১.
নীরবে শুধু তাকিয়ে রইলো আমার চোখের পানে, পলক ফেললো না একটিবারও। দৃষ্টির সে ভাষা বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম।
রাতের খাবারের টেবিলে নিত্যিদিন ঝগড়া হতো, তারপরে ঘুমুতে আসার সময় চোখের মণি ঠিকরে বেরুতো ঝগড়ার অবশেষ হয়ে রয়ে যাওয়া রাগের ঝাঁঝটুকু... দৃষ্টিতে আজ সে ঝাঁঝ ছিল না।
তবে কি দুঃখ ছিল? কষ্ট ছিল? নাহ...সে দৃষ্টিতে কোনো দুঃখ ছিল না, স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট ছিল না। ছিল না কোনো বিশেষ রাতের দুষ্টুমি ভরা চোখে ঝরে পড়া কামনার ছায়া। বাবার বাড়ি যাবার আনন্দও ছিল না...আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম একের পর এক নানা স্বাদের অনুভূতি...আর সব হাতড়িয়ে শেষে এসে হতাশ হয়ে পড়লাম।
সে দৃষ্টিতে যে শুধুই শূন্যতা ছিল... ছিল না অপেক্ষা। হয়তো অনাগত দিনের ভাবনা ছিল...তবে সে দৃষ্টিতে ফেলে আসা দিনগুলোর ভালোবাসার স্পর্শ ছিল না।
মায়ের পাশে শোয়া নিয়ে প্রতিদিনের কাড়াকাড়িতে ছোট্ট ছেলেটারই জয় হয়েছিল সেদিন। মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমের ভান ধরে থাকা পিটপিট করতে থাকা চোখে আর সরু গোলাপি ঠোঁটের দিগবিজয়ী হাসির ছটায় সে জয়ের আভা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। হেরে যাওয়া অভিমানী মেয়েটা তখন উলটা পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলো। জোর করেই যেন চোখ বুজে থাকতে চাইলো। হেরে যাবার দুঃখে উপচে পড়া চোখের পানিতে প্রাণপণে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করে গেল। কান্নার দমকে দমকে পিঠ কেঁপে উঠছিল। তার মায়ের দৃষ্টি তখনো যেন শূন্য ছিল। মেয়েটা একবার চোখের কোলে গড়িয়ে পড়া পানি মুছবে বলেই যেন চোখ খুললো। আর ওই এক পলকেই আমি বুঝে গেলাম...... সে দৃষ্টিতে হেরে যাবার কষ্ট ছিল, অভিমান ছিল মায়ের উপর, শুধু সে দৃষ্টিতে অপেক্ষা ছিল না। ততোক্ষণে ঘুমে গলে পড়েছে ছেলে, তার দৃষ্টিপানে না চেয়েই বুঝতে পারছিলাম...হয়তো তার দৃষ্টি মায়ের মতো শূন্য ছিল না। কিন্তু সে দৃষ্টিতে আমার স্থান ছিল না। আমি নিঃশব্দেই বেরিয়ে এলাম শোবার ঘর হতে...ফিরে চললাম।
খুব নিষ্ঠুরভাবেই যেন বুঝতে পেলাম সারা জীবন ধরে ঘোর অবিশ্বাস করে চলা সে অমোঘ সত্য... মৃতদের জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে না।
২.
ঈশ্বরের দরবারে তখন নীরবতা। পৃথিবীর কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মানবসন্তানের কান্নাতে সভাসদদের কেউ কেউ নিদারুণ কৌতুক অনুভব করছিল। স্বর্গে এসে লোভী মানবসন্তানেরা কতো কিছু চায়......ধন-সম্মান-নারী-সুখ, কতো কিছুই না চাইতে পারে পৃথিবীর পরীক্ষায় পাশ করে আসা বুদ্ধিমান মানুষেরা। আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়া এ বোকা মানবসন্তান চেয়েছিল অন্যকিছু, চেয়েছিল পৃথিবীতে তার ভালোবাসার মানুষদের কাছে ফিরে যেতে। সেই প্রথম যেন ঈশ্বরের নিজেকে বিজয়ী মনে হয়েছিল। তিনি যেন তার সভাসদদের দেখিয়ে দিলেন, মানুষের মনের ভালোবাসা তার সবচাইতে সেরা সৃষ্টি।
কিন্তু পৃথিবীতে ফেরার যে নিয়ম নেই! অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সে সুযোগও দেয়া হয়েছিল মানুষটাকে, সভাসদেরা শর্ত দিয়েছিল একটাই, পৃথিবীতে কমপক্ষে একজন মানুষকে খুঁজে পেতে হবে, যে মৃত্যুর এতো দিন পরও ভালোবেসে তার অপেক্ষায় থাকবে। অন্যথায় তাকে নরকে যেতে হবে। ঈশ্বর তখনো মানুষের ভালোবাসার উপর আস্থা রেখেছিলেন। সে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন ভালোবাসার মানুষদের কাছে।
নরকের ভয়ে যে মানুষ পিছু টলেনি, তাকে হেরে ফিরতে দেখে ঈশ্বর বুঝি হতাশই হলেন। মনে মনে ভাবলেন, ভালোবাসা কি তবে বৃথা গেল?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৬