বিকেল বেলা মনটা বিষন্ন হলে চাট্টাহোচি নদীর পাড়ে এসে আমি বসি। ছোট্ট একটি পানির প্রসবণ কিন্তু নাম হয়েছে নদী। গুরুজিও এখানে এসে বসেন। আমরা বনোহাঁসের জলখেলি দেখি। গুরুজি কথা বলেন-আর আমি মুগ্ধ হয়ে গুরুজির কথা শুনি।
দেখি পাশের পার্কে কী সুন্দর সুরভিত সুন্দর শিশুরা ছুটোছুটি করছে।যেন
ফুলের বাগানে একঝাঁক বাহারী প্রজাপতি। গুরুজি বললেন-দেখতে চমৎকার না!
আমি বলি হ্যাঁ। চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিন্তু ওদের এ সুন্দর মনের প্রশান্তি আর কিছুদিনের মধ্যেই অশান্তিতে ভরে ওঠবে। এ শিশুসুলভ, নিষ্পাপ সৌন্দর্য্য আর বেশিদিন ওদের জীবনে সইবেনা।
আমি বলি কেন?
কারণ-ওদের মনে বুনে দেয়া হবে-জীবনে টিকে থাকার জন্য দৌড়াও, সবার আগে যেতে হবে, বাকি সবাইকে পিছনে ফেলে। প্রতিযোগিতার এ বীজ যেদিন থেকে ওদের মনের সবুজ ভূমিতে অঙকুরিত হবে সেদিন থেকেই ওদের সব উচ্ছ্বাস শেষ।
হুম।
গুরুজি বলেন ,তোমার কি মনে আছে-
দৌড়ের প্রথম পাঠে শৈশবে হাজির হয়েছিলো কচ্ছপ আর খরগোশ।
খরগোশ ঘুমিয়ে পড়লো আর কচ্ছপ অবিরাম চলতে লাগলো। বিজয়ী কচ্ছপ।
ঈশপ সাহেব বুঝিয়ে দিলেন-ধীর-স্থির ভাবে গন্তব্যে এগিয়ে চলো- জয়লাভ হবেই। শিখানো হলো জিততে হবে। নেতিয়ে পড়লে চলবেনা।
গুরুজি এবার বললেন- আধুনিক এক খরগোশের কথা। যে -কচ্ছপের কাছে পরাজয় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনা। সে কচ্ছপকে বললো- তুমি যদি প্রথম হয়েই থাকো-তবে চলো-আবারো দৌড়াই।কচ্ছপ রাজী হলো।
শুরু হলো আবার দৌড়। এবার খরগোশ আর কোনো ভুল করলোনা। গাছের নীচে বসে তন্দ্রালুতায় গা ভাসালোনা,মরণ পণ দৌড়ালো। কচ্ছপ অনেক পিছনে পড়ে রইলো।
গুরুজি বললেন- এর মানে হলো, গন্তব্যে দ্রুতলয়েই ছুটতে হয়, জীবন পণ ছুটতে হবে,কচ্ছপ গতিতে ছুটে চললে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়না।
এবার কিন্তু নাখোশ হলো-কচ্ছপ অধিপতি।শিশুতোষ বইয়ের পাতায় যে কচ্ছপ এতোদিন জয়লাভের মুকুট পড়ে যুগ যুগ ধরে কচ্ছপকুলকে গৌরবান্বিত করেছে -তারা এ পরাজয় মেনে নিতে পারেনা।
গুরুজি বললেন- কচ্ছপ এবার খরগোশকে বললো- একবার তুমি হেরেছ,আমি জিতেছি, আবার আমি হেরেছি তুমি জিতেছ। সুতরাং ফলাফল অমীমাংসিত ড্র। তাই পুনরায় শুরু হোক দৌড়।
শুরু হলো দৌড়। খরগোশ দৌড়ে অনেক এগিয়ে, কচ্ছপ রয়ে গেলো পিছনে।
কিন্ত এবার খরগোশ দেখে সামনে এক নদী। পার হতে পারেনা। অবাক বিস্ময়ে নদীর পানে চেয়ে থাকে। আর কচ্ছপ মনের আনন্দে সাঁতরে নদী পার হয়ে যায়। গুরুজি বললেন- এর মানে হলো......কিছু না বুঝে শুধু দৌড়ালেই হবেনা। কোন পথে হবে তোমার বিজয়ের নিশানা তা আগে চিনে নিতে হবে।
খরগোশকুল কিন্তু কচ্ছপের এ হঠকারিতা মেনে নিতে পারেনা। এ যেন স্তূল কারচুপি। আর কচ্ছপ বলে- না, প্রকাশ্যে সূর্যোলোকে প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়েছে। এখানে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই।
গুরুজিকে বললাম- তারপর কি হলো?? কে জয়লাভ করলো।
গুরুজি বললেন- ওরা পশু হলেও মানুষের মতোতো আর অভদ্র না। দুপক্ষ সংলাপে বসলো। কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়।
কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড়ে এবার হাজির হলো-বিষধর সাপ। কচ্চপ আর খরগোশের মাঝে বিরোধ লাগিয়ে বিজয়ের মুকুট নিজেই ভাগিয়ে নেবে।
তারপর শুরু হলো-আবার নতুন করে দৌড়। এবার দেখা গেলো । খরগোশ আর কচ্ছপ দু জনেই ক্লান্ত। খরগোশ কচ্ছপকে বললো-ভাই । হয় তুমি জিতো না হয়, আমি । কিন্তু বিষধর সাপের মাথায় বিজয়ের মুকুট পরানো যাবেনা। বিষধর সাপ বিজয়ী হলে সর্পদংশনে বনের প্রাণীকুল ধবংশ হয়ে যাবে।
খরগোশ বলে-তুমিতো দৌড়াতে পারছোনা, ওঠো আমার পিঠে। খরগোশ কচ্ছপকে পিটের ওপর নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। তারপর নদীর পাড়ে আসলো। এবার কচছপ নদীতে নেমে গেলো। আর খরগোশ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো পাড়ে।
কিন্তু কচ্ছপ সমাজেতো আর মীরজাফর নেই। তাই কচ্ছপ ফিরে এলো খরগোশের পাশে। বললো-ভাই তোমাকে এখানে একলা রেখে আমি একা নদী পার হবো, তা হতেই পারেনা।ওঠো আমার পিটে।
দুজনেই একসাথে গন্তব্যে পৌঁছালো। দুজনেই একসাথে জয়লাভ করলো।
গুরুজি বললেন- এর মানে হলো। বিজয় কখনো একা আসেনা। আর অশুভ শক্তিকে হারাতে হলে শত বিরোধ ভুলে গিয়ে নিজেদের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলতে হয়।সম্মিলিত শক্তির একাগ্র প্রয়াসেই সত্যিকারের বিজয় আসে। বিজয়ের মুকুট দুজনকেই দেয়া হলো।
এবার আমি গুরুজিকে বললাম-গল্প কি এখানেই শেষ।
গুরুজি বললেন- গল্পেতো এ গল্প এখানেই শেষ। তবে বাস্তবে এ গল্পের আরো কিছু বাকি আছি।
জয়লাভের আনন্দে খরগোশ আর কচ্ছপ অতি আহলাদিত হয়ে ক্লান্ত হয়ে চারপাশের সবকিছু ভুলে গিয়ে নদীর পাড়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃতিতো তার আপন গতিতে চলবেই। শুরু হলো নদীতে জোয়ার । ভাসিয়ে নিয়ে গেলো ঘুমন্ত কচ্ছপ আর খরগোশের বিজয় মুকুটকে।
গুরুজি বললেন- এর মানে হলো- জয়লাভের পর পারিপার্শি্ক সব কিছু ভুলে যেতে নেই।তাহলে বিশাল খেশারত দিতে হবে। এতো কষ্টার্জিত বিজয়ের মুকুট খুব সহজেই খোয়া যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:৩০