(৩)
নাকবোচা মাইক্রোবাস
পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্স বা পিআইএ’তে চাকরি করতেন আমাদের এক ফুফাতো ভাই। পিআইএ’র নাক বোচা ভক্স ওয়াগন মাইক্রোবাসটি নিয়ে তিনি চলে এলেন। বিরাট এক সম্পদ হাতে এলো। সড়কের দক্ষিণে আমাদের এক চাচার বাড়ি। সেখানেই মূল ঘাটি হলো মুক্তিবাহিনির। ফ্রন্ট খোলা হয়েছে আরো চার পাঁচ মাইল পশ্চীমে ভইটিকরে। যেখানে বড় সড়কটি একটি টিলার মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে। ফ্রন্টে যোদ্ধাদের খাবার দরকার। ভলান্টিয়ার দল দাড়িয়েঁ গেলো। চাল ডাল আসতে লাগলো বিভিন্ন বাড়ি থেকে। নাকবোঁচা মাইক্রোবাস ছুটলো পূর্বদিকে। যেদিকে ভারত সীমান্ত। পাউরুটি বোঝাই করে নিয়ে এলো। ছোটরা সাহায্য করতে গেলেই ধমক দিয়ে বিদায় করা হলো। বাড়ির বাইরে বের না হতে সাফ জানিয়ে দেয়া হলো। সাইদুর আলী আর সৈয়ব আলী আটকা পড়েছিলেন শহরে। তাঁরা পায়ে হেঁটে গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত এলেন। সেখানে একটি ট্রাক্টর পেয়ে ট্রাক্টরে চড়ে রওয়ানা দেন বাড়ির পথে। কিছুদূর আসার পর পাকিস্তানী জেট বিমান এসে তাদের উপর চড়াও হয়। পুকুর পাড়ে মসজিদের পাশে সাইদুর আলীকে ঠেস দিয়ে বসানো হয়েছে। আমাদের ছোট চাচা যিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করতেন, তিনি ব্যান্ডিজের বড় বান্ডিল নিয়ে এসে সাইদুর আলীকে পেঁচাতে লাগলেন। আমি মাটিতে হাটু গেড়ে দু’হাত দিয়ে ঠেলে তাকেঁ সোজা করে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। সাইদুর আলী কোনরকমে এক হাত তুলে আমাকে ইশারায় এতো জোরে ধাক্কাতে নিষেধ করলেন। তাঁর ডান কাধেঁর পেছন দিকে গুলি ঢুকেছে। চামড়ার নিচে কালো দাগ ফেলে সমস্ত শরীর পেঁচ মেরে তল পেটের ডান দিকে স্থির হয়েছে। হাত দিয়ে অনুভব করলাম টর্চ লাইটের ব্যাটারীর মতো। ছোট হাত দিয়ে কুলাতে না পেরে উল্টো ঘুরে পিঠ দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখলাম। অন্যরা ছুটে গেলেন পাশের গ্রামে ততকালীন নামকরা কন্ট্রাক্টর ছত্তার হাজি সাহেবের জীপটি নিয়ে আসতে। ধানের জমিনের মাঝখান দিয়ে শুকনো খাল, জমির আল ঠেলে পার করে ৪৪ মডেলের উইলি জীপটি নিয়ে আসা হলো। তারপর সাইদুর আলীকে বহন করে নিয়ে জীপে উঠিয়ে দেয়া হলো। ভারতের দিকে নিশানা করে জীপটি ছুটে গেলো। অনেকটা বেহুলার ভেলার মতো অনিশ্চীত যাত্রা। আমরা ক’জন ফিরে আসতে লাগলাম। কিছুদূর আসার পর প্রচন্ড গর্জন করে জেট বিমানগুলো এসে হাজির হলো। আমরা ত্বরিত মুর্ত্তা বনে ঢুকে নিশ্চুপ পড়ে রইলাম। বড় সড়কের উপর চড় চড় করে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। রাস্তার পাশে অনেকদিন ধরে পড়েছিলো সিএন্ডবি’র গালা জ্বাল দেওয়ার একটি চুলা। চুলার উপর দিকে ধোঁয়া বের হওয়ার একটি চোঙ। চোঙটিকে কামান ভেবে তার উপর সব গুলি ঢেলে দিয়ে চলে যায় জেট বিমানটি। পাকিস্তানের জাতীয় খেতাব প্রাপ্ত বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্ত্তা আমার তৃতীয় চাচা। তিনি জানালেন এগুলো স্যাবর জেট। এগুলোর গুলি ছোড়ার কায়দা অভিনব। প্রথমে ডাইভ করে লক্ষ্যবস্তুর উপর নেমে আসে। তার পর উঠে যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে উড়ে চলে যায়। সেখান থেকে ফিরে সৈয়ব আলীর বাড়িতে গেলাম। একটি ঠেলা গাড়িতে লাশ আনা হয়েছে। মাথার খুলি কপাল থেকে উল্টে গিয়ে পেছন দিকে ঝুলে আছে। মাথার মগজ ওখানেই পড়ে গেছে। আর কিছু ঝুলে আছে নিচের দিকে। দড়ির মতো। বাড়িতে ফিরে এসে গোসল করে জানাজায় যাবো। এমন সময় খবর এলো ভারতে নিয়ে যাওয়ার পথে সাইদুর আলী মারা গেছেন। তাঁর লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে। ওয়্যারলেস, টেলিফোন এমনকি গাড়িঘোড়ারও কোন চলাচল নেই। অথচ খবরগুলো এতো দ্রুত কিভাবে চলে আসতো। কে নিয়ে আসতো। তা আজও এক বিস্ময় হয়ে আছে।
---চলবে।।