মণিপুরীদের বিষু উৎসব
বছরের শেষ দিনটিতে মণিপুরীরা সুর্যোদয়ের আগেই ঘরদোর, ঘরের চারপাশ এবং ঘরের যাবতীয় ব্যবহার্য বস্ত্র আসবাবপত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে ফেলে। তুলসীপাতা ভেজানো পানি ছিটিয়ে ঘর এবং বসতভিটা 'পবিত্র' করার পর রান্নাবান্না শুরু হয়। রান্না মানে অসংখ্য পদের নিরামিষ রান্না। এরপর লৌকিক দেবতা "আপোকপা" এবং কুলদেবতা "লামরদৌ" এর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করাতে হয়। আগে একশ আটটি রান্না ভোগ দেয়ার প্রচলন ছিল, এখন সবক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়না। ভোগ নিবেদনের পর চলে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসাবে ঘর থেকে ঘরে রান্না করা খাবার বিনিময়ের পালা। সন্ধ্যায় তৈরী হয় নানান জাতের পিঠা। মণিপুরী লেইসাঙ বা মন্দিরগুলো আরতি, পালা, কীর্তন ও মৃদঙ্গের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। কোথাও কোথাও বসে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য এবং গানের আসর। রাতভর চলে তরুণ তরুনীদের ঐতিহ্যবাহী নিকন (বিশেষ ধরনের পাশাখেলা), গিল্লা, লাকাটি ইত্যাদি নানান খেলা। বিষুর দিনটিতে যারা গ্রামের বাড়ীর বাইরে থাকেন তাদেরকে বাড়ী ফিরে আসতে হয়, আর যারা গ্রামের বাড়ী থাকেন তাদের বাইরে যাওয়া বারন। বিষুর দিনে কারো কাছ থেকে ধারকর্জ করা নিষেধ, অন্যথায় বছরের বাকী দিনগুলো ধারদেনার ডুবে থাকতে হতে পারে বলে মণিপুরীদের বিশ্বাস।
চাকমাদের বিঝু
চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিন, এই তিনদিন চাকমা সমাজে বিঝু উৎসব পালিত হয়। বিঝু উৎসবের প্রথম দিনটি হলো ফুল বিঝু। এদিন ছোট বড় সবাইকে ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করতে হয়। ছোটরা পাহাড় থেকে ফুল পাতা লতা সংগ্রহ করে নিজের বাড়ীঘর সাজায়। তরুণ তরুণীরা বয়োবৃদ্ধদের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ গ্রহন করে। বৌদ্ধমন্দিরে বুদ্ধমুর্ত্তি স্নান করানো হয় এবং মন্দিরের চারপাশে আলোকবর্ত্তিকা সাজিয়ে পুজা দেয়া হয়। এদিন চাকমারা অন্য কোন কাজ করেনা। বছরের শেষ দিন হলো মুল বিঝু। এদিন ঘরে ঘরে পাজন রান্নার আয়োজন চলে। এছাড়া চালের পিঠা, বিরনধানের খই, তিলের মোয়া ইত্যাদিও তৈরী করা হয়। সবাই বাড়ী বাড়ী ঘুরে বিঝুর খাবার খেয়ে আসে। এজন্যে কোন নিমন্ত্রনের দরকার পড়ে না। বিকেলে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত ও খেলাধুলার আসর থাকে। আর বিঝু উৎসবের শেষ দিনটি অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিনটি হলো গোজ্যাই-পোজ্যা দিন। গোজ্যাই পোজ্যা মানে গড়াগড়ি খাওয়া। এদিন হলো বিঝুর খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া, মানে বিশ্রাম। বছরের প্রথম দিনটি ভাল ভাল খাবার খেয়ে আনন্দে আরাম আয়েসে কাটানো গেলে বছরের বাকী দিনগুলোও ভালভাবে কাটবে বলে চাকমাদের বিশ্বাস। বিঝুর তিন দিনে চাকমারা কোন প্রাণীহত্যা করেনা।
ত্রিপুরাদের বৈসুক
পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠি পুরোনো বছরেকে বিদায় এবং নাতুন বছরকে স্বাগত জানায় বৈসুক উৎসবের মাধ্যমে। ভুড়ি ভোজের আসরের মধ্যে নাচ গানের মাধ্যমে ধর্মীয় দেবতা শিবের অনুগ্রহ মাগে ত্রিপুরারা। বৈসুক উৎসবের তিনটি পর্ব - ১. হারি বৈসুক, ২. বিষুমা বৈষুক ও ৩. বিসিকাতাল। হারি বৈসুক বছরের শেষ দিনের আগের দিন। এদিন গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর গলায় ফুলের মালা পরানো হয়। এদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফুল সংগ্রহ করে পুজা এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা চলে। পরদিন হলো বৈসুক উৎসবরে মুলপর্ব বিষুমা বৈসুক। এদিন 'কচুই পানি' বা পবিত্র পানি দিয়ে ঘরদোর পরিস্কার করা হয়। ঘরে ঘরে মদ, পিঠাপুলি ও নানান পদের রান্নার আয়োজন এবং অতিথি আপ্যায়নের চলে। বছরের প্রথম দিনটিতে বিসিকাতাল। ছোটরা বয়োজ্যেষ্টদের স্নান করিয়ে প্রনাম করে আশীর্বাদ নেয়। বৈসুক উৎসবের ছয়-সাতটি দিন গ্রামে গ্রামে পরিবেশিত হয় ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী 'গরাইয়া নৃত্য'।
মারমাদের সাংগ্রাই
পুরাতন বছরের শেষ তিনদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন এই চারদিন মারমা জনগোষ্ঠি সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। চারদিনের পর্ব্বগুলো হলো যথাক্রমে - সাংগ্রাউ আকিয়ানিহ্ , সাংগ্রাই আক্রাইনিহ্, সাংগ্রাই আতানিহ্ এবং লাছাইংতারা। প্রথম দিনে ছোটবড় সবাই শোভাযাত্রা করে বুদ্ধমুর্তিকে নদীর ঘাটে নিয়ে আসে। তারপর কলাপাতার তৈরী ভেলায় বুদ্ধমুর্তিকে চন্দনসিক্ত পানি ও দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। সাংগ্রাই উৎসবের পরবর্তী দুইটি দিন মারমা সমাজের পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করা হয় পানি খেলা। একে অন্যেকে পানি ছিটিয়ে মারমারা পুরোনো বছরের সব দুঃখ গ্লানিকে ধুয়ে মুছে শেষ করতে চায়। নতুন বছরের প্রথম দিনটি মারমারা হাসি আনন্দে তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই আকা নৃত্যগীত দিয়ে বরন করে। এদিন পানিখেলা হয়না।
অসমীয়াদের বিহু
বিহু হলো অসমীয়া বা অহম জনগোষ্ঠির সর্ববৃহৎ উৎসব। বিহু উৎসবের সাথে অসমীয়াদের কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বছরে তিনটি বিহু পালিত হয় - বোহাগবিহু, কাতিবিহু ও মাঘবিহু। বোহাগবিহুর সময় ধানের বীজ বোনা হয়, কাতিবিহুতে চারগাছ রোয়া হয় আর মাঘবিহুতে ধান কেটে গোলায় তোলা হয়। তিনটির মধ্যে বোহাগবিহু সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপুর্ণ। একে রঙালীবিহুও বলা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে শুরু হয় রঙালিবিহু। এদিন গৃহপালিত গরুকে বাড়তি আদরযত্ন করা হয়। গরুকে হলুদ আর তেল দিয়ে মাখিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে সাজানো হয় এবং খোলা মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়। ছোটরা বড়দের জন্য লাল পাড়ের গামছা উপহার দেয়। পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে অসমীয়া সমাজে চলে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বিহুর গান ও নাচ।
বিষুর উৎপত্তি ও বিকাশ
সংস্কৃত "মহাবিষুব" শব্দ হতে "বিষূ" শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারন করা হয়। আসামের প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ রাজমোহন নাথের ভাষ্য অনুসারে "দ্বিষু" অর্থ্যাৎ যেদিন বিষুবরেখা সূর্যালোক দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত হয় সেই দিনটি বিষু। আর ড. প্রফুল্ল দত্ত গোস্বামীর মতে সংস্কৃত শব্দ বিষুবন থেকে শব্দটির উৎপত্তি। বিষুর আভিধানিক অর্থ সাম্য বা সমতা। বিষুবরেখার সমবিভক্তি ও দিনরাত্রির দৈর্ঘ্যের সমতা বাংলাদেশের প্রান্তিক ও অবহেলিত জনদের জীবনধারায় এসে সামাজিক সংহতি ও সাম্যের রূপ নিয়েছে। বিষু সবার দু:খ-কস্ট আনন্দ-বেদনা হতাশা-বঞ্চনা ভাগাভাগি করার দিন। ভারতবর্ষের পশ্চিমে পাঞ্জাবে "বৈশাখী" উৎসব, দক্ষিনে কেরালায় গিয়ে "ভিজু", এরপর দেড়হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বাঙালীর "চৈত্র সংক্রান্তি", আসামে এসে অসমীয়াদের "বিহু", মণিপুরী বিষ্ণুপ্র্রিয়াদের "বিষু", চাকমাদের নিকট "বিঝু" এবং ত্রিপুরীদের নিকট "বৈসুক" হবার নেপথ্যে কারণ অবশ্যই কাকতালীয় হতে পারেনা। তবে কি সুদুর অতীতে ইতিহাসের কোন এক সময়ে এইসব জাতিগোস্টির পুর্বপুরুষদের মধ্যে কোনরূপ পারস্পরিক নৈকট্য বা যোগাযোগ ছিল?
সবাইকে বিষু উৎসবের শুভেচ্ছা। নতুন বছর সবার জীবনে আনন্দ ও আশার বার্তা বয়ে আনুক।
ছবি ( ক্রম অনুসারে):
১. বিষু বা চৈরৌবা উৎসবে বিভিন্ন পদের রান্না
২. লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ
৩. চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী বিঝু নৃত্য
৪. বৈসুক উৎসবকালীন ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরাইয়া নৃত্য
৫. মারমাদের পানি খেলা
৬. অসমীয়াদের বিহু নাচ
৭. মণিপুরীদের নিকনখেলা নিয়ে আর.কে. চন্দ্রজিৎ সিংহের পেইন্টিং
সহায়তাঃ
১। সুশীলকুমার সিংহ, পেৌরি পত্রিকা, এপ্রিল জুন ২০০৬ সংখ্যা
২্। R.M. Nath, The Background of Assamese culture, 2nd Edn, 1978
৩। G.K. Ghosh, Tribals and their culture in Manipur and Nagaland, 1985
বিষু উৎসব সম্বন্ধে আরো পড়ুন:
* The festival of Bishu
* The Biggest Festival of Bishnupriya Manipuri: Bishu
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৯