ভর সন্ধ্যা। আমি খাটের ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালি নি। শেরখান আজ বাড়ি গেছে। দুদিন পর আসবে।
ঝর্ণার কাছে অপমানিত হবার পর ভীষণ খারাপ লাগছিল। মেয়েরা সচরাচর এমন নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীনাই হয়ে থাকে। তা না হলে আমার মত অতি সাধারণ শান্ত গোবেচারাকে কেউ এমন করে অপমান করে?
সহসা করিম উদয় হয়ে ঘরে আলো জ্বেলে দিল। তারপর বললো, জলদি চল্, কাজ আছে।
আমি শুয়ে শুয়ে বলি, আমি এখন কোথাও যাব না।
কেন?
এখন আমার 'মন ভালো নেই, মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।'
করিম চটে গিয়ে বললো, তোর আবার যেই না শালার মন, তার আবার ভালো থাকাই কি আর মন্দ থাকাই কি? নে ওঠ্ ---
খাটের এক ধারে বসে বললো, তোকে দেখার জন্য একটা মেয়ে পাগল হয়ে আছে-
জাহিদের কথা আমার মনে পড়লো। বোকামির দণ্ড পেয়েছি। আমার মত মূর্খরা ঠকেই শেখে। অমন কথায় কি আর কান দিই?
আমি বললাম, চাপা মারবার আর জায়গা পাস না বুঝি?
করিম আশ্চর্য হয়ে বললো, চাপা মানে?
আমি বললাম, আমি এমন কোন দর্শনীয় বস্তু নই যে মেয়েরা আমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাবে।
করিম আরো চটে গিয়ে বললো, এত দেমাগ দেখাচ্ছিস কেন?
এতে দেমাগ দেখানোর কী হলো?
দেমাগ নয়তো কী? কোনো ছেলে যদি শোনে যে একটা মেয়ে তাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে, তাহলে সেই ছেলেটা কি উন্মাদের মত ছুটে গিয়ে সেই মেয়েটার সাথে দেখা করবে না? আর তুই কিনা আলতু ফালতু কথা বলে নিজের ডিমান্ড বাড়াচ্ছিস।
কথা বলতে বলতে করিম উঠে দাঁড়ালো, ওর নিজস্ব স্বভাব মত চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, যেই না একজন ফার্স্ট বয় হয়েছ, তা নিয়ে আবার এত দেমাগ! তুই থাক তোর দেমাগ নিয়ে, দেশে বুঝি আর কোন ফার্স্ট বয় নেই? তোর ফার্স্ট বয়ের গুষ্টি মারি (শেরখান গুষ্টি কিলিয়ে থাকে)।
এরূপ ঝামটা মেরে করিম বেরিয়ে গেল। আমি বিছনায় অসাড় হয়ে পড়ে রইলাম।
অংক পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে একটা ঘটনা ঘটলো। প্রতিদিনকার মত আমি ঘুরতে বেরিয়েছি; উপজেলা সদরের ভিতরে। পুকুর পার দিয়ে হাঁটছিলাম। এখানে ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে, কিংবা পুকুরপাড়ে ঘাসের ওপর বসে দলে দলে আড্ডা দিচ্ছিল।
আমি দলছাড়া, একা। আনমনে হাঁটছি।
দাঁড়া- ।
করিমের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি ডানে তাকাই। দেখি অদূরে দাঁড়ানো চার-পাঁচটা মেয়ের একটা দল থেকে করিম আমার দিকে ছুটে আসছে। আর মেয়েগুলো হাসি হাসি মুখ করে কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি দাঁড়ালাম।
করিম এসে হাত ধরে বললো, আয়, পরিচয় করিয়ে দিই।
আমি বুঝতে পেরেছি এই পাগলটা এখন আমাকে ঐ মেয়েগুলোর সামনে নিয়ে দাঁড় করাবে। আমি কি শালার চিড়িয়াখানার বস্তু নাকি?
বললাম, আমার কোন পরিচয়ের দরকার নেই।
মেয়েগুলোর মধ্য থেকে হঠাৎ একটা মেয়ে বলে উঠলো, করিম, ওটা কি তোর সেই বন্ধু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই। তোরা আয়।
মেয়েগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগতে লাগলো। বরপক্ষ কনে দেখতে গেলে কনেদের যেমন লজ্জা হয়, আমারও তেমনি হচ্ছিল। করিমটা আবার আমার ব্যাপারে ওদের কাছে কি না কি বলেছে তারও তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
আমি ঠাট্টা করে করিমকে বললাম, আমাকে দেখতে চাইলে কিন্তু আমাকে টাকা দিতে হবে।
মেয়েগুলো ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছে এবং আমার কথা শুনে ওরা খুব মজা পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
চার পাঁচটা জলজ্যান্ত মেয়ে আমাদের পাশে এসে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে, ভিতরে ভিতরে জেগে উঠেছি এবং দারুণ রোমাঞ্চিত এবং পুলকিত বোধ করছি। কিন্তু আমি এখনো কোন মেয়ের চেহারার দিকেই তাকাই নি।
একটি মেয়ে বললো, করিম, তোর বন্ধুটা বেশ হিউমেরাস তো।
আমি আচানক চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকালাম, মেয়েটি যেন লজ্জাবতীর মত গলে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখতে থাকলাম।
করিম পাগলার কথায় ঘোর কাটলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ওকে তুই চিনিস?
আমি বললাম, তুই না বললি পরিচয় করিয়ে দিবি?
করিম বললো, ওকে চিনে না এমন কোন ছাত্র-ছাত্রীই নেই।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, স্যরি, আপনাকে এতদিন চিনি নি, এটা আমার বড় অন্যায়।
মেয়েটি হেসে উঠলো।
করিম বললো, জয়পাড়া সেন্টার থেকে গত বিশ বছরে ওর চেয়ে কোন সুন্দরী মেয়ে পরীক্ষা দেয় নি।
বাকি মেয়েগুলো আবারো বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেও ঐ মেয়েটি লজ্জায় উড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো। তারপর করিমকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, স্টুপিড। খুব বেশি বকছিস।
করিম ক্ষেপে গিয়ে বললো, এক বিন্দুও বেশি বলি নি। এই যে পুকুরের চারপাশে যত পুরুষ মানুষ দেখছিস, সবাই শুধু তোকে একনজর দেখার জন্য এখানে ঘুরঘুর করছে। কে না জানে যে কবি নজরুলের ফার্স্ট গার্ল জুঁই একটা বিশ্ব সুন্দরী?
মেয়েটির নাম তাহলে জুঁই? কবি নজরুল গার্ল্স হাইস্কুলের ফার্স্ট গার্লও বটে?
আমি জুঁইয়ের দিকে তাকালাম। এমন শুভ্র সুন্দর মুখশ্রী সত্যি জীবনে আর কোনদিন দেখি নি - ওকে লক্ষ্য করে দেখেই আমার তাই মনে হলো। একে তো অপূর্ব সুন্দরী, তার ওপর মেধাবিনী, আট-দশ গ্রামের মানুষ জুঁইকে চিনবে না তো আমাকে চিনবে? ওর সাথে যদি আমি নিজেকে তুলনা করি তাহলে জুঁই আমার থেকে দু-ধাপ এগিয়ে। প্রথমত, আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়, জুঁইও ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল্, অতএব সমানে সমান, পয়েন্ট কাটাকাটি। দ্বিতীয়ত, দর্শনযোগ্য চেহারা-সুরত আমার নেই, কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা যেন নিজ হাতে জুঁইকে অপূর্ব রূপবতী করে গড়েছেন। তাহলে জুঁই এ পর্যন্ত আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকলো। তৃতীয় কারণ হলো আমি ছেলে, কিন্তু জুঁই মেয়ে। রূপের জগতে মানুষ মেয়েদেরকেই বেশি চিনে, ছেলেদেরকে নয়। অতএব সব মিলিয়ে জুঁই আমার থেকে দু-ধাপ এগিয়ে আছে!
জুঁই বললো, আপনার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?
বেশ ভালো। আপনার? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কী জানি, তেমন সুবিধা করতে পারছি না।
আমি জুঁইকে বললাম, আপনাকে নিয়ে তো আমাদের অনেক আশা-ভরসা। আপনি আমাদের গর্ব।
জুঁই দাঁতে জিভ কেটে বললো, হায় আল্লাহ্, আপনি কার সাথে কী মেশাচ্ছেন? কোথায় আপনি, আর কোথায় আমি? আপনার সাথে কি আমাদের কোন তুলনা হয়? আমরাই বরং আপনাকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। আপনি জানেন, আপনি যখন ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন, তখন আপনার ওপর আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। কেন জানেন, আমার ধারণা ছিল যে হয়তো বা আপনার জন্যই আমি ট্যালেন্টপুল বৃত্তিটা মিস করেছিলাম। মেট্রিক পরীক্ষার ব্যাপারটা কিন্তু ভিন্ন। এখানে সেন্টার ছাড়িয়ে পুরো বোর্ডের মধ্যে মেধা বিচার করা হবে। আমরা চাই আপনি ফার্স্ট স্ট্যান্ড করুন।
এবার আমার জিভ কাটার পালা। বলে কী এই পাগল মেয়ে?
আমি কিছু বলার আগেই জুঁই বললো, আচ্ছা বলুন তো আপনি এত সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেন কেমন করে?
আমি মনে মনে একচোট গর্বের হাসি হেসে নিলাম। একটা মেয়ের মুখে নিজের কবি-প্রতিভার প্রশংসা শোনার চেয়ে বড় কোন প্রাপ্তি নেই।
আমি নিজের ব্যক্তিত্বে কবি-সুলভ পাণ্ডিত্য ও গাম্ভীর্য্য এনে স্মিত হাসলাম। বললাম, সত্যি ভালো কবিতা লিখি? কই, আমার কাছে তো মনে হয় না?
এ আপনার বিনয়, জুঁই বললো, আপনাকে না জানিয়ে অবশ্য আমি একটা বড় অন্যায় করে ফেলেছি। বলেই সে করিমের দিকে তাকালো।
করিম বললো, আমার কোন দোষ নেই রে দোস্।
জুঁই কথা কেড়ে নিয়ে বললো, পরীক্ষা শুরু হবার আগের দিন বিকেলে করিম এল। ওর কাছে আপনার কথা শুনলাম। আশা করেছিলাম যে আপনি হয়তো আসবেন। আমরা সবাই আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আপনি কী নিষ্ঠুর রে বাবা, এলেন না। আপনার কবিতার খাতা থেকে করিম আমাদেরকে অনেকগুলো কবিতা পড়ে শোনালো। যাওয়ার সময় কবিতার খাতাটা আমি জোর করে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিলাম। ওটা কিন্তু এখনো আমার দখলে।
আমি করিমের ওপর কৃত্রিম রাগ ঝাড়লাম। কিন্তু মনে মনে বললাম, হে সুন্দরী, ভুবনমোহিনী তন্বী তরুণী, আমার একটা কবিতার খাতা কেন, তুমি যদি চাও তোমার জন্য আমি আরো অনেকগুলো, যতগুলো চাও তার চেয়েও দ্বিগুণ, তিনগুণ, দশগুণ কবিতার খাতা এনে তোমার চরণপদ্মে উৎসর্গ করবো। আমি কেবল তোমার নামে তোমার জন্যে কবিতা রচনা করার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে দিব।
জুঁই বললো, আপনার কবিতাগুলো খুবই সুখপাঠ্য। কবিতার খাতাটা পাওয়ার পর আমি পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে ও-গুলো পড়েছি। এখনো পড়ি। প্রতিদিনই পড়ি। সুযোগ পেলেই পড়ি। জানেন, বেশ কয়েকটি কবিতা আমার তো প্রায় মুখস্তই হয়ে গেছে।
এরূপ প্রশংসায় আমার ভাবে গদগদ হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন কিছুই করার থাকে না।
এরপর জুঁই সাক্ষাৎকার নেয়ার ভঙ্গিতে আমাকে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, আপনার লেখা এ যাবত কালের সেরা কবিতা কোন্টি বলে আপনি মনে করেন?
গলা খাকারি দিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনুকরণে বললাম, সব সন্তানই পিতামাতার কাছে অতি প্রিয়, সমান আদরের। কবিতা আমার সন্তানের মতই। কাকে ফেলে কার কথা বলি?
জুঁই বললো, আপনার একটা কবিতা আমার কাছে কী যে ভালো লেগেছে বলার মত না।
আমি আগ্রহ চাপা দিয়ে রাখতে পারি না। বলি, কোন্ কবিতাটা, বলুন তো?
জুঁই বলে, কবিতাটির অবশ্য কোন নাম নেই, কিন্তু পংক্তিগুলো চমৎকার :
তুমি কি আমার কথা ভাবো?
কঠিন প্রাচীরে কান পেতে শুনি
মুক্তির দিন একদিন আসবেই,
সেইদিন তোমাকে আবারো কাছে পাবো।
তুমি কি আমার কথা ভাবো?
আমার মাথায় বোধ হয় ঝিন করে উঠলো। বললাম, আমার একটু মাথা ধরেছে, রুমে ফিরতে হবে।
জুঁই মেয়ে-সুলভ 'হায় আল্লাহ্' করে উঠলো। বললো, এই ভর সন্ধ্যায় রুমে গিয়ে কী করবেন?
অন্য আরেকটি মেয়ে টিপ্পনি কেটে বললো, আরে ভাই, উনার পড়া আছে না? না পড়ে কি কেউ ফার্স্ট হতে পারে?
জুঁই বললো, চলুন না, আমাদের বাসায় বেড়িয়ে যাবেন!
আমি বললাম, আজ নয়, আরেকদিন আসি?
মনে থাকবে তো?
নিশ্চয়ই। বলে করিমের হাত ধরে বলি, চল্ যাই।
করিম মনে করিয়ে দিল, কিরে কথা কী ছিল? কথা ছিল না যে নাহিদকে দেখে টাকা দিবি?
জুঁই বিব্রত হলো। ওর সঙ্গী মেয়েগুলোর দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকলো। দেখলাম পাশের একটা মেয়ে পেছন দিয়ে জুঁইয়ের হাতে কী যেন গুঁজে দিল। জুঁই আমার দিকে একটা কচকচে পাঁচশো টাকার নোট মেলে ধরলো।
আমি লজ্জা পেয়ে না না করার আগেই করিম ছোঁ মেরে ওটা হাতে নিয়ে বললো, চল্ যাই।
কিছুদূর আসার পর করিমকে বললাম, টাকা নেয়াটা ঠিক হয় নি।
করিম আমাকে ধমক দিয়ে বললো, চুপ কর, যা বুঝিছ না তা নিয়ে কথা বলিস না।
তারপর বললো, চল্ বাজারে যাই।
কেন?
টাকা পেলাম খরচ করতে হবে না?
না রে!
না রে কী?
টাকাটা তুই ফেরত দিয়ে আয়।
করিম আরো ক্ষেপে গিয়ে বললো, আমাকে কি পাগলা কুত্তায় কামড় মেরেছে যে টাকা ফেরত দিয়ে আসবো?
তাহলে দে, আমিই দিয়ে আসি।
করিম তেড়ে উঠলো, হুমম্, এত কষ্ট করে কিছু টাকা রুজি করলাম, তা আবার ফেরত দিয়ে আসি? এত বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কেমনে রে, ঐ- ঐ শালার মদন-
তাহলে কী করবি টাকা দিয়ে?
কাজ আছে। তুই বাসায় চলে যা।
মানে?
আমি বাজারে যাচ্ছি।
আমি বাসায় ফেরত এলাম। শেরখান তখন পড়ছিল। আর আমার মনের ভিতর তখন আগুন জ্বলছিল, নিদারুণ একটা কষ্ট কলজে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমার কবিতা নিয়ে আমার কত গর্ব ছিল, আমি খুব ভালো কবিতা লিখি! আমার সেই ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে অদ্যাবধি কোন ভালো কবিতাই লিখতে পারি নি। অর্থাৎ আজও আমি কবি হয়ে উঠতে পারি নি। আসলে, আমার মনে হয় কেউ কবি হতেও পারে না, যাঁরা কবি তাঁরা এমনি এমনি কবি, জন্ম থেকেই কবি। আমি কত দীর্ঘ একেকটা কবিতা লিখেছি, সেগুলোকে পাঠ্যপুস্তকের কবিতার সাথে তুলনা করেছি, মনে মনে বলেছি, আমি শতগুণ ভালো কবিতা লিখি, আর এ নিয়ে আত্মপ্রসাদ ভোগ করেছি। আমার আত্মবিশ্বাস কতই না দৃঢ় এবং আকাশচুম্বী ছিল! আমার এ অহংকার অবশ্য বেশিদিন ছিল না।
একবার জাহিদকে দিয়ে আমি ঢাকা থেকে শামসুর রাহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কিনিয়ে আনলাম। আমি পড়ার আগেই জাহিদ সবকটি কবিতা পড়ে ফেললো। কবিতা পড়ে জাহিদ আশ্চর্য হয়ে ওর প্রতিক্রিয়া জানালো, কিরে ভাই, শামসুর রাহমান এগুলো কী লিখেছে? এগুলো কোনো কবিতা হলো? জাহিদ পরে মন্তব্য করেছিল, শামসুর রাহমানের দশটা কবিতা পড়ে আমি নিজেই একটা নতুন কবিতা লিখে ফেলতে পারি, এবং সেটা শামসুর রাহমানের কবিতার চেয়েও ভালো কবিতা হবে। জাহিদের কাব্যপ্রতিভার দৌড় আমার জানা ছিল। তাই আমি ওকে কষে একটা ধমক দিয়ে বলেছিলাম, কবিতা লেখা কি এতই সহজ? কবিতা লেখা এত সহজ না। তুই একটা কবিতা লিখে শামসুর রাহমানের একহাজার কবিতার মধ্যে গুলিয়ে দে। সেই একহাজারটা কবিতা থেকে যদি আমি বেছে তোর কবিতাটা বের করে দিতে না পারি, তবে বুঝবো হয় তুই শামসুর রাহমানকে ছাড়িয়ে গেছিস অনেক আগেই, অথবা, আমি নিজেই আজও কোনো কবিতাই লিখতে পারি নি। শুধু শামসুর রাহমান কেন, তুই তোর নিজের লেখা পঞ্চাশটা কবিতা আল্-মাহমুদ, জীবনানন্দ দাশ, এঁদের কবিতার সাথে মিশিয়ে দে, তারপর আমি ঠিক ঠিক আলাদা করে দিব কোন্টি তোর লেখা কবিতা, আর কোন্টি তোর লেখা নয়। যদি ভুল করে তোর মাত্র একটি কবিতাকেও শামসুর রাহমান, বা আল্-মাহমুদ বা জীবনানন্দের বলে ঘোষণা দিই, তাহলে আমি নিশ্চিত তুই তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ না হলেও অন্তত আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস বহু আগেই।
জুঁইয়ের মুখে আমার লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতাটির কথা শুনতে পেয়ে আমার প্রচণ্ড খারাপ বোধ হচ্ছে। আমি কি কবিতা লেখা ছেড়ে দিব? কারণ আমি এখনো কবিতা লিখতে পারি না। জুঁই আমাকে যে চরণগুলো শুনিয়েছিল সেগুলো আমার লেখা কোনো কবিতার অংশবিশেষ নয়। আমি একজন তরুণ কবিকে খুব ভালোবাসি। সেই কবি আজ আর বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর কবিতা বেঁচে আছে। আমার পাশের গাঁয়ের সেই তরুণ কবি, এক বুক অভিমান নিয়ে গায়ে হলুদের দিন যে কবি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন, মিজানুর রহমান শমশেরী, জাহিদের মুখে আমি তাঁর কত্তো কবিতা শুনেছি! তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপনের বছর কবির নিজ গ্রাম সুতারপাড়ায় একটি ক্রীড়া ও বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় - মোঃ সোলায়মান, সুরুজ মোল্লা, রাজা মিয়া, হারুনূর রশিদ, আনোয়ার হোসেন - পরলোকগত কবির এসব বন্ধু মিলে সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এঁদের পাশে দাঁড়ানোর মত যোগ্যতা সেদিন আমার ছিল না। যখন অনুষ্ঠান শুরু হলো, উপবিষ্ট অতিথিবৃন্দের সামনে টেবিলে বসানো ছিল সাদাকালো একটি ছবি- উদাস-আনমনা কবি কোথায় তাকিয়ে আছেন কোন্ সুদূরের পানে, আর ঠিক তার নিচে লাল-নীল-সবুজ কালিতে কবির নিজ হাতে লিখা দুটি পঙক্তি :
প্রকৃতির এই কঠোর বিধানে পদানত বারবার
বন্ধু তোমার হৃদয় বীথিতে সাধ জাগে বাঁচিবার।
দুটি মাত্র চরণ, অথচ যেন সারা জীবনের সবগুলো কবিতার মর্মকথা লুকিয়ে আছে ও-দুটি পঙক্তির মাঝে। কবি বাঁচতে চেয়েছিলেন, এখনো বেঁচে আছেন, আমাদের হৃদয়ে তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। কবি-হৃদয়ের সেই বাঁচার আকুতি আমার মনেও দোলা দিয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত আমি কত কবিতাই না লিখেছিলাম, যখনই ও-দুটি চরণ আমি পড়লাম, আমার মনে হলো আমি এখনো কোন কবিতাই লিখি নি। কিন্তু আমার নিজের ওপর খুব অভিমান হয়েছিল, কেন আমি এমন একটা কবিতা, এমন দুটি লাইন, অন্তত এমন একটি লাইনও অদ্যাবধি লিখতে পারলাম না? আমি আমার আগের কবিতাগুলো ভস্মীভূত করে দিলাম, নতুন করে শুরু করলাম - আমি একটা ভালো কবিতা লিখবোই। একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা না হোক, অন্তত অমন দুটি লাইন, কিংবা একটি মাত্র চরণ, যা যুগ যুগ ধরে আমার অনুরাগীদের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকবে।
এর এক বা দু-বছর পর শমশেরীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ততদিনে আমি পূর্বাপেক্ষা সামান্য পরিণত হয়েছি বইকি। শমশেরীর বিশালকায় পাণ্ডুলিপিটি আধবেলার জন্য আমার হস্তগত হলো। আমি রুদ্ধশ্বাসে পুরো পাণ্ডুলিপির ওপর চোখ বুলিয়ে গেলাম। আমি বিমোহিত, যেটা পড়ি মনে হয় এটাই শমশেরীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। যতটুকু পড়ি, মনে হয় এর চেয়ে ভালো কোন কবিতা হয় না। আমি অনেকগুলো কবিতা নির্বাচন করলাম অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবো বলে। কিন্তু এটি তো আমার একক আবৃত্তি-অনুষ্ঠান নয়। আমি আমার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা পাঠ করলাম।
কবির সমৃতির উদ্দেশ্যে আমিও বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলাম। আমার একদল অনুরাগী, যেমন ইসলাম খান, রাজ্জাক ওরা মিলে ও-গুলো বৃন্দ আবৃত্তির আয়োজন করলো। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মহোদয়, যিনি শমশেরীর অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু, গাজীরটেক প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক বায়েজীদ হোসেন আমাকে প্রথমবারের মত কবি স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা দিলেন- অত্র এলাকার আরেকজন কবি জনাব নাহিদুল ইসলাম- । এ ঘোষণায় আমি যারপরনাই লজ্জিত হলেও কবি-স্বীকৃতি ছিল আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তি।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শমশেরীর পাণ্ডুলিপিটা আরো একদিন আমার কাছে রাখার অধিকার পেয়েছিলাম। আমি যতগুলো কবিতা পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম তার মধ্যে একটি কবিতার গোটা পাঁচেক লাইন আমার সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছিল। আমার কবিতার খাতার প্রথম পাতায় আমি আমার ভালোলাগা চরণগুলো লিখে রেখেছিলাম। আমার দুঃখ, আমার 'শ্রেষ্ঠ কবিতা'র মধ্যে যেটি জুঁইয়ের কাছে সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছিল সেটি আমার কবিতা নয়। সেটি ছিল শমশেরীর কবিতা থেকে সংকলিত কয়েকটি ছত্র মাত্র- 'তুমি কি আমার কথা ভাবো' ...
তাহলে কী দাঁড়ালো? একটা ভালো কবিতা সবার কাছেই ভালো। যাঁরা কবিতা পড়েন ও বোঝেন তাঁরা হাজারটা অ-কবিতার মধ্য থেকেও একটি খাঁটি কবিতা চিনে বের করে নিতে পারেন। যেমন জুঁই পেরেছিল।
পরদিন পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরুচ্ছি। পেছন থেকে কে যেন শার্ট টেনে ধরলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখি শিমুলিয়ার মান্নান। ওর চোখে মুখে দুষ্টু হাসি।
আমি বললাম, পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস?
মান্নান এ কথার উত্তর না দিয়ে মুচ্কি হেসে বললো, সবই শুনেছি। তোমাকে দেখে আজকাল মেয়েরা পাঁচশো টাকার নোট দেয়। তুমি আবার সেই টাকা দিয়ে মিষ্টি কিনে মেয়েদের বাসায় পাঠাও।
লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে আমি বললাম, কী বলছিস? আমি বুঝতে পারছি না।
তা বুঝবে কেন? এক্কেবারে ছোট্ট খোকাটি, মায়ের বুকে দুধু খাও তো!
ফাজলামো রাখ্। কী বলবি খুলে বল্।
তুমি ঠিকই বুঝে গেছ, এখন আবার না বোঝার ভান করছো, না?
আমি গলার স্বর নরম করে বললাম, দোস্, ইজ্জত মারিস না।
তুই নাকি আমার ফুফুর প্রেমে পড়ে গেছিস?
তোর ফুফুটা আবার কে?
মান্নান আমার নাক টেনে বললো, হেঁয়ালি এখন রাখো শালার হাবু।
কী?
মান্নান বললো, তুই জানিস না যে জুঁই আমার আপন ছোট ফুফু?
খোদার কসম আমি জানতাম না। কিন্তু ফুফু তো কী হয়েছে?
মান্নান হাসতে হাসতে বললো, যদি হুল ফোটাবার চেষ্টা করিস তাহলে কিন্তু উল্টো নিজেই কামড়ের চোটে মারা পড়বি।
রহস্যোদ্ধার হতে অবশ্য বেশি সময় লাগে নি। করিম মিয়া অত্যুৎসাহী হয়ে জয়পাড়া বাজারে গিয়ে পুরো পাঁচশো টাকার মিষ্টি কিনেছিল। মিষ্টি নিয়ে ফেরার পথে মান্নানের সাথে দেখা। সহৃদয় ও অতিশয় বন্ধু-বৎসল করিম মিয়া তো আর কাউকে কোথাও ফেলে যেতে পারে না, পথে যাকে পাবে সে তাকেই হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে।
তারপর জুঁইদের বাসায় গিয়ে আশেপাশের জানা-অজানা আরো অনেককে নিয়ে সেই মিষ্টি খাওয়া হয়।
মান্নান নাকি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, যার জন্য এই মিষ্টি খাওয়া, সে-ই তো এখানে নেই। নাহিদকে ডেকে নিয়ে আসি?
করিম ঝামটা দিয়ে বলেছিল, জলদি খা, নাহিদ আসবে না।
এই হলো ঘটনা।
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৯