তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’- এমন বিখ্যাত অনেক গানের বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ আর নেই। মেহেদী হাসানের গাওয়া ‘পেয়ার ভারে দোসর মিলনে ম্যায়’ গানের সুরকার ও তিনি।
শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টায় রাজধানীর গুলশানে নিজের বাসায় বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তিনি।
রবিন ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে সংগীতাঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন না। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী তার স্ত্রী অভিনেত্রী ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো’, ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’, ‘পিচঢালা এই পথটারে শবনম ও পুত্রসন্তান রনি ঘোষ এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
রেডক্রসে কর্মরত পিতার চাকরির সূত্রে রবিন ঘোষের জন্ম হয় বাগদাদে ১৯৩৯ সালে। তার এক ভাই অশোক ঘোষ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি পরিবারের সাথে ঢাকায় ফিরে আসেন। মিউজিকের প্রতি আগ্রহ একদম অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে দেখা যায়। গ্রাজ্যুয়াশন করার পর সেই সময় তিনি রেডিওতে কাজ শুরু করেন।
১৯৬১ সালে পরিচালক এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে সুরকার ও সংগীত
গানে সুরারোপ এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে তালাস, পয়সা এবং ভাইয়া অন্যতম। ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে রবিন ঘোষ ফেরদৌসী রহমানের সাথে যৌথভাবে সংগীত পরিচালনা করেন। ছবির ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো’ গানটি তালাত মাহমুদের কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে বাংলা ছবি ‘হারানো দিন’, ‘পিচঢালা পথ’, ‘নতুন সুর’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি ছবিতে সুরারোপ করেন। ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ‘পিচঢালা এই পথটারে’, শাহনাজ রহমতউল্লাহর কণ্ঠে ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠে ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানগুলি সেই সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। ‘তুম মেরে হো’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভের পর রবিন ঘোষ করাচিতে চলে যান। সেখানে তিনি চলচ্চিত্রের গানে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত একাধারে সুর করেন। তিনি ‘আয়না’ চলচ্চিত্রের গানগুলোয় সুরারোপ করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সফল চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়। রবিন ঘোষ তালাশ (১৯৬৩), চকোরী (১৯৬৭), চাহাত (১৯৭৪), আয়না (১৯৭৭), আম্বার (১৯৭৮) এবং দরিয়ান (১৯৮৪) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে নিগার পুরস্কার লাভ করেন।
রবিন ঘোষ এক বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকা রেডিও স্টেশনে চাকরির জন্য প্রস্তাব পান। ওই বন্ধুর বোন ঝর্না বসাক তখন বাংলা চলচ্চিত্রে মাঝে-মধ্যে অভিনয় করতেন। এ ঝর্না বসাকই পরবর্তীকালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম হিসেবে পরিচিত পান। দুই পরিবারের সম্মতিতে ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ১৯৬৬ সালে এ দম্পতির রনি নামে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে তাঁরা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
বরেণ্য এ ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে শিল্পী ফেরদৌসী রহমান বলেন, যখন থেকে এদেশে ছায়াছবির জগত শুরু তখন থেকেই আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। রবিন আমাদের বাসায় আসতো, সঙ্গে গীতিকারও আসতেন। তো আমরা একসঙ্গে গানের কাজ করতাম। খুব ভালো সুর আসতো তার মনের ভেতর থেকে। রবিন ঘোষ চমৎকার মেজাজের অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ ছিল। পাকিস্তানে তো ইতিহাস সৃষ্টি করে এসেছেন। সেখানে যথেষ্ট সম্মানও পেয়েছেন। কিন্তু এদেশ তাকে কোনই কাজে লাগাতে পারেনি। তার মতো একজন গুণী, দক্ষ সংগীত পরিচালককে এদেশ যথাযথভাবে সম্মানও জানাতে পারেনি, কাজেও লাগাতে পারেনি। এটা সত্যিই আমার খুব দুঃখ থেকে বলা। ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি’ গানটিই প্রথম ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এ গানের অনবদ্য সুর করেছিলেন রবিন ঘোষ।
অন্যদিকে শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়’ গানটিও আকাশচুম্বী শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এ গানেরও সুর সৃষ্টি করেছেন রবিন ঘোষ। শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেন, রবিন ঘোষ ছিলেন একজন কিংবদন্তি, একজন সুরের জাদুকর। তিনি চলে গেছেন। প্রচণ্ড অভিমান নিয়েই চলে গেলেন। আমরা তাকে সম্মান দিতে পারিনি- এ যে কত কষ্টের, কত লজ্জার তা বলে বুঝাতে পারবো না। দুঃখ হয় এই যে কেউ তার কোন খোঁজখবরও নিত না, কোথাও কোন অনুষ্ঠানে ডাকা হতো না। তাকে সত্যিই আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি।
রবিন ঘোষের সুরে পাকিস্তানের অসংখ্য চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। তাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এ শিল্পী। তিনি বলেন, মাত্র কয়েকদিন আগেও শবনম বউদির সঙ্গে কথা হলো। তখনই শুনেছি দাদা অসুস্থ। ভেবেছিলাম দেখতে যাবো। কারণ তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের, পারিবারিক। কিন্তু শেষ দেখাটা আর হলোই না। এদেশের সংগীত জগত একজন মিউজিক্যাল জিনিয়াসকে হারালো। এ শূন্যতা কোনভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
১৯৯৮ সালে দেশে আসার আগ পর্যন্ত রবিন ঘোষ পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এদেশে আসার পর স্ত্রী নায়িকা শবনমকে নিয়ে নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতেন তিনি। তাদের একমাত্র সন্তান রনি ঘোষ। ১৯৬৩ সালে ‘তালাশ’ চলচ্চিত্রের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি। এরপর ‘চাহাত’ (১৯৭৪), ‘আয়না’ (১৯৭৭), ‘আম্বার’ (১৯৭৮) ও ‘দুরিয়া’র (১৯৮৪) সংগীত পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের নিগার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন রবিন ঘোষ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৫