somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্কেলিটন শপ

২৩ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রমিজ আলীর কংকালের ব্যবসা। একদিন থেকে একশ বছর আগের মৃত মানুষের কংকাল রয়েছে তার সংগ্রহে। মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে সৌখিন কংকাল সংগ্রহকারীদের চাহিদা মিটিয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। কারওরান বাজারে তার একটা ছোট্ট অফিস আছে। নাম, পদবীসহ মৃতমানুষের ছবি ও কংকাল সাজানো রয়েছে তার অফিসে স্যাম্পল হিসাবে। এটা তার বৈধ ব্যবসার সম্মুখভাগ। সাধারণত বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে যে সমস্ত লাশ সে কিনে নিতে সক্ষম হয় সেগুলোর একটা প্রোফাইল ঝুলিয়ে দেয়। প্রোফাইল যত অভিজাত, রেটও তত বেশী। কাজেই ব্যবসা তেমন হয় না। এজন্য রমিজ আলীর নির্ভর করতে হয় লাশ চুরির উপরে। ঢাকার বিভিন্ন গোরস্থান থেকে তার একটা বাহিনী লাশ চুরি করে। রমিজ আলীর যোগ্য সাগরদে রহমত সেই লাশ থেকে কংকাল বের করে। বিভিন্ন ধরণের কেমিকেলে চুবিয়ে কংকালকে করে তোলে বিক্রয়যোগ্য। তুলে ফেলা মাংশ দিয়ে সে একপ্রকার জ্বালানী তৈল বানানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে তার আরো কাজ করার ইচ্ছে আছে। কারওয়ান বাজার ওয়াসা ভবনের সামনে তার অফিসে সবসময় সেই তেলের একটা বাতি জ্বালানো থাকে। এ সিম্বল অব হিউম্যান ফুয়েল।

সেদিনও রমিজ আলী বসে ছিল তার এক রুমের অফিস ঘরে। রহমত টেলিফোনে কারো সাথে কথা বলছে। হ্যা, অফিসের লোকেশন একদম সোজা। কাওরান বাজার আন্ডার পাসটা দিয়ে উঠলেই দেখবেন "সেল ইউর স্কেলিটন" এর বড় একটা সাইনবোর্ড। মার্কেটে ঢুকে গেলে একদম শেষ রুমটা আমাদের অফিস।

রমিজ আস্তে বলে, তারে বল, না এসে সে ফোনেই অর্ডার দিতে পারে! রহমত টেলিফোনে হাত চেপে রমিজের কথা শুনে বলে, উনি লোক পাঠাবে, আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেৎ!

রমিজের চোখ চিকচিক করে। কয়েকদিন পর্যন্ত বাণিজ্য তেমন জমছে না। লাশগুলোর কংকালেও দুর্ভিক্ষ লেগেছে। মনে হয় হাড্ডিগুলোও চুপসানো। অভিজাত মানুষের কবরগুলো রাতারাতি দুর্গ হয়ে ওঠে। সিমেন্ট আর লোহার খাচায় পাহারা। রমিজের কপালে জোটে আজিমপুরের একই গর্তে শ খানেক লাশ চাপ দেয়া মানুষেরা। গোরস্থানের কর্তৃপক্ষের সাথে রমিজের দহরম মহরম। বাংলা মদ গিলে প্রফিট ভাগাভাগি করে মাসান্তে।

অনেক দিন যাবত লালিত একটা ইচ্ছে রমিজের। কিছু নাদুস নুদুস সুখী, অভিজাত মানুষের কংকাল সংগ্রহ করবে। ঢাকা মেডিকেলের একজন জাদরেল প্রফেসার টোপ দিয়েছে কয়েক মাস আগে। বলেছিল, কিছুদিনের মধ্যেই তার একজন ধনী সুখী মানুষের কংকাল লাগবে। বিনিময়ে দুই লাখ টাকা। সে কথা মনে হতেই রহমতকে বলে, জিগা তো নাম কি ওনার?

রহমত জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনার নামটা একটু বলবেন? রহমত নাম শুনে রমিজকে বলে, ওস্তাদ - প্রফেসর এজাজ উদ্দিন চৌধুরী। রমিজ লাফ দিয়ে উঠে নিমিষেই পৌঁছে যায় রহমতের সামনে। থাবা মেরে ফোন ধরে বলে, স্যার আপনারেই আমি মনে মনে খুঁজতেছিলাম।

এজাজ উদ্দিন চৌধুরীর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে। বলে, রমিজ মিয়া, ঐ যে কইছিলাম আমার একটা কংকাল লাগবে, একটু হৃষ্টপুষ্ট, হাড্ডিগুলা চুপসানো হইলে হবে না, ম্যানেজ করতে পারছেন?

রমিজ আলীর এবার একটা কিছু করতেই হবে। সে বিপুল উদ্যমে বলে, স্যার আপনারে আমি যেভাবেই হোক আগামীকালের মধ্যে কংকাল দেব। তবে টাকাটার অর্ধেক এ্যাডভান্স হিসাবে যদি একটু দিতেন!

এজাজ উদ্দিন রাজী হয়ে যায়। বলে, আপনার অফিসে আমি একটা লোকরে দিয়া এখনই এক লাখ পাঠায়া দিতেছি, কিন্তু কংকাল আমার কালকের মধ্যেই চাই!

রমিজ আলী একশ বার বলে অবশ্যই। স্যার, আপনি বিলকুল চিন্তা কইরেন না, বনানী গোরস্থান থেকে একটা লাশ কিইন্না ফেলমু আইজকা। মনে মনে বলে, নইলে চুরি করমু!

এজাজ উদ্দিন ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিলে রমিজ রহমতকে বলে, তোর জীবনের একটা পরীক্ষা হইয়া যাইবে আজ!

রহমত বড় বড় চোখে তাকায় রমিজের দিকে। লাশ থেকে মাংশ ছুটানোর কাজটা সেই করে থাকে। রমিজের বাসার ছাদে একটা বেশ চমৎকার ফ্যাক্টরী আছে। লাশের মাংশ গলিয়ে আলাদা করার মত একটা চুল্লি, হরকে রকম ক্যামিকেলসের টিউব। সেই সাথে কংকাল ড্রাই ও কালার করার জন্য বাহারী রঙের সরঞ্জাম।

রহমত বলে, ওস্তাদ বলেন আপনি কি করতে হবে, লাগলে রাস্তার উপরে খাড়াইয়া একটা জেতা মাইনষের কংকাল লইয়া আমু!

ঐসব করা লাগবে না। তুই আইজ রাইতে বনানী দিয়া একটা লাশ চুরি কইরা নিয়া আসবি!

রহমতের কাছে এই কাজের চেয়ে একটা মানুষ খুন করা বড় সহজ মনে হয়। বনানীর কবরাস্থানে রাতের বেলায় দিনের চেয়ে বেশী আলো। ভেতরে কমপক্ষে দশজন নাইটগার্ড। তাছাড়া দর্শনার্থীদের আবেগ উথলানো দৃশ্যও বেশী। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটে বলে না। বরঞ্চ সে রমিজের পরীক্ষায় পাস করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। ওকে বস, আইজ রাইতের মধ্যে আপনি কংকাল পেয়ে যাবেন!

রমিজ ভরসা করতে পারে রহমতের উপরে। লাশ কাটায় তার দুঃসাহস দেকে সে নিশ্চিত হয়। অনেক দিন পরে একটা ভাল ব্যবসা হতে যাচ্ছে অবশেষে।

কিছুক্ষণের মধ্যই এক লোক এসে হাজির। এক লাখ টাকার একটা বান্ডিল রমিজে বুঝে নিয়ে একটা মানি রিসিপ্ট ধরিয়ে দেয়। আগন্ত্রক এজাজ উদ্দিন চৌধুরীর একটা কার্ড দিয়ে যায়।

রহমত গভীর রাতে বনানী গোরস্থানে ঢুকে পড়ে। প্রতিটা কবরের উপরে ভারী সিমেন্টের গাঁথুনী। কোথাও বিশাল মিনার, কোথাও টাইলসের বাহারী প্রলেপ, পানির ফোয়ারা, নানা ভাষ্কর্য, কারুকাজ। বেশ ভদ্রোচিত রহমত প্রতি ইঞ্চি জায়গা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। নাহ! তার কাছে অসম্ভব মনে হয় লাশ চুরি। একটা কবরের পাশে একজন বেশ স্বাস্থ্যবান লোক দাড়িয়ে দাড়িয়ে দোয়া-দরুদ পড়ছে। এমন একজন লোকের কংকালই ওস্তাদের দরকার, মনে মনে আওড়রায়। লোকটা যখন প্রার্থণার জন্য হাত তুলে ধরে, রহমতও যোগ দেয়। চোখের আড়ে ভদ্রলোক খুশী হয়ে ওঠে।

প্রার্থনা শেষে দুই হাত মুখে ছুইয়ে রহমত পেছন ফিরতেই ভদ্রলোক তার পিঠে হাত দেয়। ভাই, থ্যাংক ইউ!

রহমত মাথা ঝুলিয়ে বলে, আপনাকে দেখে ভাল লাগলো। কি হয় আপনার?

ভদ্রলোক বলে, আমার ভুলে এ মারা গেছিলো! প্রতি মাসে একবার তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে আসি।

রহমতের কাছে ভদ্রলোককে বেশ সুখী মনে হয়। ওস্তাদের এমন লোকই দরকার। দুজনই গেটের দিকে হাঁটতে থাকলে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় থাকেন, গাড়ী আছে?

না না গাড়ী লাগবে না। আমার বাসা আজিমপুরের কাছে।

আপনি কেন এসেছিলেন?

কংক... বলে রহমত জিভ কাটে। সামলে বলে ঘুরে ঘুরে কবর দেখাই আমার কাজ, মৃত মানুষদের বড় আপন মনে হয়!

ভদ্রলোক এবার রহমতের হাত ঝাপটে ধরে। আপনি বড় ভালো মানুষ। চলেন আপনার বাড়ী পৌঁছে দেই। রহমতকে নিয়ে গাড়ীতে ওঠে। সে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়ণের জন্য এক জটিল গবেষণায় নিয়োজিত। তার আবিষ্কার সফল হলে মানুষ অনেক বেশী কর্মক্ষম হয়ে উঠবে কম খেয়েও।


বুঝলে ভায়া, আমি ভেবে দেখলাম, মানুষের এই যে শক্ত হাড় রয়েছে না, এর ভেতরে আছে অমিত সম্ভাবনা। কোনভাবে যদি এইখানে আমরা কিছু এমন ঢোকাতে পারি যা এই হাড়কে আরো বেশী মজবুত করবে তবে হয়তো খাদ্যের সংকট দূর করা যায়।

রহমতের মাথায় ঢোকে না ভদ্রলোকের জ্ঞানী জ্ঞানী কথা। সে তার থলথলৈ মুখ দেখতে থাকে। চেহারার পেছনের কংকালটা দেখে সে তৃপ্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, একেই তার চাই!

আজিমপুরের বাসায় পৌঁছলে রহমত ভদ্রলোককে একটু কফি খেয়ে যেতে বলে। ভদ্রলোকের কোন এক অজ্ঞাত কারণে রহমতকে ভালো লেগে যায়। রহমত তাকে ছাদের ফ্যাক্টরীতে নিয়ে যায়। ভদ্রলোক অন্ধকারের মধ্যে দাড়িয়ে যখন লাইট জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় তখন রহমতের হাতের ছোরা চমকে ওঠে। ভদ্রলোক দ্বিতীয়বার চিৎকার করার আগেই নিথর হয়ে পড়ে থাকে।

রহমত লাইট জ্বালিয়ে ভদ্রলোকের জামা-কাপড় খুলে দেহটা টেনে ফেলে চুল্লির ভেতরে। কেমিকেলে মিশ্রিত একটা পানির ভিতরে নিমিষেই আলগা হতে থাকে মাংশ।

সাত সকালে রমিজ আলী ফ্যাক্টরীতে ঢুকেই তাজ্জব বনে যায়। হরেক রকম কংকাল দেখেছে জীবনে, কিন্তু এত জীবন্ত কখনও দেখেনি। মনে হচ্ছে কংকালের গায়ে এখনও মানুষটি লেপ্টে আছে। রহমত নাক টেনে ঘুমাচ্ছে ফ্যাক্টরীর এক কোনের একটা তক্তাপোষে।

নিজের পকেট হাতড়ে বের করে প্রফেসর এজাজের নম্বর। মোবাইলে নম্বরগুলো চেপে কল করতেই মনে হলো রহমতের তক্তাপোষ থেকে সে একটা ফোন বেজে উঠতে শুনলো।
৩৬টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×