম আমার ভাঙলো পরেরদিন সকালে। আমার মাথার কাছে মা পুষ্পা দেবী বসে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই মুচকি হাসি দিলেন।আশে-পাশে আর কেউ নেই।মা মাথায় হাত দিয়ে বললেন,এখন কেমন লাগছে মা আমার? আমি একবার চারদিকে তাকিয়ে বললাম, চোখ খুলে মাকে দেখলে পৃথিবীর কোন সন্তানের আর খারাপ লাগে মা? দিদি কোথায়? মায়ের মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো।বললো, কেনো গিয়েছিলি ওই মুসলমানের বাসায়? দিদি কোথায় বলো মা? আছে হয়তো হাসপাতালের বারান্দায়।তোর বাবাকে শেষ করে সাধ মিটেনি,এখন তোকে শেষ করতে চাইছে।
মায়ের কথা শেষ না হতেই দিদি কেবিনে ঢুকে পড়লো।আমার কাছে প্রায় দৌড়ে এসে বললো, ইশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছে।পূজা তোর জ্ঞান ফিরেছে। মা বিরক্ত হয়ে বললেন, একটু সরে দাড়াতো লাবন্য। তুই পাশে থাকলে আমার গা কেমন ঘিন ঘিন করে। মায়ের কথা শুনে দিদি কেঁদে ফেললো।আমি বললাম,এটা কেমন কথা মা,নিজের মেয়েকে কি বলছো এসব? ও আমার মেয়ে না ছাই।আগের জন্মে কোন পাপ করেছিলাম যার জন্য ওর জন্ম হয়েছে।কোন মুসলমানের বউ আমার মেয়ে না,আমার শুধু এখন একটাই মেয়ে। দিদি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, তোমার এক মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করলে আরেক মেয়েও শরীরে মুসলমানের রক্ত নিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখি! তোমার ধর্মে কেমনে সয় এসব?এখন নিজের মেয়ের শরীর কেটে জাহিদের রক্ত আলাদা করো দেখি। আমি হাঁ করে দিদির দিকে তাকিয়ে আছি। মা দিদি কি বলছে এসব? দিদিঃ তোর শরীরে দু'ব্যাগ ব্লাড দিয়েছে ডাক্তার।যে দুর্বল ছিলি তুই।ঝড়-বৃষ্টির রাতে রক্ত কই পেতাম শুনি?ভাগ্য ভালো জাহিদের সাথে ব্লাডগ্রুপ মিলেছে। কথাগুলো মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেই দিদি কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।মা রাগে ফোসফোস করছে।আমার চোখে জল কেনো জানিনা।
"রান্নাঘর থেকে বটিটা এনে আমার মাথায় একটা কোপ মারোতো মা, আমার মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে।"মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে দেখছি তোর মাথা ব্যথাই কমছে না।সমস্যা কি তোর? সহ্য হচ্ছে না মা, শরীরে কেমন মুসলমান মুসলমান গন্ধ। আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে মা'কে কথাগুলো বললাম।টানা ১৮ দিন ধরে ঘরে বসে রেষ্ট নিচ্ছি।মা আমাকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। তুইও লাবণ্যর মতো আমাকে উপহাস করছিস পূজা?যা তুই ও যা,জাহিদকে বিয়ে করে মুসলমান বাড়ির বউ হয়ে যা। বাবা 'নারায়ণ ঠাকুর' এর রক্ত আমার শরীরে বইছে মা।'চন্দন কাঠ' দিয়ে পোড়ানোর আগ পর্যন্ত এই 'পূজা' ধর্ম ছাড়বেনা।তবে কৃতজ্ঞতাবোধ বলতে একটা জিনিস প্রত্যেক মানুষের থাকা উচিত।আমি দিদির সাথে আবারো দেখা করবো।১৯ দিনের দিন আমি দিদিকে ফোন করলাম।ফোন ধরেই দিদি কাঁদছে। তোকে না নিষেধ করেছি দিদি কথায় কথায় কাঁদবি না।ফোনের ভিতর কান্নার আওয়াজ কি বাজে লাগে শুনতে তুই জানিস না।
মা আমার সাথে কি খারাপ ব্যবহার টাই না করলো পূজা?
মায়ের কথা বাদ দে,সামনের মাসে চলে যাচ্ছি ইন্ডিয়া।ডিশিসন ফাইনাল।তোর সাথে দেখা করবো।
আমার কথা শেষ না হতেই কেউ একজন ফোন নিয়েই বলে উঠলো,
হ্যাল্লোওওওওওওও! বেয়াইসাব।
হে ভগবান! আপনি ফোন কেনো নিলেন?
ভয়ের তো কিছু নেই। ফোনের ভিতর দিয়ে কারো গায়ে হাত দেয়া যায় না।
দিদির কাছে ফোন দিন।
আমার সাথে দেখা করবেন কবে?
আপনার সাথে দেখা কেনো করবো?
আমাকে ধন্যবাদ জানাতে!
ধন্যবাদ, এখন দিদির কাছে ফোন দিন।
উমম-হুম।এভাবে ধন্যবাদ দিলেতো হবে না,বাইরে বের হতে হবে।একসাথে কফি খেতে হবে।
অসম্ভব।
সবই সম্ভব। কবে বের হবেন বলুন?
আমি বাইরে বের হবো না।মায়ের কড়া নির্দেশ আছে।
ভয় পাচ্ছেন? আমার প্রেমে পড়ে যাবেন তাই?
ছিঃ এই জনমে না,পরের ৭ জনমেও না।
তাহলে?এক কাপ কফি খেতে সমস্যা কোথায়?
আমার মা 'পুষ্পা দেবী' কে চিনেন না।যদি জানতে পারে আপনার সাথে দেখা করতে বের হয়েছি....
বেয়াইনসাব,এক কাপ কফিই তো! চাইলেই কিন্তু আপনি বের হতে পারেন সেটা আমি জানি।
আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম,
পড়শু বিকেল ৫ টায় নিউমার্কেটের সামনে থাকবেন।তবে মনে রাখবেন এটাই প্রথম আর এটাই শেষ।
মা'দের সবকিছু বলতে হয় না,তারা কেনো জানি এমনিতেই বুঝে যায়।বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একবারও মা জানতে চাইলো না, "কোথায় যাচ্ছি"।শুধু আমার হাতটি ধরে বললো,
এই দুনিয়ায় তুই ছাড়া এখন আমার কেউ নেই পূজা,এই ১ মাসে তোর যা ইচ্ছে কর,যেথায় ইচ্ছে যা।কিন্তু লাবণ্যর মতো কখনো আমাকে কষ্ট দিস না।
আমি মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বললাম,
কাঁদবে না মা,এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম। এমন কিছু করবো না,যাতে তুমি আমার জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলো।
রেষ্টুরেন্টের হালকা আলোতে বসে ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর জাহিদের আগমন ঘটলো।এসে চেয়ার টেনে আমার কাছে বসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
যান,টেবিলের ওই মাথায় বসুন।
আজব! আমি কি করলাম?
কিছু করেন নি,কিন্তু টেবিলের ওই মাথায় বসুন।
জাহিদ মুখ গোমড়া করে টেবিলের অপর প্রান্তে বসলো।
বেয়াইন সাব।আপনি কি এখনো আমার উপর রেগে আছেন?
না!
তাহলে আমার সাথে এতো রুড আচরন কেনো করেন?
আমি এমোনি।কথা না বাড়িয়ে কফির অর্ডার করুন,ধন্যবাদ দিন।তারপর চলে যান।
পূজা দেবী আপনার কি মনে হয় না,আপনি একটু বেশীই খারাপ আচরন করছেন?
আচ্ছা সরি।মন ভালো না, কিছু মনে করবেন না।
আমার কথা শেষ না হতেই জাহিদ চেয়ার টেনে অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে।
আজব, আপনি আবার কেনো এগিয়ে আসছেন?
এই যে সরি বলেছেন।এখন আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কিছুটা হলেও কাছাকাছি বসে কথা বলা যায়।
আমি লম্বা এক নিশ্বাস নিয়ে বললাম,
জাহিদ সাহেব।আপনার চরিত্রে বেশ সমস্যা আছে।তবে চরিত্রহীন মানুষদের ও কিছু ভালো গুন থাকে।সেটা সেদিনের ঝড়-বৃষ্টির রাতে টের পেয়েছি। জাহিদ হো হো করে হাসছে।
হাসছেন যে?আপনাকে চরিত্রহীন বললাম,কিছু মনে করেন নি?
না করিনি।মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করার খারাপ গুন টা আমার মাঝে আছে।তবে আমি 'চরিত্রহীন' খ্যাতি পাওয়ার মতোও খারাপ নই।আমি কি ভেবেই যেনো হেসে ফেললাম।সেদিনের একসাথে কফি খাওয়ার পর আমি আমার কথা রাখিনি।জাহিদের সাথে আবার এবং আবার দেখা করলাম।কথা বললাম,বাইরে ঘুরে বেড়ালাম।বেশ কয়েকবার দিদি আর মিশুকে নিয়েও বের হলাম।জাহিদ আমাকে ফোন দিতো সকালে-দুপুরে কিংবা রাতে।ভোর রাতে হঠাৎ করেই ফোন দিয়েই বলতো,--"হ্যাল্লো ওওও পূজা দেবী।" কেনো জানিনা জাহিদের মুখে 'বেয়াইনসাব' কিংবা 'পূজা দেবী' নাম শুনতে আমার খারাপ লাগতো না।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর সেদিন সন্ধ্যায় মন্দির থেকে পুজো দিয়ে বের হয়ে দেখলাম জাহিদ বাইরে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।আমি একটু অবাক হলেও আরেকদিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম।জাহিদ আমার পিছু পিছু আসছে,
পূজা দেবী,পূজা দেবী! দাড়ান! দাড়ান!
আমি হাঁটতে হাঁটতেই বললাম,
আপনার সমস্যা কি বলুন তো?মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?
আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
কেনো?সন্ধ্যায় নামাজ পড়েন নি?
হ্যা পড়েছিতো,এই যে দেখুন পকেটে টুপি।
এবার আমি দাঁড়িয়ে রাগন্বিত ভাবে বললাম,
নামাজ পড়ে আবার মন্দিরের সামনে এসে একটা হিন্দু মেয়ের জন্য দাড়িয়ে আছেন।বাহ! পাপ হবেনা আপনার?
জাহিদ বেশ কোমল গলায় বললো,
ভালোবেসে অপেক্ষা করছিলাম পূজা দেবী,পাপ হবে না।
আমি ঠিক এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।আমার মনের ভিতরটা কেমন করে উঠলো।বাইরে বাতাস হচ্ছে। মনে হচ্ছে আবার ঝড় হচ্ছে।মন্দিরের ঘন্টা গুলো ঝড়ের বেগে বেজে উঠছে,আর আমার হৃদয়ে কাঁপন লাগছে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:০৯