এক যে ছিলো ময়ুর। খুবই স্মার্ট আর মেধাবি এক ময়ুর। মুয়েট থেকে পাশ করাতো।
বাংলাদেশের যেমন বুয়েট,ময়ুরদের সেরকম মুয়েট আর কি।
ময়ুরের সাথে প্রেম হলো মাবি'র এক ময়ুরীর সাথে। সেও খুব মেধাবি।
বলতে কি আর অপেক্ষা রাখে, মাবি'তে চান্স পেতে কত কষ্ট। আমাদের ঢাবি'র মতো ওদের মাবি । মাচ্যের মক্সফোর্ড।
যাক, ময়ুর আর ময়ুরীর সংসার খুবই ভালো চলছিলো। দুজনের খুব হাসিখুশি সংসার। দুজনেই ভালো চাকুরি করে। অবসরে ময়ুর কবিতা পাঠ করে, ময়ুরি শুনে। আবার ময়ুরি গান করে , ময়ুর শোনে।
কিছুদিন পর, ময়ুরের পাশে প্রতিবেশি হয়ে আসলো এক শালিক পরিবার। তারা থাকে গাছের ওপর। তাদের অহংকারের শেষনাই। তারা যে ময়ুর ময়ুরির চেয়েও বড়।
ময়ুর আর ময়ুরী তাদের কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলো। অনেক বড় হতে হবে, অনেক বড়।
ইতোমধ্যে ময়ুর আর ময়ুরীর পরিবারে এলো ফুটফুটে একে সন্তান। চাঁদের মতো রুপ। ময়ুর আর ময়ুরীর খুশীর আর শেষ নেই। সন্তানের নাম দিলো মউরি। বাহঃ কি সুন্দর নাম। ময়ুরীর মেয়ের নাম মউরি। কিন্ত, শুধু খুশি হলেতো চলবেনা। সংসার বড় হয়েছে। কাজ আরো বেশী করতে হবে। আরো বেশী উপার্জন করতে হবে।
কিন্তু বাচ্চাকে রেখেতো কাজে যাওয়া যায়না । কি করা যায়, কি করা যায়। ময়ুরি খুব চিন্তায় পড়ে। মাবি থেকে পাশ করা ময়ুরি । কিছুই যদি না করা হয়, তবে এতো মেধা কাজে লাগাবে কেমন করে। কেনই বা এতো পড়ালিখা করলো।
হঠাৎ ময়ুরীর মাথায় বুদ্ধি আসলো। আরে মউরিকে তো প্রতিদিন পাশের তিতর পরিবারেই রেখে যাওয়া যায়। তাহলে নিজের চাকুরি ও করা হবে, আবার মউরিও তিতর পরিবারের সাথে থাকবে।
মায়ের আদর ছাড়া মউরি এখন তিতর পরিবারের সাথে বড় হতে লাগলো।
রাতে বাবা-মা যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তখন মউরি কয়েকঘন্টার জন্য বাবা-মাকে পায়। মউরির তখন খুব কষ্ট।কিন্তু মউরি খুব ছোটতো তাইসব কথা আর বাবা-মাকে বুঝাতে পারেনা।
একদিন ময়ুরি কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে। পাশের তিতর পরিবারে গেলো মউরিকে বাসায় আনতে। গিয়ে দেখে মউরি তিতরের কোলে বসে আপন মনে খেলছে। মউরি কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। তারপর মউরিকে নিয়ে বাড়ী ফিরলো।
ময়ুরিদের শহরে আজ সবাই খুব ব্যস্ত। সামনে নববর্ষ। নবরুপে সবাই সাজছে। ময়ুরি অফিস থেকে ফিরার পথে একটু কেনাকাটা করার জন্য পাশে মোড়ের দোকানে গেলো।
গিয়ে দেখে প্রতিবেশী টুনি এসেছে।
ময়ুরি জিগ্গাসা করে, কি গো ভাই টুনি। কেমন আছো । অনেকদিন পর দেখা ।
হুমম, অনেকদিন পরেইতো দেখা হবে। তোমাদের দেখাইতো পাওয়া যায়না। স্বামী -স্ত্রী দুজনেই যে কাজে ভীষন ব্যস্ত থাকো।
কি করবো বলো । যে দুনিয়া পড়েছে। দুজনে কাজ না করলেতো সংসার চলেনা। তারপর মউরি'র জন্যও তো কিছু করে যেতে হবে, তাইনা?
টুনি বলে, হ্যাঁ। তাতো করে যেতে হবে। সেদিন দেখলাম। তিতরের বাসা থেকে মউরির কান্না ভেসে আসছে।আশে পাশে কেউ নাই। বেচারি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
একথা শুনে । ময়ুরির কলিজা যেন কেমন করে ওঠলো। ময়ুরি টুনিকে বললো, আচ্ছা আসি তাহলে পরে কথা হবে।
টুনি বলে, না গো দাঁড়াও না একসাথেই যাবো। টুনা বলেছে-পিঠা খাবে। তাই আমি পিঠা বানানোর জন্য তেল নিতে এসেছিলাম।
টুনি-মোড়ের দোকানিকে তেল দেয়ার জন্য কাঁচের শিশিটি এগিয়ে দেয়।
আর ময়ুরি পাশে দাঁড়িয়ে দেখে।
দোকানি কাঁচের শিশিতে তেল ভরলো।
টুনি, তেলের শিশি নিয়ে দোকানিকে বলে- আরেকটু বেশি করে দাওনা। অনেকগুলো পিঠা তৈরি করতে হবে।
দোকানি তেলের শিশি কানায় কানায় ভর্তি করে দিলো।
টুনি মনে মনে ভাবলো- ভালো করে চাইলে দোকানি হয়তো আরেকটু বাড়িয়ে দিবে। যত ফাও পাওয়া যায়। ততইতো লাভ।
তখন-টুনি দোকানিকে আবার বললো- ও দোকানি ভাই।এরকম কেন করো।
আরেকটু বাড়িয়ে দাওনা ভাই।
দোকানি এবার রাগ করে। তারপর বলে- পুরো শিশিইতো পরিপুর্ণ। আর কোথায় দেবো ।আমিতো কোনো খালি জায়গাই দেখছিনা।
টুনি খেয়াল করে দেখলো- আরে তাইতো। শিশিতে তো আর কোনো জায়গাই নেই। কিন্তু একটু ফাও না নিলে যে মনে শান্তি পায়না।
ময়ুরি , চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। আর টুনির কান্ড দেখে ভিতরে ভিতরে খুব রাগ করছে।
হঠাৎ টুনির মাথায় এক বুদ্ধি আসলো। আরে আরেকটুতো খালি জায়গা আছে। শিশির নীচের দিকে।
তারপর ভীষন খুশী হয়ে দোকানিকে বললো- এই যে দোকানি ভাই। আমার শিশির অন্যদিকেতো একটু খালি জায়গা আছে।ওখানে একটু তেল দাওনা ।
দোকানি বললো- আচ্ছা।বোতলটা ওল্টো করে ধরো। আমি তেল দিয়ে দিচ্ছি।
টুনি আরেকটু ফাও তেল নেয়ার জন্য শিশি উল্টো করে ধরলো। আর সাথে সাথে শিশির সব তেল নীচে পড়ে গেলো।
ময়ুরি ,এবার ভীষন রেগে গিয়ে বললো।কি করলে-বলোতো টুনি।
সামান্য একটু ফাও তেল নিতে গিয়ে আসল টুকুইতো মাটিতে ফেলে দিলে।
তুমি এতো বোকা। সবাই যে তোমাকে খুব বুদ্ধিমতি বলে। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি পিঠা বানানোর বই লিখলে?
টুনি- এবার হেসে ময়ুরিকে বলো-
তুমি বুঝেছো তাহলে। তুমিওতো সেটাই করছো। এইযে- মউরিকে তিতরের বাসায় রেখে দিয়েছো। বেচারি সারাদিন-তোমাদের পানে চেয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। কি লাভ হচ্ছে তাতে? সন্তান না পাচ্ছে , পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন মায়ের ভালোবাসা। আর মা-না পাচ্ছে বুকের মাঝে প্রিয় সন্তানের গভীর মমতা।
সামান্য ফাউ এর লোভে পড়ে জীবনের সবচেয়ে আসল সম্পদতো তুমিও এভাবেই মাটিতে ফেলে দিচ্ছো।
টুনির কথা শুনে ময়ুরির বুকের গহীন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে । এতোদিন এতো পড়ালিখা করে যা শিখেছে তা আজকের শিক্ষার তুলনায় যে কিছুই নয়। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, আদরের সন্তানকে বুকের কাছে নেয়ার জন্য তার বুকটা হু হু করে ওঠে। সে টুনিকে রেখেই দ্রুত বাড়ির পথ ধরে।
এবার টুনি দোকানিকে বলে- ও দোকানি ভাই। খেলা শেষ হয়েছে। এতোক্ষণ শিশিতে পানি ঢেলেছো।দাও এবার শিশিতে তেল দাও। অনেক দেরি হয়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে টুনার জন্য যে পিঠা বানাতে হবে।
( এখন আধুনিক জীবনে দেখা যায়-সন্তান বড় হচ্ছে বেবিসীটারের কাছে। অথবা কাজের লোকের কাছে। পরিবার হয়ে গেছে খুবই ছোট। নেই চাচা, চাচি, মামা, খালা,নানা,নানু, দাদা,দাদি। এরপর নিজের মাও যদি সন্তানকে রেখে চলে যায় কাজে আর রাতে ঘরে ফিরে।তখন ছোট মানুষটির দুঃখের আর শেষ নেই। বেচারা হয়তোবা ভালো করে বলতে পারেনা।কিন্তু হৃদয়ের গভীরে শুধু পুড়তে থাকে।একসময় সেই সন্তান হয়তোবা বড় হয়ে কর্পোরেট বড় একটা চাকুরি করবে, কিন্তু তার মানবিক অনুভূতি সব পাথর হয়ে যাবে। তখন কিন্ত আর আফসোসের শেষ থাকবেনা। তাই, ভালোভাবে চিন্তা করে দেখুন-একটু ফাওয়ের জন্য আসল জিনিস মাটিতে ফেলে দিচ্ছেন নাতো?)
সেই সব দুঃখি সন্তানদের যারা নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে বেবিসীটার অথবা কাজের লোকের কাছে বড় হচ্ছে-তাদের উৎস্বর্গ করা হলো
MFBL
পোস্টটি ভালো লাগলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন। কারো মনে হয়তোবা সামান্য ভাবনা জাগাতে পারে। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:৩৭