ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!
দারিদ্র্য দূর করার জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল থেকে সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে। নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরা হয়েছে এ অভিযোগ। এতে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য দূর করার জন্য ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ইউরোপের দেওয়া কোটি কোটি ডলার নিজের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের তহবিলে সরিয়ে নিয়েছেন ড. ইউনূস।
মুহাম্মদ ইউনূসের পরিচালনাধীন গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ওপর নির্মিত 'ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে' (কট ইন মাইক্রো-ডেব্ট) নামের ওই প্রামাণ্যচিত্রে বিভিন্ন গোপন নথির ভিত্তিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সরানোর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে (এনআরকে) এ প্রামাণ্যচিত্রের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। এটি নির্মাণ করেছেন ডেনমার্কের পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক টম হেইনমান।
প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের জন্য পাওয়া ১০ কোটি ডলার (৭০০ কোটি টাকা) অনুদানের অর্থ ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে নিজের প্রতিষ্ঠিত ও মালিকানাধীন আরেকটি কম্পানিতে স্থানান্তর করেন মুহাম্মদ ইউনূস। দুই বছর পর দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তিনি বিপুল অঙ্কের কর দেওয়া এড়াতে এ অর্থ স্থানান্তর করেছেন বলে ব্যাখ্যা দেন। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এবং ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত অন্য একটি কম্পানিতে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি গোপন রাখার জন্যও সে সময় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাডকে অনুরোধ করেছিলেন। এত দিন তা গোপন রাখা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রে তাও ফাঁস করে দিয়েছেন এর নির্মাতা।
নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ সরানোর অভিযোগ ওঠার পর নোবেল কমিটির সেক্রেটারি গেইর লানডেস্টাড অবশ্য
মন্তব্য করেছেন, ২০০৬ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। এনআরকেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ ক্ষেত্রে কোনো ভুল হয়নি। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে নোবেল কমিটি খুবই সতর্কতার সঙ্গে ইউনূসের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করেছে।' ২০ বছর ধরে কমিটির সঙ্গে জড়িত লানডেস্টাড বলেন, 'এ সময়ের মধ্যে ইউনূসের মতো আর কারো বিষয়ে এত যাচাই-বাছাই করা হয়নি। নরওয়ে ও বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার তাঁর বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।' ৭০ থেকে ৮০ লাখ ঋণগ্রহীতার বিপুল কার্যক্রমের একটি ব্যাংক সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
টম হেইনমান প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের লক্ষ্যে কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ডেনিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম তাঁকে ২০০৭ সালে বিশেষ পুরস্কার দেয়।
ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে দারিদ্র্য : দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখার জন্য ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পেলেও প্রামাণ্যচিত্রটিতে ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। দরিদ্র নারীদের ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেকের উচ্ছ্বাস থাকলেও প্রামাণ্যচিত্রে ঋণের ফলে গ্রহীতাদের দুরবস্থার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রামাণ্যচিত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের চড়া সুদের ফাঁদে পড়ে পল্লী এলাকার দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব করে ফেলার চিত্রও তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের নিষ্ঠুর পদ্ধতির বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে নিগৃহীতদের জবানিতে।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামের অনেক দরিদ্র নারীকে ইউনূস ৩০ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে ঋণের ফাঁদে ফেলেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুর সময়ে যেসব গ্রামীণ নারী ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের বর্তমান অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন নির্মাতা হেইমান। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম ও যশোরের হিলারি পল্লীর নারীদের সঙ্গে ঋণ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ঋণগ্রহীতাদের প্রায় সবাই গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করতে তাঁদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। ঋণ পরিশোধের কঠোর প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। অনেকেই জানান, ঋণ শোধ করতে না পারায় তাঁদের ঘরের টিন খুলে নেওয়া হয়। কেউ কেউ জানিয়েছেন বাড়ি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করার কথা। ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কি অমানবিক আচরণ করেন, প্রামাণ্যচিত্রে সে বর্ণনাও দিয়েছেন ঋণগ্রহীতা হাজেরা।
গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের ফলে গ্রামের নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে এবং পরিশোধের হারও অনেক বেশি_এ তথ্য ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। তবে প্রামাণ্যচিত্রটিতে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক এ ক্ষুদ্রঋণের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ডেভিড রডম্যান, জোনাথন মারডক, টমাস ডিক্টার ও মিলফোর্ড বেটম্যানের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা প্রামাণ্যচিত্রে বলেছেন, 'ক্ষুদ্রঋণ চালু হওয়ার ৩৫ বছরে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা দেখে মনে হতে পারে, এ ঋণ দরিদ্রদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে।স
কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে অর্থ স্থানান্তর! : প্রামাণ্যচিত্রে গোপন নথির ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া ১০ কোটি ডলার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ইউনূসের মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানান্তরের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রামাণ্যচিত্র এবং এনআরকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন গোপন নথি থেকে দেখা যায়, নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি দরিদ্রদের ঋণ সহায়তা দিতে অনুদান হিসেবে ১০ কোটি ডলার গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে মুহাম্মদ ইউনূস এই অর্থ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত 'গ্রামীণকল্যাণ' নামে নিজের অন্য এক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করেন। এরপর গ্রামীণকল্যাণ থেকে ওই অর্থ ঋণ হিসেবে নেয় গ্রামীণ ব্যাংক।
অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি জানতে পেরে নরওয়ের উন্নয়ন সংস্থা নোরাড এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস এর ব্যাখ্যা দেন। অর্থ সরিয়ে নেওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি ১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, 'এর মূল উদ্দেশ্য করের পরিমাণ কমানো এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। এ অর্থ রিভলবিং ফান্ড হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় থেকে গেলে ক্রমেই বাড়তে থাকা কর হারের কারণে ভবিষ্যতে আমাদের বিপুল পরিমাণ কর পরিশোধ করতে হবে।' রিভলবিং ফান্ড থেকে কোনো অর্থ ব্যয়ের পর এর বিনিময়ে পাওয়া অর্থ আবার একই কাজে ব্যবহার করা যায়। এ তহবিলের ক্ষেত্রে অর্থবছর বিবেচ্য হয় না।
কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা : অর্থ সরানোর ঘটনা যেন প্রকাশিত না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক ছিলেন ইউনূস। এ নিয়ে নোরাডের তখনকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ১৯৯৮ সালের ১ এপ্রিল লেখা এক চিঠিতে ইউনূস বলেন, 'আপনার সাহায্য দরকার আমার। ...সরকার এবং সরকারের বাইরের মানুষ বিষয়টি জানতে পারলে আমাদের সত্যিই সমস্যা হবে।'
প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, ঢাকায় নরওয়ের দূতাবাস, নোরাড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এ অর্থ গ্রামীণ ব্যাংকে ফেরত নিতে চেয়েও পারেনি। ১০ কোটি ডলারের মধ্যে সাত কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ইউনূসের গ্রামীণকল্যাণ নামের প্রতিষ্ঠানেই থেকে যায়। পরে নোরাড, ঢাকায় নরওয়ে দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে বলে ওই প্রামাণ্যচিত্রে উল্লেখ করা হয়।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোনাথন মরডাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার পেয়েছিল। ব্যাংকটি ক্ষুদ্রঋণের জন্য এ পর্যন্ত নরওয়ে থেকে ৪০ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য পেয়েছে।
সাক্ষাৎ মেলেনি ইউনূসের : প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা টম হেইনমান অভিযোগ করেন, অর্থ স্থানান্তর ও ঋণের বেড়াজালের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ইউনূসের মতামত জানতে প্রায় ছয় মাস ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও পাননি। মুহাম্মদ ইউনূস তাঁকে কোনো সময় দেননি এবং দেখা করতে রাজি হননি।
গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এ অভিযোগের বিষয়ে ইউনূসের মতামত জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশে আছেন এবং ১০ ডিসেম্বর ফিরবেন।
১৯৭৬ সালে গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন জোবরা গ্রামের ৪২ জন নারীর কাছ থেকে প্রায় এক হাজার ৮০০ টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ড. ইউনূস। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন তিনি। পরে ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংক। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক গরিব মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ দিতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি অর্থ পেয়েছে। বাংলাদেশে এবং সারা বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক বলে পরিচিত ব্যাংকটিতে বর্তমানে ৮৫ লাখ গ্রাহক রয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী।
ড. ইউনূস সাম্প্রতিক সময়ে 'সোশাল বিজনেস' সংক্রান্ত ধারণার কারণে আবারও আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। 'বিল্ডিং সোশাল বিজনেস' বইয়ে তিনি বর্তমান পুঁজিবাদী কাঠামোর সমালোচনা করে নতুন ধারণা 'সামাজিক ব্যবসা' নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতে তিনি প্রস্তাব করেন, ধনী ব্যক্তিরা দানের পেছনে যে অর্থ বরাদ্দ করেন, তার বিকল্প হিসেবে সামাজিক ব্যবসায়ে অর্থ লগি্ন করতে পারেন। এ ধরনের ব্যবসায় একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করবেন স্বার্থ বা মুনাফার উদ্দেশ্য ত্যাগ করে। তবে ওই অর্থ অবশ্যই লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে।
পরে কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসাকে বর্তমান বিশ্ব মন্দা ও পুঁজিবাদের সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, 'বর্তমান পুঁজিবাদী কাঠামো এক পায়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সামাজিক ব্যবসা তাকে দুই পায়ে দাঁড় করাতে শেখাবে।'
করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর
নিজ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে করমুক্ত রাখতে বছরের পর বছর ধরে সচেষ্ট আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দারিদ্র্যমুক্তির প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে করের আওতামুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন ২০০৬ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া এ অর্থনীতিবিদ। একইভাবে নিজের এবং প্রতিষ্ঠানের নোবেল পুরস্কারের ওপরও যাতে কর না ধরা হয়, সে জন্য নানা তৎপরতা চালিয়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘ কয়েক যুগে গ্রামীণ ব্যাংক একটি শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলেও কোনো সরকারই এর করমুক্তির আবেদন অগ্রাহ্য করেনি। চলতি অর্থবছরের ৩১ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ড. ইউনূস সরকারের কাছে পরের দুই বছরের করমুক্তি চেয়ে আবেদন করে রেখেছেন। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কর অব্যাহতি শাখার সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের আয়কে করমুক্ত রাখতে আমাদের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বজায় রাখার জন্য যা করণীয় আমরা তা করব।'
২০০৬ সালে ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর করের প্রসঙ্গটি এলে তা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন তৎপরতা চালান। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামকে পাঠানো একটি চিঠিতে ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের পাওয়া নোবেল পুরস্কারের অর্থকে করমুক্ত রাখার অনুরোধ জানানো হয়। ওই চিঠিতে যদিও উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নোবেল পুরস্কার করমুক্ত নয়_এ তথ্য জানানো হয়েছিল, এর পরও মানবিক বিচেনায় বাংলাদেশে এ পুরস্কারটি করমুক্ত রাখার জোর সুপারিশ করে নোবেল কমিটি। ওই সময় অর্থ উপদেষ্টা তৎকালীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বদিউর রহমানকে বিষয়টি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তিনিও বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
সরাসরি নোবেল কমিটির তদবিরের কিছুদিন পর ড. ইউনূস নিজেও তাঁর এবং প্রতিষ্ঠানের পাওয়া নোবেল পুরস্কারের ওপর করারোপ না করার অনুরোধ জানিয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টাকে আরো একটি চিঠি পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নোবেল পুরস্কারকে করমুক্ত ঘোষণা করেছিল।
এ ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ধারাবাহিক আবেদনের অংশ হিসেবে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রামীণ ব্যাংককে করমুক্ত রাখতে আবারও এনবিআরের প্রতি আবেদন জানানো হয়। ওই বছর ব্যাংকটির নির্ধারিত করমুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে এ আবেদন করা হয় পরের দুই বছরের জন্য। প্রতিষ্ঠানটিকে অলাভজনক দাবি করে দরিদ্র মানুষের সেবা করার সুযোগ চেয়ে করমুক্তি চাওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি তখন গ্রামীণ ব্যাংককে আর করমুক্তির সুযোগ দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ প্রতিষ্ঠান এখন আর শিশুর মতো ছোট নয়, যে তাকে ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে। অবশ্য তিনিও পরবর্তী সময়ে তাঁর এই দৃঢ় অবস্থানে থাকতে পারেননি। ওই বছরও সরকার গ্রামীণ ব্যাংকে পরের দুই বছরের জন্য করমুক্তি সুবিধা দেয়।
চলতি বছরের আসছে ৩১ ডিসেম্বর সেই বর্ধিত করমুক্তির দুই বছর মেয়াদ পূর্তি হচ্ছে। তাই আগেভাগেই আবারও করমুক্তি চেয়ে আবেদন করে রেখেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ অর্থনীতিবিদ। গত ১৪ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিজ হাতে লেখা চিঠিতে দরিদ্রদের সেবা করার স্বার্থে গ্রামীণ ব্যাংকের করমুক্তি চেয়ে যুক্তি তুলে ধরেন ড. ইউনূস। প্রতিষ্ঠানটি যে বিশাল একটি সংস্থা তার বিবরণও অর্থমন্ত্রীর অবগতির জন্য তুলে ধরেন তিনি। আবেদনে তিনি দেখান বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক দুই হাজার ৫৬৪টি শাখার মাধ্যমে দেশের ৮১ হাজার ৩১৭টি গ্রামে প্রায় ৮৩ লাখ সদস্যকে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। এর আওতায় পাঁচ কোটি জনসংখ্যা সুবিধা পাচ্ছে। আর প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় আট হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করছে। আদায়ের হার ৯৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। এসব বিবেচনায় গ্রামীণ ব্যাংককে ১ জানুয়ারি ২০১১ সাল থেকে কর অব্যাহতি দেওয়ার বিনীত অনুরোধ জানানো হয়। তবে অর্থমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করেন প্রায় ১৪ দিন পর গত ২৮ অক্টোবর। এতে তিনি ড. ইউনূসের চিঠির এক কোনায় বিষয়টি পর্যালোচনা করে তাঁকে অবহিত করতে এনবিআরের প্রতি নির্দেশ দেন। ড. ইউনূসের করমুক্তির আবেদনসংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কালের কণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও এ বিষয়ে সরকার ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এখনো।
সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:৪৬