এইচএসসি-র পরে তখনো ঢাকায় নতুন। ঢাকা যে আসলে ঠিক বাংলাদেশের ভেতরের কোন শহর নয়, সেটা বুঝে গেছি ততদিনে। সব কিছুতেই যেন যোজন যোজন ফারাক আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহর কুমিল্লার সাথে। সেই বোধটা আরেকটু দৃঢ় করতে সে বছর গুলশানে আমাদের এক বন্ধুর বাসায় গেলাম থার্টিফার্স্ট নাইটের মজা নিতে। আমরা প্রায় ১০/১২ জন। বিকেলের দিকেই পৌঁছে গেছি ওর গুলশান-2 নম্বরের বাসায়।
কিন্তু রাত হতেই বন্ধুর মা নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন, বেরুনো যাবে না। কোথা থেকে খবর পেয়েছেন, রাস্তায় পুলিশ আছে, ১২ টায় কেউ বের হলেই ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের অনেক কাকুতি মিনতিও গলাতে পারলো না তাঁকে।
কি আর করা, এক ডজন টগবগে নওজোয়ান আমরা তখন ওর রুমে বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। কবিতা থেকে ক্রিকেট আর মোনালিসা থেকে পামেলা কেউই বাদ নেই।
আড্ডার ফাকে মাঝে কার যেন একবার টয়লেট চেপেছিল। সে বাইরে গিয়ে ফিরে এসে ফিকফিক করে হাসতে লাগলো। কি হলো কি হলো? না, আন্টি খুব আজিব কিসিমের গান শুনছেন পাশের রুমে বসে, খালি নাকি শোনা যাচ্ছে- তোমার বাড়ি যাব, তোমার বাড়ি যাব...।
এধরনের আড্ডার কোন আগামাথা থাকে না। চরম সিরিয়াস ব্যাপারও হয়ে যায় নিছক রসিকতা। আমরা সবাই হুড়মুড় করে দরজা খুলে বের হলাম, এবং শুনতে পেলাম, খালি বলছে বেনীমাধব বেনীমাধব, তোমার বাড়ি যাব।
সংক্রামক রোগীদের মত আমরা সেই গান শুনে হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছি। আর ভাবছি, আন্টির নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, এরম গান কেউ শোনে!
সেই প্রথম লোপামুদ্্রার গান শোনা, একটা ভুল সময়ে, ভুল পরিবেশে।
------------------
তার ঠিক মাস ছয়েক বাদেই সেই একই বাসায় আমি, টিউশনিতে, বন্ধুর ছোট ভাইকে পড়াতে গেছি। হলে থাকি, বাড়ি যাওয়া হয়নি অনেকদিন। শুরুতে প্রতি সপ্তাহে চলে যেতাম কুমিল্লায়। কিন্তু মাস দুয়েক পরেই নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, এত ঘন ঘন যাওয়া যাবে না।
তো, অনেকদিন যাইনি বাড়ি। পড়াচ্ছি। মন ভালো নেই। মনোযোগ নেই তেমন। হঠাৎ পাশের রুম থেকে আবারো ভেসে এলো সেই গান। বেনীমাধব বেনীমাধব তোমার বাড়ি যাব...। মোটামুটি শিউরে ওঠলাম। এরকম অদ্ভুত গলা মানুষের হয়!
পড়ানো শেষে আন্টিকে বলে সিডিটা নিয়ে এলাম সাথে করে। হলে ফিরে শুনলাম গান, একবার দুবার তিনবার, সারারাত ধরে।
সকালে , প্রায় ভোরের দিকে ঘুমাতে যাবার সময় টের পেলাম, আমার মাথার মধ্যে খুব যত্ন করে ঢুকে বসে গেছেন তিনি, লোপামুদ্্রা।
---------------------
অ্যালবামের নামটাই অন্যরকম। অন্য হাওয়ার অন্য গান। অনেকগুলো কবিতাকে সুর দিয়ে গান হিসেবে গাওয়া। অন্যতম হল জয় গোস্বামীর লেখা মালতীবালা উচ্চ বিদ্যালয় ( নামটা সঠিক মনে নেই)- এ সুর করা গান, বেনীমাধব। এরকম গলা আগে কখনো শুনিনি। এরকম স্পষ্ট, এরকম আবেগ, কিন্তু অদ্ভূত রকম বাহুল্য বর্জিত। শুনিনি আগে কখনো।
ঐ অ্যালবামের আরো কিছু প্রিয় গান আছে আমার, ছেলেবলার বৃষ্টি। অথবা আবার আসিব ফিরে।
গান শোনাটা আমার কাছে সাধারন কিছু নয়।অনেকেই আছেন, গান শুনতে শুনতে পড়তে পারেন, বা অন্য যে কোন কাজ, কোন অসুবিধা ছাড়াই করতে পারেন, কিন্তু আমি পারি না। আমি যখন গান শুনি, তখন কেবলি গান শুনি , বিভোর হয়ে শুনি আমি।
লোপামুদ্্রা এসে সেই বিভোরতায় আরো বেশি মগ্ন করে দিয়ে যান আমায়।
রবীনদ্্রনাথের একটা গান আমার ভীষন প্রিয়। সহেনা যাতনা দিবস গনিয়া গনিয়া বিরলে, আশা-র গলায় শুনি প্রথম, তারপর থেকেই বারে বারে শুনতেই থাকি শুধু, সখা হে, এলে না।
কিন্তু ক'দিন পরেই টের পাই, আশা-র উচ্চারনে ভীষন সমস্যা। গনিয়াকে বলেন গুনিয়া, মাঝের একটা জায়গায় একবার যাতনা হয়ে যায় যতনা!
আমাকে এসে রক্ষা করেন কবীর সুমন। আবারো আমি যাতনায় বিভোর হই।
তারপর কিছুদিন পরেই , হাতে আসে লোপামুদ্্রার গাওয়া কিছু রবীনদ্্র সংগীতের একটা অ্যালবাম, রবি কবির গান। আর কি আশ্চর্য সেখানে তিনি যেন আমারই জন্যে গেয়েছেন সহেনা যাতনা..., আর সেই গান শুনে , মুগ্ধ আমি নিজের মনেই বলে উঠি, এতদিন কোথায় ছিলেন?
দিন দিন ভালো লাগা বেড়ে চলে শুধু। লোপামুদ্রায় আমি আরো বেশি তন্ময় হয়ে রই।
এখনো রোজ শুনি, অন্তত একবার। বেনীমাধব , অথবা রবি-র গান, যাই হোক, আমি অবাক হয়ে শুনি, তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী।
কোন উপমা জানা নেই। এ ভালোলাগার প্রকাশ কি করে করবো জানি না আমি।
মেট্রিকের ছুটিতে সিলেট গেছিলাম বেড়াতে, জাফলং। সে নদীতে নেমেছিলাম সেবার। কি অদ্ভূত স্বচ্ছ আর পরিষ্কার সে পানি। আর কি ঠান্ডা! শুধু ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে যেন...।
বলে রাখি, লোপামুদ্রার গান শুনলে আজো আমার কোন এক অলস বিকেলে ছুঁয়ে আসা সেই নদীটার কথাই মনে পড়ে। কেন জানি ...! জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৭ রাত ১১:০৭