ঠাস করে একটি শব্দ হলো। তারপর আর একটি। তারপর আর একটি। এক, দুই, তিন করে গুনতে শুরু করলাম। কিন্তু গুনা আর শেষ হয় না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে হলো। জীবনে এই প্রথম রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা। তারপর অনেক অভিজ্ঞতা। গুলি, লাশ, রক্ত, বিপর্যস্ত মানুষের ছুটে চলা, কতকিছু। তখন আমি মেট্রিক পরিক্ষার্থী। পরীক্ষার দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে আছে। তারিখ এখন আর মনে নাই। তবে হাতে বেশি সময় ছিলো না। এটা মনে আছে। তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। রেজিষ্ট্রেশনে বয়স একটু বাড়ানোই ছিলো। এই পুচকেটিও মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে শুনে অনেকে অবাক হতো। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ চলছে। মিটিং মিছিলে উত্তাল হয়ে আছে দেশ। এমন অবস্থায় গুলির শব্দ। পড়া আর হলো না। কান পেতে থাকলাম বাইরে। তখনও আমাদের এই ছোট্ট শহরে টেলিভিশন আসে নাই। আর মোবাইল ফোনের জন্মই হয়নি। টেলিফোন খুবই সীমিত। একমাত্র ভরসা রেডিও। রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে রইলো। তারপর কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। সংবাদ পাঠকেরা অতিমাত্রায় পেশাদারী ভঙ্গিতে সংবাদ পাঠ করে গেলেন। আর বিভ্রান্তির গভীর খাদে হাবুডুবু খেতে শুরু করলো সবাই। বাড়তে লাগলো উদ্বেগ উৎকন্ঠা। বাইরে কঠোর কারফিউ। মনে পড়ছে দিনটি ছিলো শুক্রবার। মসজিদে যথারীতি জুমার আযান হলো। নির্বিকার। গুলির শব্দ এখন বন্ধ। গোসল সেরে গেলাম মসজিদে। সিলেট শহরে লামাবাজারে আমাদের বাসা। মসজিদে যেতে লামাবাজার চৌরাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। সাইকেল, রিক্সা, ঠেলাগাড়ি কিংবা কোন একটি গাড়িও নেই। মানুষ-জনও নেই। মোড় পার হতে গিয়ে দেখলাম অবিশ্বাস্য কান্ড। সমস্ত জঞ্জাল, বড় পাথর, ইট-কাঠ-লোহালক্কড়, টঙ-দোকান, সদ্য কাটা প্রাচীন শিরিষ গাছের বিরাট কান্ড রাতারাতি উঠে এসেছে রাস্তার মাঝখানে। দৈত্য কিংবা যন্ত্র ছাড়া যা সম্ভব না, কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে মানুষ তা করেছে। ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড দিয়ে সমস্ত রাস্তা আটকে ফেলেছে মানুষ। এটাই ছিলো বাঙালির প্রাথমিক প্রতিরোধ। মসজিদে খুব কম মানুষ। ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে মিলিটারীরা আসতে পারবে না। তাই একটু নিরাপদ বোধ হলো। কেউ কেউ বললেন পায়ে হেঁটে আসছে না ঠিক তবে, জীপ নিয়ে ব্যারিকেডের ফাঁক-ফোকর ঠেলে এদিক ওদিক হানা দিচ্ছে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে। ওদূরে নিম্বার্ক আশ্রম। রাস্তার উপরে গাছের বড় বড় গুড়ি আর ডাল-পালা। সেগুলো ডিঙ্গিয়ে আরো দু’একজনের সাথে গেলাম। আশ্রমের মোহন্ত রাসবিহারী চক্রবর্ত্তী। আগে থাকতেন আমাদের পাড়ায়। সাধন বাবুদের বাসায়। এখন আশ্রমেই থাকেন। বকের পালকের মতো শুভ্র পরিচ্ছদ। শুভ্র-সাদা চুল দাড়ি। চুল মাথার উপরে ছোট্ট খোঁপা করে বাঁধা। শরীরের গঠন অবিকল রবীঠাকুরের মতো। কমন্ডুলু হাতে নিয়ে ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে যেতেন। এক পায়ে স্যান্ডেল। অপর পায়েরটা খানিক দূরে ছিটকে পড়ে আছে। আশ্রমের সামনে একচিলতে জমি। সবুজ ঘাসে জমাট রক্তের কালো দাগ। অনেকক্ষণ গড়ানোর ফলে বৃত্তের মতো কালো হয়ে আছে। মাঝখানে শুভ্র কাশফুলের মতো পড়ে আছে তাঁর নিথর দেহ।।
...চলবে।