আজ ১২ জুন, বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একজোটে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে এই দিবসটি পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ অনুমোদিত হয়। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে এক কর্মসূচি হাতে নেয় এবং ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম সংস্থা (আইএলও) বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহনের মাধ্যমে প্রতিবছর দিবসটি ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৮০টি দেশ এ দিবসটি পালন করছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সর্বশেষ এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি ছয় জন শিশুর মধ্যে একজন শ্রমিক এবং প্রতি তিন শিশু শ্রমিকের মধ্যে দুইজনই গৃহকর্মের সাথে যুক্ত। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই গৃহকর্মী এ সকল শিশুদের সুরক্ষায় তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। আইএলও’র হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১৮ কোটি। আইএলও’র হিসাবে যে সংখ্যা দেয়া হয়, বাস্তবে তার সংখ্যা আরও বেশি। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ৫ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪২.৩৯ মিলিয়ন। তার মধ্যে ৩.১৮ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক। বাংলাদেশের শিশুরা কলকারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বাসাবাড়িতে কাজ করা ছাড়াও মাদক উত্পাদন, পাচার, পর্নগ্রাফি, যৌনকর্মী ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আজও বন্দী। শিল্পায়নের যুগেও কমছে না ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অসংখ্য শিশুশ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন করি, শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করি’ সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠকে এমন অনেক স্লোগান উচ্চারিত হয় এই দিবসে। কিন্তু সে গুলো শুধু মাত্র সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বিভিন্ন এনজিও শিশুদের কথা বলে বিদেশ থেকে যে ফান্ড কালেকশান করে সে গুলোর কতটুকু শিশুদের জন্য ব্যয় হয় ? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বেশীরভাগ শিশুই এমন অবস্থায় কাজ করছে যা ‘ক্রীতদাসের কাছাকাছি’। এতে বলা হয়েছে, কর্মরত বেশিরভাগ শিশু শ্রমিকের বয়সই ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে এবং এদের ৭১% শতাংশ মেয়ে শিশু। এদের অধিকাংশই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এ সমস্ত শিশু শারিরীক এবং যৌন সহিংসতার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। শিশুশ্রম বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রকাশিত থাকে উল্লেখ করে আইএলও এ ব্যাপারে নতুন আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান আহ্বান করেছে। শিশু শ্রমিকরা বেশির ভাগই ঘরে কাজ করায় তাদের কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। “শিশুরা কাজ করে কিন্তু শ্রমিক হিসেবে তাদের কে গণ্য করা হয় না এবং পারিবারিক পরিবেশে থাকা সত্বেও তাদের প্রতি পরিবারের সদস্যের মতো আচরণ করা হয় না,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস এবারো পালিত হচ্ছে মহা ধূমধামে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ’ দিবস। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য 'নিরাপত্তার পত্তার প্রসার ঘটান; শিশুশ্রম নিরশন করুন'। তবে এতো কিছুর পরেও বহুল আলোচিত শিশু শ্রম এখনো আগের আবস্থায়-ই আছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী একটি শিশুকেও তার জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন প্রকার শ্রমে নিয়োজিত করার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে শিশুরা শ্রমে জড়িত হয়ে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় বয়সের বিভিন্নতার কারণে শিশুদের শ্রম থেকে নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের শহর, নগর বন্দরের বিভিন্ন কল-কারখানা, বাসাবাড়িতে শিশুদের কম মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)এর ২০০৩ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ লাখ। এর মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এই ১৩ লাখ শিশু শ্রমিক সপ্তাহে ৪৩ ঘণ্টা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, এসব শিশুশ্রমিকের প্রায় ৫০ ভাগ শিশু পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এক সমীক্ষায় ৭০৯টি ফ্যাক্টরির মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, মোট নয় হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১.৫ ভাগ অর্থাৎ ৩৮২০ শিশু। এই শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই মানা হচ্ছে না শ্রমআইন। শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আইন করা হলেও তার যথার্থ প্রয়োগ নেই। ফলে আইন অমান্য করে মালিকপক্ষ অত্যন্ত কম বেতনে শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে। শিশু শ্রমের ওপর বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ৪৫ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ। ফলে দেখা যায় মাঠ-শ্রমিকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে শিশু। মাঠ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৭৩.৫০ ভাগ ছেলে এবং ২৬.৫০ ভাগ মেয়ে। শিশু শ্রমিকের ৬.৭০ ভাগ আনুষ্ঠানিক খাতে এবং ৯৩.৭০ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। শুধু মাত্র একবেলা খাবার জোগাড় করতে শিশুরা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। শহরে ও গ্রামের শিশু শ্রমিকরা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক খাত যেমন ট্যানারি, শিল্প-কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, জাহাজ ভাঙা, পরিবহণ সেক্টর এবং অনানুষ্ঠানিক খাত কৃষি, পশু পালন, গৃহকর্ম, নির্মাণ কর্ম, ইট ভাঙ্গা, রিকশা-ভ্যান চালানো, লোহা কাটার কাজসহ প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে।
২০১০ সালের এই দিবসে এক ঘোষণায় বলা হয় ২০১৬ সালের মধ্যে আমাদের দেশ থেকে সকল প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করা হবে। ব্যাপারে অঙ্গীকার করলেও এখনও অনেক শিশুকে গৃহকর্মসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় স্বল্প মজুরিতে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এসব শিশুর নিরাপত্তা বিধানে চুড়ান্ত কোন নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে নি। প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের কারণে পাঁচার, সন্ত্রাস ও নির্যাতনে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। ফলে শিশুশ্রমবিরোধী সরকারের সব প্রচার-প্রচারণা ও ২০১৬ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধের অঙ্গীকার ব্যর্থতায় পরিণত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুশ্রম-বিরোধী আইনগুলো এখনও কাগজে-কলমে আবদ্ধ। তবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে নীতিমালাটির খসড়া সংশোধনের পর্যায়ে রয়েছে। এ উপলক্ষে গত বছর মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন’ নীতি। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। যার মাধ্যমে ৪০ হাজার শিশু শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন তৃতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। এতে আরো ৫০ হাজার শিশুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
অনেক কর্মসূচী ও প্রচারণার পরও বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের দেশে ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। বরং দারিদ্র্যেতার কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে পাঠাচ্ছে তাদের শিশুদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। রাজধানী ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, সূত্রাপুর, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, মগবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। সে সব শিশুশ্রমিকরা ম্যাচ, বিড়ি, প্লাস্টিক, গ্লাস, চামড়াসহ বিভিন্ন কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে রসায়নিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আবার অতি কম পারিশ্রমিকে শিশুশ্রমিকরা দিনে ১৬ ঘন্টার উপরে কঠিন কাজ করার পর সেসব কারখানাতেই শুয়ে পরে। ফলে তাদের স্বাস্থ্য ঝুকি আরো বেড়ে চলেছে। এ অবস্থা থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনের যথাযত বাস্তবায়ন ও দরিদ্র পরিবারগুলোকে পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
শিশুশ্রম বন্ধের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো দারিদ্র্যপূর্ণ পরিস্থিতির পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র(আইএলও) কর্মকর্তা কন্ট্যান্স থমাস বলেন “শিশুশ্রম কে স্পষ্টভাবে সনাক্ত, প্রতিরোধ এবং দূর করার জন্য একটি বলিষ্ঠ আইনী কাঠামো প্রয়োজন। এর মাধ্যমে কিশোরদের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরী করা যাবে। কারণ, তখন তারা আইনসম্মতভাবে কাজ করতে পারবে।” সরকারের গৃহীত নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক সনদের মাধ্যমে গৃহীত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে সক্রিয় হলে আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষর এবং এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ সফল হবে। তাই শুধু মাত্র সভা আর সেমিনার নয় আসুন প্রকৃত শিশু কল্যাণে কাজ করি ।