কালো মৃত্যু বা কালো মড়ক মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বীভৎস, অমানবিক ও কালো ইতিহাস বহন করছে। পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়া এই মহামারির কবলে পড়ে ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের (ইউরেশিয়া) ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কালো মৃত্যু এর কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। ২০১০ এবং ২০১১ সালে বিশেষজ্ঞরা এই মহামারি’র শিকার হওয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের অধিবাসীদের ডিএনএন বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এতে ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া’র (প্লেগ রোগ বিশেষ) জন্য রোগ সংক্রামক জীবাণু প্যাথোজেন’কে দায়ী করা হয়।
মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এই রোগের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এরপর এটি সিল্ক রোড হয়ে ১৩৪৩ সালের দিকে এটি ক্রিমিয়া পর্যন্ত পৌছায়।
বণিকদের জাহাজে বসবাস করা ‘কালো ইঁদুর’ ও ‘ইঁদুর মাছি’ নামক দুইটি প্রজাতির মাধ্যমে এটি ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪’শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০-৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। ১৭’শ শতক পর্যন্ত প্লেগ পরবর্তী সময়েও এই সংখ্যা আর পুনরুদ্ধার হয়নি। এমনকি ১৯’ শতকেও এটি ইউরোপের কিছু কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছিল।
এই মহামারী ইউরোপের ইতিহাসে ব্যাপক ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল।
রোগের মূল
ইরসিনিয়া পেস্টিস, পার্বত্য ইঁদুর সহ এমনি ইঁদুর, বাহিত অসংখ্য মাছির মধ্যে যেটি এঞ্জুটিক (সাধারণভাবে থাকে) দ্বারা সৃষ্ট প্লেগ রোগ যেটি মধ্য এশিয়া, কুর্দিস্তান, পশ্চিম এশিয়া, উত্তর ভারত এবং উগান্ডার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয়। এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ইঁদুর ঘাস জমিওয়ালা, বেশি জনবহুল এলাকায় পালিয়ে যেতে শুরু করে এবং রোগ ছড়ায়। কিরগিজস্তানের ইশিকি হ্রদের কুলের কাছাকাছি ১৩৩৮-১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দের নেস্টোরিয়ান কবরগুলিতে মহামারীটির উল্লেখ খোদিত আছে এবং বহু মহামারীবিদরা মহামারী প্রাদুর্ভাবের লক্ষ্যে চিন্তিত ছিলেন, যে এটি সহজেই চীন ও ভারত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অক্টোবর ২০১০ সালে, চিকিৎসা প্রজননশাস্ত্রবিদ্গন বলেছিল যে, এই মহামারীটির তিনটি বড় প্রাদুর্ভাব চীনে সূত্রপাত হয়েছে। চীনে, ১৩ তম শতাব্দীতে মঙ্গলদের বিজয়ে চাষের এবং ট্রেডিংয়ের পতন ঘটে। তবে, ১৪ তম শতাব্দীর শুরুতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দেখা যায়। ১৩৩০-এর দশকে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর ফলে ১৩৩১ সালে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়, যার পরপরই একটি মারাত্মক মহামারী আসে। ১৫ বছর ধরে ১৩৪৭ সালে কনস্ট্যান্টিনোপেল পৌঁছানোর আগে মহামারীটিতে আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন চীনা ও অন্যান্য এশিয়বাসীরা নিহত হয়েছিল।
১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ক্রিমিয়ার কফার বন্দর নগরীতে জেনোইসের ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্লেগ বাহিত হয় বলে জানা যায়। দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের পরে, যার সময় জনি বেগের অধীনে মঙ্গোল বাহিনী রোগে ভুগছিল, সেনাবাহিনী কাফার শহরের দেয়ালের উপরে সংক্রমিত মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল, অধিবাসীদের সংক্রমিত করার জন্য। জেনুইস ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেলেন, জাহাজের মাধ্যমে সিসিলিতে এবং ইউরোপের দক্ষিণে সংক্রমণ নিয়ে, উত্তরে এটি কিরূপে ছড়িয়ে পড়েছিল, আদৌ ছড়িয়েছিল অথবা না এই ধারনাটি সঠিক কিনা বা তবে এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও আবহাওয়ার মতো বিদ্যমান অবস্থাগুলি কালো মৃত্যুর তীব্রতাতে অবদান রাখে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রাদুর্ভাব
এই মহামারী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল, যার ফলে গুরুতর জনশূন্যতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় কাঠামোর মধ্যে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটেছিল। এটি চীন থেকে ক্রিমিয়াতে কফফা নামক একটি ট্রেডিং পোস্টে মঙ্গলদের সাথে ছড়িয়ে পড়ে, যেটি জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে থেকে রোগ, সংক্রমিত ইঁদুর থেকে নতুন ইঁদুর সংক্রমিত হয়, দক্ষিণ রাশিয়া থেকে এই অঞ্চলে রোগটি প্রবেশ করে। ১৩৪৭ সালের শরত্কাল অবধি কনস্ট্যান্টিনোপলের সাথে বন্দরের বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং ব্ল্যাক সি এর মাধ্যমে মহামারীটি মিশরে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌছায়। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, পূর্বদিকে গাজা এবং উত্তর বরাবর পূর্ব উপকূলে আশঙ্কন,একর, জেরুজালেম, সিডন, দামাস্কাস, হোমস এবং আলেপ্পো সহ ছড়িয়ে পড়ে লেবানন, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন শহরে। ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে, এই রোগটি আন্তিয়খে পৌঁছায়। শহরের বাসিন্দারা উত্তর দিকে পালিয়ে যায়, তবে তাদের বেশির ভাগই পালাবার সময় পথে মারা যায়।
১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা সংক্রামিত হয়ে ওঠে। একই বছরেই মওসিল (মোসুল) শহরে একটি বৃহৎ মহামারি আকার ধারণ করে, এবং বাগদাদের শহর দ্বিতীয় বারের জন্য আক্রান্ত হয়।
কালো মৃত্যুর লক্ষণ
প্রথমে এই রোগে আক্রান্ত নারী ও পুরুষ কবজি বা বগলের কোন স্থানে টিউমারের মত কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে এটি আপেল বা ডিমের আকৃতির মত ধারণ করে ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালো রঙ্গের এই ফোঁড়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তার সারা শরীরে এটি দেখতে পায়। এক পর্যায়ে এগুলো পচে যায় ও পুঁজ বের হতে থাকে এবং মাত্র তিন থেকে সাতদিনের মধ্যে মৃত্যু।
উৎস
১। Click This Link
২। The Black Death by Louise Chipley Slavicek, Infobase Publishing.
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:৫১