রুবেল একটা ইস্কুল খুলেছে। চারমাস হলো। মিরপুর বারো নম্বরের মুসলিম বাজারের সন্নিকটে এই স্কুলটির নাম আমাদের পাঠশালা। পহেলা বৈশাখের আগে থেকে ঠান্ডা-গরমের কিম্ভুত হিশেবে আমার চোখ-কান-নাক সব অসহযোগ শুরু করেছিল। খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না।

দু-তিনবার বমি দিয়ে পহেলা বৈশাখ শুরু করে ঘুম ছাড়া আর কোন কিছুই ভাললাগছিলো না। কিন্তু রুবেলের "আমাদের পাঠশালা" র র্যালীতে না গিয়ে পারলাম না। বস্তিবাসী সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য এই স্কুলটির র্যালী দেখার সুযোগ হয়তো বারবার আসবে না। তাই ন'টার সময় হাজির হলাম আমাদের পাঠশালায়।
সবমিলে দেড় হাজার স্কয়ার ফিট হতে পারে। একতলা একটা বাড়ী। গেটের ভেতরে ক্ষুদ্র একটা উঠোন। রুবেলের স্বপ্নের স্কুলে প্রায় শ'খানে ছাত্র-ছাত্রী তখনই হাজির। ছোটছোট মেয়েরা শাড়ী আর ছেলেরা বেশ রঙচঙা জামা কাপড় পড়ে এসেছে। রুবেল আগেই বলেছিল সবাইকে নিজেদের মত করে বাহারী কাপড়ে সজ্জিত হতে।

সেই সাথে যে যেমন পারে কিছু এঁকে, বানিয়ে যেন নিয়ে আসে। কেউ নিয়ে এলো ঘোড়া বানিয়ে, কেউ সেজে এলো কৃষকের সাজে। গাল রাঙিয়ে, নুপুর পায়ে সে এক মহাসমারোহ।

আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম ছেলেপুলেদের ক্রিয়েটিভি দেখে - দরিদ্র ঘরের বাচ্চারা বাঙালীর চিরন্তন উৎসবে মাতোয়ারা।
একজন শিক্ষিকা সব ছাত্র-ছাত্রীর গালে, কপালে আলপনা এঁকে দিল। চার থেকে বারোর মধ্যে মনে হলো সবার বয়স। আলপানা আঁকা শেষ হতেই শুরু হলো র্যালী।

বড় বড় মুখোশ আর ফেস্টুন বানিয়ে এনেছিল রুবেল আগেই। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য সম্বলিত বিভিন্ন মুখায়বের বড় বড় আলপনা নিয়ে র্যালী প্রায় চার কিলোমিটার প্রদক্ষিন করলো। এত ছোট ছোট শিশু, কিন্তু বৈশাখের প্রখর রোদে তাদের উচ্ছাস কমে না।

রাস্তায় উৎসাহী মানুষেরা ভীড় করে দেখতে থাকলো বৈশাখের আমেজ। একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। পথচারীরা ছবি তুলতে শুরু করলো তাদের মোবাইলে, রাস্তার দুইপাশে বাড়ী থেকে বর্ষিত হলো শুভাশীষ।
র্যালীর শেষ গন্তব্য বিএনপি বস্তি। আগে যেটা ছিল আগারগাও, সেটা এখন কালাপানির ধারে।

বাচ্চারা তাদের র্যালী দেখাবে বাবামাকে। বস্তির লোকজন বৈশাখের র্যালী দেখে উচ্ছ্বসিত। নিজেদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে এমন আয়োজন কোনদিন দেখেনি তারা, পুরো মিরপুরের এই অঞ্চলটাতে ধর্মীয় তাজিয়া মিছিল ছাড়া এমন বাঙালীপনার প্রকাশ স্বাধীণতার সাতত্রিশ বছর পরে এই প্রথম দেখা গেলো।
র্যালী শেষে গানের আসর বসলো। অরুপ রাহী গান গাইলো। শিশুদের কলকাকলীতে প্রানবন্ত হয়ে উঠলো আসর।

এত হেঁটেও ক্লান্ত হয়নি শিশুরা। রুবেল ওদের জন্য অবশ্য ক্যালরী সমৃদ্ধ ডায়েটের ব্যবস্থা করেছিল। একদম স্বউদ্যোগে শুভাকাঙ্খীদের অর্থসাহায্যে এমন স্কুল চালানো যেইসেই কথা না। অনেক এনজিও তাদের নিয়মকানুন পালনের শর্তে অর্থ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। কিন্তু রুবেল রাজী হয়নি।

তার কথা হচ্ছে দেশের এই প্রান্তিকদের উন্নয়নের থিউরী এইখানে জন্মাতে হবে। উন্নত বিশ্বের সেট করা ফর্মুলায় শিশুদের মাথাপিছু ডলার হিশেব করা যায়, কিন্তু সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্টের জন্য স্থানীয় অভিজ্ঞতার সংস্থান থাকে না। যেখানে সে এই স্কুল চালাচ্ছে এটাকে প্রয়োজন মনে করে, এটাকে একটা কাজ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। স্কুলের সব কজন শিক্ষক স্বেচ্ছাসেবী - কিন্তু যোগ্যতার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মত ডিগ্রীধারী, মেধাবী ও মানবিক।
আমি রুবেলের পরিকল্পনা শুনে অভিভূত হই। উপস্থিত কয়েকজন বিদেশী পর্যবেক্ষকও অভিভূত হয়।

মনে হলো প্রান্তিকদের জন্য রুবেল যেভাবে ইস্কুলের কারিকুলাম সাজিয়েছে সেটা তাদের মেধার বিকাশের জন্য সহযোগী। দেশীয় সাংস্কৃতিক বোধ বিকাশের সকল উপকরণের সাথে পরিচিত করে, প্রতিটি শিশুর জন্য নিজস্ব মেধা ও পছন্দ অনুযায়ী সৃজনশীল বিষয় নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে রুবেল এই প্রান্তিকদের জন্য একটা স্বাপ্নিক ভূবন তৈরীতে ব্যস্ত।

শিশুদের মুখের এই হাসি ধরে রাখার জন্য রুবেলের একটা পাঠশালা সজ্জন সংঘ আছে। বন্ধু, পরিচিতরাই সেখানে অর্থসাহায্য দিয়ে থাকে - নিঃশর্তভাবে কোন দাতা সংস্থা যদি এগিয়ে আসে, রুবেল হয়তো সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক শিশুদের জন্য
আমাদের পাঠশালাকে একটা আদর্শ মডেল হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ১১:৪৫